skip to Main Content

ফুড ট্রাভেল I অপূর্ব শিল্পকর্ম

খেজুরের গাছ কাটা মানে রসের জন্য প্রস্তুত করা থেকে রস সংগ্রহ মায় গুড় তৈরি। এ এক অনন্য শিল্পকর্ম। যা দেখার আনন্দ মাত্রাছাড়া। এক সকালের সেই অনন্য অভিজ্ঞতার রস ছড়িয়েছেন বিশিষ্ট আলোকচিত্রী দীন মোহাম্মদ শিবলী

পদ্মাপারের ছোট্ট ছিমছাম শহর রাজশাহীর সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক। অসংখ্য স্মৃতি এই শহরের কোনায় কোনায়। শুধু শীতের স্মৃতি যদি হাতড়াই, তবে খেজুরের রসের সঙ্গের স্মৃতিগুলো সেই রসের মতোই মিষ্টি। শীত আসতেই শুরু হয়ে যায় গাছিদের ব্যস্ততা। রাজশাহী আমের শহর হলেও জেলার আশপাশের পুরো অঞ্চলেই আমবাগানের পাশাপাশি রয়েছে অগণিত খেজুরগাছ। পবা, বানেশ্বর, আড়ানী, বাঘা, চারঘাট নামগুলোর সঙ্গে খেজুরের রস আর তা থেকে বানানো গুড়ের সুনাম সমগ্র দেশেই।
এখন প্রতি মাসেই নানা প্রয়োজনে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাই। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতেই রাজশাহীর ফটোগ্রাফি গুরু পরাগ ভাইয়ের ফোন পেয়ে অন্য রকম অনুভূতি হলো। তিনি জানতে চাইলেন, এবার কত দিন এখানে থাকবে, আর একদিন ভোরে খেজুরের রস খেতে আসব কি না। আমি শোনামাত্রই শৈশব-কৈশোর-যৌবনের শীতসকালের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই পরাগ ভাইকে নিশ্চিত করলাম, অবশ্যই যাব। তিনি যে আমার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করেছিলেন, তা জানা ছিল না।
৩ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় কালের কণ্ঠের ফটোসাংবাদিক সালাহ্উদ্দীন ভাই তার মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের বেলদার পাড়ার বাসার সামনে হাজির। প্রচন্ড শীত, তবে কুয়াশা নেই। ফজরের নামাজ পড়েই বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। ঘাড়ে ক্যামেরার ব্যাগ আর খেজুরের রস নেওয়ার জন্য বড় একটি বোতল নিয়ে বসে পড়লাম মোটরবাইকের পেছনে। জানলাম, গন্তব্য শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে বেলপুকুর থানার চর ধাদাস। সেখানে বিয়ে হয়েছে তার এক নাতনির। অনুধাবন করলাম, আমরা তিন নানা যাচ্ছি নাতনির শ্বশুরবাড়ি খেজুরের রস খেতে। মাত্র ৩৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম গ্রামে। হাড়কাঁপানো হিমেল বাতাসে আমার কাহিল অবস্থা; কিন্তু শীতের চাদরে ঢাকা, শিশিরে ভেজা প্রকৃতির ঘ্রাণ মনটাকে অন্য রকম করে দেয়। মনে পড়ে যায় রাজধানী ঢাকার কথা। কত যে কষ্টের এক শহরে স্বপ্ন গড়ে তুলছি; অথচ সুন্দর গ্রামকে পায়ে ঠেলে এসেছি।
মাটি আর ইটের সংকর বসতঘরের মাঝে বড় একটি পেয়ারাগাছের নিচে চেয়ার পেতে বসলাম। কুয়াশা ভেদ করে প্রথম সূর্যের আলো আসতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে চলে এসেছে শত হাঁড়ি খেজুরের রস। আরও আসছে। বাড়ির উঠানের পাশেই রয়েছে কয়েকটি বিশালাকার খেজুরগাছ। নাতজামাই বললেন, এগুলোই সবচেয়ে পুরোনো এবং রসও বেজায় মিষ্টি। বলতে বলতেই তরতর করে উঠে গেলেন তিনতলা সমান উঁচু গাছে আর নামিয়ে আনলেন হাঁড়ি।

আমরা বারান্দায় পাতা পাটিতে বসে পড়লাম। জগ ভরা রস, পরিষ্কার গ্লাস, এক বাটি ঘরে ভাজা মুড়ি। দুই গ্লাস খেতেই আমার পেট টইটম্বুর; কিন্তু মন তো ভরে না। আমরা তিনজনই বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের রাস্তায় ছবি তুলতে। বাড়ি থেকে বলে দিলো ৪০ মিনিটের মধ্যেই ফিরতে, কেননা উঠানে দুই চুলায় ততক্ষণে রস জ্বাল দেওয়া শুরু হয়ে গেছে গুড় তৈরির জন্য। ছবি তুলতে তুলতে কখন যে সময় চলে গেল টেরই পেলাম না।
রস ঘন হলে গরম গরম খেতে নাকি দারুণ।

এবার গরম রসের পালা। আবার খেলাম, তবে অল্প করে। দুধ চিতই, ভাপা পিঠা চলে এসেছে ততক্ষণে। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে পিঠা খেতে খেতে মনে হলো, এই স্মৃতিগুলো যেন অম্লান থাকে আমৃত্যু। চোখের সামনে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে গুড় হতে দেখলাম। এ যেন এক অপূর্ব শিল্পকর্ম। বিশেষত রস জ্বাল দেওয়া শুরুর পর ক্রমেই পাতলা থেকে গাঢ় হতে থাকা গুড় থেকে পাটালি তৈরি চাট্টিখানি কথা নয়। একেক পরতে স্বাদ একেক রকম। তা দিয়ে তৈরি পদের স্বাদও বলিহারি।

এই ডেলিকেসির সঙ্গে পৃথিবীর অন্য আর কিছুরই তুলনা চলে না। চাক্ষুষ না করলে বলে বোঝানোও মুশকিল। মন খারাপ হয় আমাদের সন্তানদের কথা ভেবে, শহরে বসে এসব দেখার সৌভাগ্য ওদের হয় না।
তবে এর পেছনের শ্রমটাও কিন্তু অনেক। ঘরের নারী-পুরুষ উভয়কেই ভোর থেকে সমানতালে প্রতিদিন একটানা ছয় ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়। এরপর শুরু হয় তাদের দৈনিক অন্যান্য কাজ।
অসাধারণ আতিথেয়তা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বোতল ভরা মিষ্টি রস নিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম শহরে। দিনের অন্য ব্যস্ততায় হারিয়ে গেলেও অনন্য এই সুখস্মৃতির আচ্ছন্নতা আমার আজও কাটেনি।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top