skip to Main Content

ফুড বেনিফিট I সরিষার তেল

স্বাস্থ্যরক্ষা, ত্বক ও চুলের পরিচর্যায় এর জুড়ি নেই। এমনকি দাঁতের সুস্থতায়ও এটি অব্যর্থ

সরিষা, নাকি সয়াবিন তেল? রসনাবিলাসী বাঙালির এই জিজ্ঞাসা বহুদিনের পুরোনো। বিজ্ঞান রায় দেয় সরিষার তেলের পক্ষে। উপকারী রাসায়নিকের উপস্থিতি এবং ঔষধি গুণের বদৌলতে আমাদের পূর্বসূরিরা রান্নায় ও রূপচর্চায় ব্যবহার করে আসছেন এ তেল। ওমেগা আলফা-৩ এবং ওমেগা আলফা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কারণে এ তেল স্বাস্থ্যকর। সরিষার দানা পিষে তৈরি তেলটি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতেও ব্যবহৃত হয়।
মনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ সরিষার তেল শরীরে ভালো ও মন্দ কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখে। মন্দটির মাত্রা কমিয়ে ভালোর পরিমাণ বাড়ায়। ফলে রক্তে ফ্যাটের মাত্রা কমে এবং রক্ত চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রিত হয়। তেলের কপার, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে সরিষার তেল কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, রান্নায় সয়াবিন তেলের বদলে সরিষার তেল ব্যবহার করলে কার্ডিওভাসকুলার সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭০ শতাংশ কমে যায়। এর আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড হার্ট ভালো রাখে।
গ্লুকোসিনোজেনিক নামের পদার্থ ক্যানসারজনিত টিউমারের গঠন রোধ করে। সরিষার তেলে এ উপাদান অ্যান্টি-কারসিনোজেনিক নামে বিদ্যামান। এ তেলে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট-কলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যানসার থেকে রেহাই দেয়। এক টেবিল চামচ তেলের সঙ্গে এক চা-চামচ কর্পূর মিশিয়ে বুকে মালিশ করলে অ্যাজমায় আক্রান্তদের সঙ্গে সঙ্গে আরাম হয়।
ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়ে সরিষার তেল। এতে অ্যালাইল আইসোথায়োসায়ানেট উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিফাঙ্গাল। এ ছাড়া ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও লড়ে। গ্লুকোসিনোলেট থাকায় এ তেল শরীরে ব্যাকটেরিয়া এবং বিভিন্ন জীবাণুর বিস্তারে বাধা দেয়। তেলের তীব্র সুবাস পোকামাকড়কে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। ফলে ম্যালেরিয়া কিংবা পোকামাকড়জনিত অন্যান্য বালাই থেকে সুরক্ষা মেলে। ভারতে এডিস মশা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সরিষার তেল ব্যবহৃত হচ্ছে।
অস্থিসন্ধির ব্যথা ও ফোলা ভাব, কোমর ও মাংসপেশির ব্যথা নিরাময়ে সরিষার তেল কার্যকর। এর সেলেনিয়াম অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবে কাজ করে; যা ব্যথানাশক। ফ্যাটি অ্যাসিড খুব বেশি থাকায় মগজের কার্যক্ষমতা বাড়ায় সরিষার তেল। পাশাপাশি অবসাদ দূর করে। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে।
সুস্বাস্থ্য বহুলাংশেই ক্ষুধার ওপর নির্ভর করে। রান্নায় সরিষার তেল খেলে পাকস্থলীর পাচক রস উদ্দীপিত হয়। এতে ক্ষুধা বাড়ে। একইভাবে পরিপাক, রক্তসংবহন ও রেচনতন্ত্রের উদ্দীপক এই তেল। কোনো কারণে খেতে অরুচি হলে রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহার করে দেখতে পারেন। রুচি বাড়বে। তেল খাওয়ার পাশাপাশি শরীরে মাখলে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। মালিশ করলে ঘামের গ্রন্থিগুলো সক্রিয় হবে। ফলে ঘামের সঙ্গে শরীরের টক্সিন দূর হয়। শিশুর শরীরে সরিষার তেল মাখলে হাত-পায়ের দৈর্ঘ্য ও ওজন বৃদ্ধি পায়। এসব ছাড়াও বড়দের নিদ্রাহীনতা, শ্বাসকষ্ট ও প্রদাহ কমায়, হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। কানের ব্যথায় ওষুধ হিসেবে কাজ করে। চামড়ার কাটা-ছেঁড়ায় অ্যান্টিসেপটিকের কাজও করে। নিয়মিত মালিশে বাতের ব্যথা কমে। ঠান্ডা-কাশি উপশমে এ তেলের উপকারিতা প্রমাণিত। শ্বাসনালি থেকে কফ অপসারণেও সক্ষম। ম্যাগনেসিয়ামের আধিক্য থাকায় মাইগ্রেন কমাতেও খেতে পারেন সরিষার তেল। ম্যাগনেসিয়াম ও সেলেনিয়াম— এ দুটি খনিজ আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ কমানোর পাশাপাশি এ রোগের প্রকোপ কমায়। যারা হাড়ের রোগে ভুগছেন, তারা নিয়মিত সরিষার তেলে রান্না করা খাবার খেতে পারেন। এটি কাজ করবে সাইনোসাইটিসের বিরুদ্ধেও। সরিষার তেল দিলে বন্ধ হয়ে যাওয়া নাক ঠিক হয়ে যায়।
এসব তো গেল শরীরের ভেতরে সরিষার তেলের প্রভাবের কথা। রূপচর্চায়ও এটি কম যায় না। গোসলের আগে গায়ে এ তেল মাখার চল শতবর্ষ পুরোনো। এতে ত্বকের সৌন্দর্য বজায় থাকে। প্রাকৃতিক উপায়ে ত্বকের তামাটে ভাব ও কালচে দাগ দূর করতে ব্যবহৃত হতে পারে এ তেল। বেসন, দই ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রসের সঙ্গে কিছুটা সরিষার তেল মিশিয়ে তা ত্বকে মাখুন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এ কাজ করলে ভালো ফল পাবেন।
অন্যান্য তেলের তুলনায় সরিষার তেল বেশি ঘন। এতে থাকা উচ্চমাত্রার ভিটামিন ই ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেয়। ফলে স্কিন ক্যানসার প্রতিরোধ হয়। বলিরেখা দূর করতেও কার্যকর ভিটামিন ই। সানস্ক্রিন লোশনের বদলে ব্যবহার করতে পারেন সরিষার তেল। তবে একটু নিয়মমাফিক। ত্বকে মাখার পর ভালোভাবে ঘষতে হয় যাতে তেল দৃশ্যমান না হয়। অন্যথায় ত্বকে ধুলাবালি জমে হিতে বিপরীত হতে পারে।
অনেকের ঠোঁট বারোমাসই শুষ্ক থাকে। মাত্র কয়েক ফোঁটা সরিষার তেলই ঠোঁটের শুষ্কতা দূর করতে পারে। ঠোঁটের যত্নে এ তেল বাজারচালু বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম জেলি ও গ্লিসারিনের চেয়ে বেশি নিরাপদ বলে বিবেচিত।
চুলের যত্নেও ভূমিকা আছে সরিষার তেলের। অনেকের অকালে চুল পাকে। ঝরেও যায়। উভয় সমস্যার পরিত্রাণ আছে খনিজ ও ভিটামিনে ভরপুর সরিষার তেলে। এতে থাকে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন। এ উপাদান ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়ে চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এর আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি অ্যাসিড ও ম্যাগনেসিয়াম একই কাজ করে। রাতে ঘুমানোর আগে নিয়মিত এ তেল মাখলে চুল কালো হয়। এ ছাড়া খুশকি ও মাথার ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। এ তেলে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে— ওয়েলিক ও লিনোলিক অ্যাসিড। দুটিই ফ্যাটি অ্যাসিড। উভয়েই চুলের যত্নে টনিকের মতো কাজ করে।
ত্বকের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে পা ফাটা। এর মোক্ষম একটি দাওয়াই সরিষার তেল। সামান্য মোমের সঙ্গে তেল মিশিয়ে গরম করে ফাটা স্থানে নিয়মিত মাখুন। সমস্যা নিমেষে উধাও হবে। উপকার পাবেন হাত ও পায়ের নখের চারপাশে মেখেও।
ঝকঝকে দাঁতও দিতে পারে সরিষার তেল। আধা চা-চামচ তেলের সঙ্গে এক চা-চামচ হলুদ ও আধা চা-চামচ লবণ মিশিয়ে দিনে দুবার মাজলে দাঁত সুস্থ থাকবে। এ ছাড়া দাঁতের জিনজিভাইটিস এবং পেরিওডোনডাইটিসের মতো রোগবালাই থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে। লুইটেনের চমৎকার উৎস এ তেল। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি এটি বার্ধক্যকে পিছিয়ে দেয়। এসব ছাড়াও সরিষার তেল বেশ ভালো মানের প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর প্রিজারভেটিভ। আচার সংরক্ষণে এর ব্যবহার আছে।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top