skip to Main Content

ফুড ট্রাভেল I মরুশহরে বিচিত্র ব্যঞ্জন

একদিকে এশিয়া কাপের জমজমাট আসর, অন্যদিকে রোমাঞ্চকর খাদ্যাভিযান। যে দেশের সঙ্গে জিতেছে বাংলাদেশ, সে দেশেরই রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়া। লিখেছেন মাসুদ পারভেজ

আমরা যাচ্ছি উস্তাদের ডেরায়! গুগল ম্যাপ যখন হাতের মুঠোয়, তখন দুবাইয়ের রাজপথ, অলিগলি পেরিয়ে জায়গামতো পৌঁছে যেতে সমস্যা হলো না একটুও। কিন্তু ঢুকতে গিয়েই বিপত্তি। আগে থেকেই উস্তাদের কাবাবের গুণাগুণ বর্ণনায় আমাদের জিভে জল এনে দেওয়া সঙ্গীর বাধা, ‘আরে, আরে, করছেন কী! এটা তো মহিলাদের!’

এশিয়া কাপ চলাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে ইরানি রেস্তোরাঁ আল উস্তাদে তামিম ইকবাল। ডানে লেখক

মহিলা সঙ্গী থাকলেই কেবল সেখানকার ফ্যামিলি হলে প্রবেশাধিকার মেলে পুরুষদের। না হলে মিনিটখানেকের হাঁটা দূরত্বে তাদের বসার আলাদা ব্যবস্থা। সেখানে ঢুকে রীতিমতো ধন্দে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। এটা কি রেস্তোরাঁ নাকি কোনো ফটো স্টুডিও? আমাদের দেশে স্টুডিওর দেয়ালে যেমন ‘ফোর আর’ সাইজের অজস্র ছবি সাঁটা থাকে, আল উস্তাদ স্পেশাল কাবাবের অন্দরসজ্জাও ঠিক তেমন। সেই ফটো গ্যালারিতে চোখ বোলাতে গিয়েই বুঝলাম যে প্রতিটা ছবিরই আছে আলাদা বিশেষত্ব। ইরানি এই রেস্তোরাঁয় কাবাবের স্বাদ নিতে আসা তারকা অতিথিরাই আসলে ফ্রেমবন্দি হয়ে আছেন একেকটি ছবিতে।

পাকিস্তানি রেস্তোরাঁ বিএনবির সুস্বাদু পদ

কার ছবি নেই সেখানে? সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজ-অতিথিরা তো আছেনই- বাদ পড়েননি শেখ আর যুবরাজ। আছেন বলিউড তারকা থেকে শুরু করে ক্রিকেট কিংবদন্তিরাও। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, আমির খান ও সালমান খান মায় হালের রণবীর কাপুররাও। শারজায় ক্রিকেটের রমরমা যুগের প্রায় সব তারকাই উস্তাদের কাবাবের স্বাদধন্য হয়েছেন। ছবিতে ধরা আছে এই যুগের ক্রিকেট তারকারাও!
তারকাসঙ্গে ঢাকা থেকে এশিয়া কাপ ক্রিকেট কাভার করতে যাওয়া জনাচারেক ক্রীড়া সাংবাদিকের ছবিও হয়তো ভবিষ্যতে সেঁটে যাবে আল উস্তাদের দেয়ালে। সেখানে আমাদের কাবাব ভোজনপর্বে যে সঙ্গী ছিলেন আমাদের মহাতারকা তামিম ইকবালও!
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচেই কবজির চোটে এশিয়া কাপ থেকে সরে দাঁড়ানো এই ওপেনারের পরদিন সকালেই দেশে ফেরার ফ্লাইট। তাই চটজলদি হোটেলে ফেরার তাড়া। যদিও আমাদের পৌঁছানোর একটু বিলম্ব পুষিয়ে নিতে তিনি আগেই খাবার অর্ডার করে অপেক্ষায়। যেতে না-যেতে তাই কাবাবের ওপর আমাদের হামলে পড়া শুরু। ‘আমাদের’ বলতে ঢাকা ট্রিবিউনের মিনহাজ উদ্দিন খান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আরিফুল ইসলাম রনি এবং ‘ডায়েট’ করতে করতে দশাসই শরীরটাকে প্রায় লিকলিকের পর্যায়ে নামিয়ে আনা ডেইলি স্টারের সাকেব সুবহান।

করাচি দরবারে দরবারি আয়োজন

তাঁর ‘ডায়েট’ অব্যাহত রাখার পণ ভঙ্গেরও শুরু সেদিন থেকে। খাদ্যাভ্যাসে মাংসাশী এই তরুণ সাংবাদিকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সামনে ‘গোশত’ থাকলে আর মাথা ঠিক থাকে না! সংযম ভেঙে তিনি যদি কবজি ডুবিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমরা নিজেদের জিভ সামাল দিতে যাব কোন দুঃখে! উল্লেখ্য, সেখানে ভোজনরসিক আরেকজনও ছিলেন। ভিসা বিড়ম্বনায় একটু দেরিতে সেদিনই দুবাই গিয়ে পৌঁছানো রনির প্রবাসী বন্ধু আরেফীন সতেজ। সফর শেষ হতে হতে স্থানীয় ডু মোবাইলের এই চাকুরের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কটাও রূপ নিয়েছে বন্ধুত্বে। আল উস্তাদের বিবিধ ব্যঞ্জনে রসনা তৃপ্তির পর সতেজের অনুযোগ, বিলটা হওয়ার আগে কেন তাঁকে একটু জানানো হলো না। দুবাইয়ের নামি ফুড ব্লগার হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় তাঁর জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা আছে। ছিল আল উস্তাদেও। বড় অঙ্কের ডিসকাউন্ট করিয়ে দিতে পারলেন না বলে তাঁর সেকি আফসোস!
আমরা অবশ্য তাঁর অন্য পরিচয় পেয়ে বরং বেশি উচ্ছ্বসিত। একজন জলজ্যান্ত ‘রেস্টুরেন্ট গাইড’ পেয়ে গেলাম বলে। ফুড ব্লগার যখন, তখন খাবারের জন্য দুবাইয়ের সেরা গন্তব্যগুলোর খোঁজ তাঁর কাছে মিলবে। তিনি শুধু খোঁজ দেননি, প্রায় রাতেই তাঁর গাড়ি আমাদের নিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটেছে দুবাইয়ের বিভিন্ন রসনাগন্তব্যে। ওদিকে আবার আমাদের পেশাগত কাজের ব্যস্ততাও এমন তুঙ্গে যে, বাংলাদেশের খেলা থাকলে এ রকম খাদ্যাভিযানে বের হওয়া রীতিমতো অসম্ভব। তবু সেদিন ঠিক ফুরসত মিলে যায়, যেদিন মাশরাফি বিন মর্তুজাদের খেলা থাকে না। খেলা না থাকলেও কাজ তো থাকে। সেই কাজ আবার দুবাইয়ের সময় রাত ৮টার মধ্যে শেষ করতেই হয়। দুই ঘণ্টা সময়-পার্থক্যের ঢাকায় তখন রাত ১০টা। আমাদের প্রতিবেদন পাঠানোর শেষ সময়ও ওটাই। তবু চটজলদি বেরিয়ে পড়া যায় না। কারণ, শরীরের ওপর ক্রমাগত ‘গোশতে’র চাপ কমাতে সাকেব কাজ শেষ হওয়ামাত্রই দুবাইতে আমাদের ঠিকানা আতানা হোটেলের জিম আর সুইমিংপুল কাঁপাতে নেমে যায়!

ইয়েমেনি রেস্তোরাঁ মারাহেবের হানিফ মিট রিবস, শোল্ডার ও লেগ

মাঝে একদিন করাচি দরবার নামের রেস্তোরাঁর ব্রেইন মাসালায় বুঁদ হওয়ার আগেও ওই এক ঘণ্টার সূচি বদলায়নি। আমরা তাই ক্ষুধা বাড়াতে বাড়াতে ওর অপেক্ষায় থাকি। তাতে আবার ঝুঁকিও থাকে। যদি নামি রেস্তোরাঁর ‘সিগনেচার’ আইটেম ফুরিয়ে যায়! অবশ্য সতেজ আমাদের সেই ঝুঁকিমুক্তির আনন্দেও ভাসিয়েছেন। যেমন ফোন করে মারাহেব আল সাফা নামের ইয়েমেনি রেস্তোরাঁর ‘হানিথ মিট রিবস’ বুক করে রেখেছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দারুণ জনপ্রিয় এই ইয়েমেনি পদের রন্ধনপ্রণালিও এমন জটিল যে চটজলদি তৈরি করে দেওয়ারও উপায় নেই। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে এর ভেতরটা কাদায় লেপ্টে দেওয়ার ব্যাপার আছে। আছে এর ভেতরে শুকনো কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির রীতিও। রান্না শুরুর প্রক্রিয়া এরপরই। ধাতব পাত্রে প্রয়োজনীয় সব জিনিস দিয়ে গর্তের উপরিভাগ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এয়ারটাইটও করে দেওয়া হয়, যাতে ধোঁয়া বের হতে না পারে। এভাবেই তৈরি হয় ‘হানিথ মিট রিবস’ এবং ‘হানিথ শোল্ডার’। নানা মসলায় তৈরি বাসমতী চালের পোলাওয়ের ওপর কম বয়সী ভেড়ার পাঁজর ও কাঁধের মাংস। বিশাল বিশাল থালায় আমাদের সামনে ভেড়ার পাঁজর আর কাঁধের মাংসের সঙ্গে এলো আরেক বিখ্যাত পদ ‘ম্যান্ডি চিকেন’ও। ওই রেস্তোরাঁয় নানা পদ চেখে দেখার দুই রকম ব্যবস্থা। বিছানা-বালিশ পেতে রেখে আয়েশে খাওয়ার ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনি পাতা আছে চেয়ার-টেবিলও। দেখলাম, আরবরা প্রথম ব্যবস্থাই পছন্দ করে। তবে আমরা বেছে নিলাম সাহেবি কেতা। থালাভর্তি খাবার শেষ করতে পারবো কি না, তা নিয়ে সংশয় উড়িয়ে দিতে দিতেই সাবাড়ও করে দিলাম সব!

ইবনে হামিদুরে মাছের সমারোহ

সবশেষে ‘কোনাফা’ নামের ডেজার্টের স্বাদ আজীবন জিভে লেগে থাকার মতো। এই স্বাদ আরেকবার নিতে না পারার আফসোস অবশ্য ‘উম-আলী’ নিয়ে একদমই নেই। এটিও দুবাইতে জনপ্রিয় আরেক পদের ডেজার্ট, যা আমাদের দেশের শাহি টুকরার কাছাকাছি কিছু একটা।
এশিয়া কাপের ম্যাচের দিন প্রেসবক্সে সরবরাহ করা খাবারের তালিকায় যা ছিল অবধারিত। তবে আমরা একেক দিন বেরিয়েছি একেক রেস্তোরাঁর খোঁজে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুপার ফোরের লড়াইয়ে জেতার পরই ঠিক করেছিলাম, পরদিন যাবো কোনো আফগান রেস্তোরাঁয়। যেই ভাবা সেই কাজ। সতেজ থাকতে চিন্তা কী! পাকিস্তানকে হারানোর পর ভালো পাকিস্তানি রেস্তোরাঁয় যাওয়া নিয়েও নিশ্চিন্ত ছিলাম আমরা। প্রথম গন্তব্য আফগান রেস্তোরাঁ ‘ওয়াখা’। যেখানে আমাদের সঙ্গী আমার পুরোনো বন্ধু শাহেদও। সেদিনই সে এশিয়া কাপ শেষে বিখ্যাত ‘লাল কিলা’ রেস্তোরাঁয় আমাদের নিমন্ত্রণ করে যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে ফোনে ওর ক্রমাগত হুমকি! ওই দিনই যে আমরা গিয়েছি ডেজার্ট সাফারিতে এবং তাতে প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত বারবিকিউ ডিনার নিয়েই ওর যত চিন্তা! সেখানে পেট ভরিয়ে না ফেলার হুমকিতে কাজও হলো!
আমরা রয়েসয়ে খেয়ে রাতে গেলাম লাল কিলায়। না হলে যে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সেখানকার মাটন কড়াই এবং মেথি চিকেনের স্বাদে এখনো মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম না।
‘সল্টবে’ নামেই বেশি খ্যাত বিখ্যাত টার্কিশ শেফের রেস্তোরাঁ নুসারাতে গিয়েও মাতোয়ারা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মিনহাজের তাতে আগ্রহ ছিল না বিন্দুমাত্র। থাকবে কীভাবে? বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের দলেবলে সেখানে যাওয়ার দিন যে বন্ধু তামিম ইকবালের সৌজন্যে মুফতে ঢুকে পড়েছিল সে-ও! সেখানে একেকজনের পকেট থেকে বিস্তর খসে যাওয়ার ধকলের কথাও শুনেছি ওর মুখ থেকেই। তার ওপর যে রেস্তোরাঁয় নিয়মিত পদধূলি পড়ে ম্যারাডোনা কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো ব্যক্তির, সেখানকার স্টেক সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা তাই ওই পথ মাড়ালাম না। তবে থামলামও না। ‘ওয়াখা’ থেকে পাকিস্তানি রেস্তোরাঁ ‘বিএনবি’ ঘুরে ঘুরে কাবাবের স্বাদ নেওয়া চলতেই থাকে আমাদের। চলতে থাকে থালাভর্তি প্ল্যাটার নিয়ে তা দিব্যি সাবাড় করে দেওয়াও! ফেরার আগে সতেজের ছুড়ে দেওয়া শেষ চ্যালেঞ্জও আমাদের ভড়কাতে পারেনি। স্বাদ বদলাতে সফরের শেষ দিনে তাঁর আমন্ত্রণ বিখ্যাত মিসরীয় সি-ফুড রেস্তোরাঁ ইবনে হামিদু’তে। যেখানেও আস্ত হামুর মাছের কড়কড়ে ভাজি আর বিশালাকার গলদা চিংড়ির সঙ্গে অন্যান্য পদের কিছুই আমরা অবশিষ্ট রাখিনি।
তাতে বোধ হয় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যায় যে ‘আল ওস্তাদ’ দিয়ে শুরু হওয়া দুবাইয়ের খাদ্যাভিযানে ‘উস্তাদি’ আমরাও কম দেখাইনি!

লেখক: ভোজনরসিক এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top