skip to Main Content

ফুড বেনিফিট I লবণ

এ যৌগের ব্যবহার বিপুল। মানবদেহের জন্য এর চেয়ে জরুরি উপাদান খুব কমই আছে। ত্বকের যত্নে এটি দাওয়াইতুল্য

মধু, অমø, লবণ, কটু, তিক্ত ও কষা— এই ছয়ে ষড়রস। লবণ এগুলোর রাজা। কেন্দ্রীয় রস। যেকোনো মসলাই লবণ ছাড়া অপূর্ণ, বিশেষ স্বাদের দিক থেকে। প্রাচীন রোমে সৈন্যদের বেতন হিসেবে দেওয়া হতো লবণ। গ্রিক ‘স্যালারিউম’ শব্দের অর্থ লবণ, ‘স্যালারি’র মানে বেতন এসেছে এর থেকেই। কিন্তু সল্ট তথা লবণ কী? এটি খাদ্যে ব্যবহৃত একধরনের অজৈব দানা। সোডিয়াম ও ক্লোরিনের রাসায়নিক যৌগ। কেবল সোডিয়াম ক্লোরাইডই ভক্ষণযোগ্য।
প্রাচীনকালে খনি থেকে লবণ উত্তোলিত হতো। ধারণা করা হয়, চীনের সানসি প্রদেশের ইয়নচুনের খনিই লবণের সবচেয়ে পুরোনো ভূ-গর্ভস্থ উৎস। ভারতবর্ষে লবণের ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো।
চার ধরনের লবণের সন্ধান মেলে— সৈন্ধব, সাম্ভর, সামুদ্রী ও বীট। সৈন্ধব পাওয়া যায় খনিতে। রাজস্থানের সম্বর সরোবর থেকে উৎপাদিত লবণের নাম সাম্ভর। সমুদ্রের পানি থেকে তৈরি হয় সামুদ্রী এবং সৈন্ধব লবণের সঙ্গে হরীতকী মিশিয়ে হয় বীট লবণ।
বিপুল পরিমাণ সোডিয়ামের উৎস লবণ। শরীরের দরকারি ইলেকট্রোলাইটের প্রয়োজনীয় মৌল এটি। বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক ইলেকট্রোলাইট ও সোডিয়াম ছাড়াও ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় অপরিশোধিত লবণে।
লবণের অভাবে মাথাব্যথা হতে পারে। ঝিমুনি আসে। এমনকি জ্ঞান হারানোর আশঙ্কাও আছে। দীর্ঘদিন লবণস্বল্পতায় ভুগলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে বার্ষিক সর্বনি¤œ এক পাউন্ডের তিন ভাগের দুই ভাগ লবণের প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশের বাসিন্দাদের শরীরে এর প্রয়োজন বেশি। যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাদের বেশি লবণ খাওয়া জরুরি।
লবণ ভালো প্রিজারভেটিভ। প্রাচীনকালে খাদ্য ও জৈববস্তু সংরক্ষণের মূল উপাদান ছিল লবণ। মিসরীয়রা মমি তৈরিতে এ দ্রব্য ব্যবহার করেছে। লবণ মানুষের যৌন চাহিদা বাড়ায়। বীর্য, মূত্র, চোখের পানি, রক্তসহ শরীরের প্রায় সর্বত্র লবণের উপস্থিতি। কোষবৃত্তিক কার্যক্রমে এটি অপরিহার্য। লবণ না খেলে কোষ পুষ্টি লাভ করে না এবং শরীর পানিশূন্যতায় ভোগে।
কফ, বাত ও পিত্তের সমস্যা দূর করে সৈন্ধব লবণ। এ খনিজ ক্ষুধা বাড়ায় এবং শরীর শীতল রাখে। সৈন্ধব খাওয়া চোখের জন্য ভালো। আয়ুর্বেদে এই লবণকে হৃৎপিন্ডবান্ধব এবং বীট লবণকে ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী হিসেবে ধরা হয়। আধুনিক মতে, লবণ শরীরের রক্ত বা অন্য তরল উপাদানের দানা বেঁধে যাওয়ায় বাধা দেয়, দ্রবণীয় অবস্থাতেই থাকতে সহায়তা করে। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতে তরল জমাট বাঁধতে বাধা দেয় লবণ। শরীরে পাচক রসের সক্রিয়তা বাড়িয়ে হজম পদ্ধতি উন্নত করে। খাদ্যে লবণ ব্যবহার করলে তা খাওয়ার সময় মুখের লালাক্ষরণ ত্বরান্বিত করে। হাড়ের যথাযথ গঠনে এর ভূমিকা আছে। এ অজৈবকে রক্তপরিষ্কারক হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেকেই বুকজ্বালা ও অম্বলে ভোগেন। এ ক্ষেত্রে খাওয়ার আগে আধা চা-চামচ লবণ এক গ্লাস পানিতে গুলে খেতে পারেন। উপকার পাবেন।
বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে, পোড়া, ক্ষত ও রক্তপাতের স্থানে লবণ মাখলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। ঘায়ের উপর লবণে ভেজা ব্যান্ডেজ বা পট্টি বাঁধলে ঘা দ্রুত পাকে ও সেরে ওঠে।
গলাব্যথা, ফোলা ও ফ্যারিনজাইটিস দূর করতে গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গার্গল করতে পারেন। শুকনা কাশি থেকে মুক্তির জন্য রাতে ঘুমানোর আগে এক দানা লবণ জিভের উপর রেখে ঘুমাতে পারেন। জোয়ানের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে খেলে পেট ব্যথা দূর হয়। লবণ আর হলুদে সামান্য পানি মিশিয়ে একসঙ্গে পিষে মচকে যাওয়া স্থানে মাখলে ব্যথা ও ফোলা ভাব কমে। বাতজ্বর উপশমে আদা ও লেবুর রসের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে সকাল-সন্ধ্যা খেতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীরা ঘুমানোর আগে সামান্য গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে খেয়ে ঘুমালে আরামবোধ করবেন। পেটে কৃমির উপদ্রব কমাতে দৈনিক সকালে লবণ পানি পান করতে পারেন। যারা প্রস্রাবের সমস্যায় ভুগছেন, তারাও সুফল পাবেন। হার্নিয়ার কবল থেকে মাত্র সাত দিনে মুক্তি দিতে পারে সৈন্ধব লবণ। এ জন্য সৈন্ধব গুঁড়া করে খাঁটি ঘি মিশিয়ে সাত দিন খেতে হবে। দাঁতের ব্যথায় লবণ পানি দিয়ে কুলি করতে পারেন। পাইওরিয়া সারাতে লবণ মিহি গুঁড়া করে সর্ষের তেলের সঙ্গে মিশিয়ে দাঁত মাজতে পারেন। এ ছাড়া লবণের সঙ্গে গোলমরিচ গুঁড়া মিশিয়ে খেলে বমি বন্ধ হয়।
রূপচর্চায় কাজে লাগে লবণ। শীতে ত্বক ফাটলে আধা চামচ লবণে মেশানো মধু মুখে মাখুন। ১০ মিনিট পর সামান্য গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। নিয়মিত এমনটি করলে ত্বক আর্দ্র থাকবে। ফাটবে না। ত্বকের মৃতকোষ দূর করতে দুই চামচ লবণ, এক চামচ নারকেল তেল এবং দুই চামচ চিনির মিশ্রণ মুখে লাগান। কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। মুখের শুষ্কতা দূর হবে। প্রাকৃতিক উপাদান বলে লবণ খুব সহজেই ত্বকের ময়লা দূর করে। অল্প লবণ নিয়ে তার সঙ্গে পছন্দসই ফেশিয়াল অয়েল মেশান। তা পানিতে মিশিয়ে নিন। এ মিশ্রণ ত্বকে মাখলে ময়লা দূর হবে। ত্বক হবে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। অনেকের চোখের নিচের অংশ ফুলে যায়। এ ক্ষেত্রে লবণ ও ফেশিয়াল অয়েলের। মিশ্রণ তুলায় লাগিয়ে চোখের ফোলা অংশে রাখুন। কিছুক্ষণ রাখার পর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। দিনে দুবার। চোখের ফোলা ভাব কমবে। পায়ের যত্নে লবণের ব্যবহার পুরোনো। দুই চামচ লবণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে তাতে পা ডুবিয়ে বসে থাকুন। পায়ের মরা কোষ দূর হবে। পায়ে ব্যথা থাকলেও চলে যাবে। নারকেল তেলে মেশানো লবণ ঠোঁটে লাগালে উপকার পাবেন। কিছুক্ষণ পর ঠোঁট ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। দিনে দুবার এ কাজ করলে ধীরে ধীরে ঠোঁট ফাটার সমস্যা দূর হবে।
গত শতাব্দীর বিশের দশকে মিশিগানের একটি কোম্পানি বুকলেটে লবণের এক শ একটি ব্যবহার উল্লেখ করেছিল। সেদ্ধ সবজির রঙ উজ্জ্বল রাখতে, আইসক্রিম ঠান্ডা রাখতে, ফুটানো পানি ঠান্ডা করতে, ছত্রাক দূরীকরণে, কাপড়ের দাগ তোলায়, মোমবাতির ক্ষয় ধীরগতির করতে, ফুল তাজা রাখতে এবং মুখের ঘা সারাইয়ের কাজে লবণের ব্যবহার তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে লবণের ব্যবহার এক শ একেই সীমাবদ্ধ নয়। এ যৌগের প্রায় ১৪ হাজার ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওষুধ তৈরিতে, শীতপ্রধান দেশে বরফ গলানোর কাজে, সাবান তৈরিতে এবং বয়নশিল্পের রঙ বানাতে কাজে লাগছে লবণ।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top