skip to Main Content

ফুড বেনিফিটস I সয়াবিন

আমিষের বড় উৎস। স্বাদে অনন্য। নিয়মিত খেলে রোগবালাই শরীরের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। গর্ভাবস্থা থেকে বার্ধক্য—সব সময় এটি সুফলদায়ী

সয়াবিনের আঁতুড়ঘর পূর্ব চীন। আনুমানিক ২৮৩৮ খ্রিস্টপূর্বে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। কালপরিক্রমায় চীনারা সয়াবিনকে একধরনের গাঁজনের মাধ্যমে খাদ্যোপযোগী করে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সয়াসস, নেটো, মিসো, টেমপেহ নামের পদগুলো। সে দেশের বিজ্ঞানীরা সয়াবিনের ঘণ্টকে পাতিত করে ক্যালসিয়াম সালফেট বা ম্যাগনেশিয়াম সালফেট যোগে একধরনের দধি উৎপন্ন করেছিলেন, যা টফু নামে পরিচিতি পায়। এ পাতিত দ্রবণ তথা গাঁজনকৃত পদ পরে জাপানে ও ইন্দোনেশিয়ায় খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হয়। পাশ্চাত্য ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত এই শস্যদানার হদিস পায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গবাদিপশুর খাবার হিসেবে ফলানো হতো সয়াবিন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকান বিজ্ঞানী জর্জ ওয়াশিংটন কারভের এ বীজের মধ্যে প্রোটিন ও তেল আবিষ্কার করেন। তারপর থেকে এটি নিয়মিতভাবে উঠে আসে মানুষের খাদ্যতালিকায়।
সয়াবিনের প্রতি ১০০ গ্রামে এনার্জি পাওয়া যায় ৪৪৬ কিলোক্যালরি, কার্বোহাইড্রেটস ৩০.১৬ গ্রাম, চিনি ৭.৩৩ গ্রাম, খাদ্যআঁশ ৯.৩ গ্রাম। ফ্যাট আছে ১৯.৯৪ গ্রাম, যার মধ্যে স্যাচুরেটেড ২.৮৮৪ গ্রাম, মনোআনস্যাচুরেটেড ৪.৪০৪ গ্রাম, পলিআনস্যাচুরেটেড ১১.২২৫ গ্রাম, ওমেগা থ্রি ১.৩৩০ গ্রাম, ওমেগা সিক্স ৯.৯২৫ গ্রাম, প্রোটিন ৩৬.৪৯ গ্রাম, ট্রিপটোফেন ০.৫৯১ গ্রাম, থ্রিওনিন ১.৭৬৬ গ্রাম, আইসো লিউসিন ১.৯৭১ গ্রাম, লিউসিন ৩.৩০৯ গ্রাম, লাইসিন ২.৭০৬ গ্রাম, মিথিওনিন ০.৫৪৭ গ্রাম, সিসটিন ০.৬৫৫ গ্রাম, ফেনেলালানিন ২.১২২ গ্রাম, থাইরসিন ১.৫৩৯ গ্রাম, ভেলিন ২.০২৯ গ্রাম, আরজিনিন ৩.১৫৩ গ্রাম, হিস্টিডিন ১.০৯৭ গ্রাম, অ্যালেনাইন ১.৯৭৫ গ্রাম, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড ৫.১১২ গ্রাম, গ্লুটামিক অ্যাসিড ৭.৮৭৪ গ্রাম, গ্লিসিন ১.৮৮০ গ্রাম, প্রোলাইন ২.৩৭৯ গ্রাম, সেরাইন ২.৩৫৭ গ্রাম, ভিটামিন এ ১ মাইক্রোগ্রাম, থায়ামিন ০.৮৭৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন ০.৮৭ মিলিগ্রাম, নিয়েসিন ১.৬২৩ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড ০.৭৯৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ০.৩৩৭ মিলিগ্রাম, ফোলেট ৩৭৫ মাইক্রোগ্রাম, কোলিন ১১৫.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ই ০.৮৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে ৪৭ মাইক্রোগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭৭ মিলিগ্রাম, কপার ১.৬৫৮ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৫.৭ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ২৮০ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ২.৫১৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৭০৪ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৭৯৭ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ২ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ৪.৮৯ মিলিগ্রাম এবং জলীয় অংশ ৮.৫৪ গ্রাম। এসব উপাদান শরীরের নানা ধরনের রোগ সারাইয়ের কাজ করে। যেমন সয়াবিনে থাকা আইসোফ্লাভিন ও কারসিনোজিন উপাদান দুটি ক্যানসার প্রতিরোধী। শরীরে এ রোগের বিস্তারে যেসব এসট্রোজেন কাজ করে, সেগুলোর ক্ষমতা বিলুপ্ত করতে পারে এ দুটি উপাদান। বিশেষ করে প্রোস্টেট ও কোলন ক্যানসার রোধে থেরাপির মতো কাজ করে আইসোফ্লাভিন। এ রোগে আক্রান্ত কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করতে পারে সয়াবিনের জেনিসটিইন। ধ্বংস করে টিউমারও। প্রোটিনে ভরপুর এই শস্যদানা হৃদ্্রোগের ঝুঁকি কমাতে সক্ষম। এটি খেলে শরীর থেকে ৯.৩% সিরাম কোলেস্টেরল, ১২.৯% এলডিএল কোলেস্টেরল এবং ১০.৫% সিরাম ট্রাই গ্লিসারাইড কমে। বিপরীত দিকে ভালো কোলেস্টেরল তথা এইচডিএল-এর মাত্রা বাড়ে ২.৪ শতাংশ। এই পরিবর্তন হৃদ্্রোগের ঝুঁকি প্রায় ১৮ থেকে ২৮ শতাংশ কমিয়ে আনে। এলডিএল কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষেত্রে সয়াপ্রোটিন ওষুধের মতোই কাজ করে। আবার এর তেলে ৫০% লিনোলিক অ্যাসিড থাকে, যা সিরাম কোলেস্টেরল কমায়। ফলে হৃদ্্রোগের প্রবণতা হ্রাস পায়।
অনিদ্রা কিংবা ঘুমের ঘাটতিজনিত রোগ থেকে নিস্তার পেতে খাওয়া যেতে পারে সয়াবিন। সাধারণত হজমের গন্ডগোল থাকলে রাতে ভালো ঘুম হয় না। সয়াবিন ম্যাগনেশিয়ামের আধার। এ মৌল হজমপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। ফলে ঘুম ভালো হয়। এ উদ্দেশ্যে সয়াবিনের দুধের সঙ্গে আমন্ড বাটার ও পাকা কলা ব্লেন্ড করে খাওয়া যেতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও এই শস্যদানার ভূমিকা আছে। সয়াবিন মানুষের শরীরে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে। ডায়াবেটিসের প্রাথমিক পর্যায়ে তা কার্যকর।
মগজ সুস্থ রাখার পাশাপাশি মেধাশক্তি বাড়াতে পারে সয়াবিনে থাকা কোলিন। এটি সেরেব্রাল কর্টেক্সকে সতেজ করে। ফলে মস্তিষ্ক অল্পেই ক্লান্ত হয়ে যায় না। এর লেসিথিন মগজ গঠনের অন্যতম উপাদান। হাড় সুরক্ষিত রাখতেও খাওয়া যেতে পারে সয়াবিন। এতে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও ফোলেট অস্টিওআর্থ্রাইটিস দূর করতে সক্ষম। অস্থির ক্ষয়রোধ এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে গিঁটব্যথা উপশমের প্রত্যাশায় সয়াবিন খেলে উপকার পাওয়া যাবে। ক্যালসিয়াম থাকায় এটি বার্ধক্যজনিত হাড়ের অসুখের ওষুধ হিসেবে কাজ করে।
সয়াবিন রক্ত পরিষ্কারক। এর আয়রন রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখে এবং লোহিত কণিকা গঠনে সহায়তা করে। সয়াবিন খেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যথাযথভাবে অক্সিজেন পৌঁছানো নিশ্চিত হয়। পাশাপাশি রক্তস্বল্পতাও দূর হয়। এ উদ্দেশ্যে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এক কাপ করে সয়াবিনের দুধ পান করলে সুফল পাওয়া যাবে। এই দানা নিয়মিত খেলে ঋতুস্রাবজনিত বিভিন্ন সমস্যা থেকে রেহাই মিলবে। এতে থাকা আইসোফ্ল্যাবোনস নারীর জননতন্ত্রের উন্নতি ঘটায়। ঋতুস্রাবের সময় ইস্ট্রোজেন লেভেল কমে যায়। এর সঠিক মাত্রা ধরে রাখে আইসোফ্ল্যাবোনস। ঋতু¯্রাবকালীন মুড সুইং ও অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগার প্রবণতা কমাতে পারে এ উপাদান। মেনোপজের লক্ষণ, যেমন হট ফ্লাশ ও বেশি ঘাম নিয়ন্ত্রণ করে আইসোফ্ল্যাবোনস। গর্ভবতীদের জন্য সয়াবিনে থাকা ভিটামিন বি ও ফোলেট খুবই উপকারী। এর ফলিক অ্যাসিড ভ্রূণের সুস্থতা নিশ্চিত করে। ফলে সুস্থ শিশু জন্মের সম্ভাবনা বাড়ে। এ ছাড়া সয়াবিন খেলে লিভার ভালো থাকে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এর আটা দিয়ে তৈরি রুটি খাওয়া যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে ৩ ভাগ গমের আটার সঙ্গে ১ ভাগ সয়াবিনের আটা মিশিয়ে নিতে হবে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায় এ খাদ্য।
ত্বকচর্চায় সয়াবিনের ভূমিকা আছে। কৈশোরে মুখ ও গলায় ফুসকুড়ি হওয়ার প্রকোপ থেকে চামড়াকে সুরক্ষা দেয়। আঁচিল হওয়া প্রতিরোধ করে। দীর্ঘস্থায়ী যৌবন চাইলে প্রতিদিন সকালে এক কাপ সয়াবিনের দুধ পান করা যেতে পারে। এ থেকে তৈরি দই নিয়মিত খেলে শরীরের সৌন্দর্য বাড়ে।
উপকারিতা যতই হোক, সয়াবিন খেতে কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয়। কাঁচা অবস্থায় এটি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। পাতিত করার আগে তাতে ক্ষতিকর প্রাকৃতিক উপাদানগুলো থেকে যায়। এই অবস্থায় সয়াবিন খেলে শরীরে আমিষ তৈরির এনজাইম ও ট্রিপসিন কাজ করার ক্ষমতা হারায়। এতে প্রোটিন হজম না হয়ে পেটে তীব্র ব্যথা হতে পারে।

 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top