skip to Main Content

ফ্যাশন ট্রাভেল I হাতেকলমে ইন্দোনেশিয়ার বাটিক

বাটিকের জন্য ইন্দোনেশিয়ার প্রসিদ্ধি সুবিদিত। কাপড়ের এই শিল্পকলার ধ্রুপদি ও দুরূহ ধারার বিকাশ এখানেই ঘটেছে বলে মনে করা হয়। লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান

বাটিকের উদ্ভব কবে ও কোথায়, জানা যায় না। তবে অন্য অনেক কিছুর মতোই এর উপস্থিতির উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন মিসরে, চার হাজার বছর আগে। সে সময়ে কাপড় মোমে চুবিয়ে তারপর শুকিয়ে তাতে নানা নকশা করা হতো। আর সেই কাপড় দিয়ে মামি সংরক্ষণের রীতি ছিল সেখানে। এই পদ্ধতির আধুনিকায়ন ঘটেছে। নকশা করা ব্লক মোমে চুবিয়ে প্রিন্ট করা কাপড় ডাই করে নানা ডিজাইনের চল আজও আছে নানা দেশে। আমাদের দেশেও রয়েছে। এটাই বাটিক। একে ক্ল্যাসিকের পর্যায়ে উন্নীত করেছে কয়েকটি দেশ। ইন্দোনেশিয়া সেগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য।
ইতিহাসবিদদের মতে, সে দেশে বাটিকের উদ্ভব জাভা দ্বীপে। ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে। বাটিক শব্দটিও জাভানিজ। আম্বা অর্থাৎ লেখা আর তিতিক অর্থাৎ বিন্দু থেকে বাটিক শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। আবার অনেক ইতিহাসবিদ এই শব্দ প্রোটো-অস্ট্রোনেশিয়ান বলে থাকেন। সেই ভাষায় বেটিক মানে ট্যাটু। তবে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় শব্দটি প্রথম গ্রন্থিত হয় ১৮৮০ সালে। এই পদ্ধতিকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার কৃতিত্ব অবশ্যই জাভানিজদের। তারা সুতি কাপড়, মৌচাকের মোম আর গাছ ও লতাপাতা থেকে তৈরি প্রাকৃতিক রঙেই বাটিক করত। ইউরোপে এই কৌশল প্রথম লিপিবদ্ধ হয় ১৮১৭ সালে। চীন, জাপান, ভারত, শ্রীলঙ্কা আর আফ্রিকার নানা দেশেও বাটিক হয়ে থাকে।
ইন্দোনেশিয়ায় দুই ধরনের পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করা হয়। ব্লকপ্রিন্ট করে রঙ করার কথা আগেই বলা হয়েছে। তবে কাপড়ের ওপর বিশেষ কৌশলে মোম দিয়ে নকশা করে খালি জায়গায় নানা ধরনের রঙ করে সেটাকে একাধিক ধাপে বাটিক প্রিন্টে রূপান্তরের কাজটি ক্লাসিক বলে স্বীকৃত। কঠিনও বটে।
ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে বাটিকের পোশাক কিংবা কাপড় না কেনা মানুষ খুবই কম।
গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জাকার্তা আর পালেংবাঙে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এশিয়ান গেমস। বাংলাদেশ দলের প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে গেমস কভারের ফাঁকে বাটিক পণ্য কেনা হোক বা না হোক, বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হতে চেয়েছি। এই আগ্রহের কথা জানাই আমাদের ভলান্টিয়ার হারমিন সারিনাকে। এরপর সে খোঁজ নিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলে। দেখা এবং হাতেকলমে কাজের জন্য দেড় লাখ রুপায়া অর্থাৎ বাংলাদেশি ৯০০ টাকা দর্শনী দিতে হয়। এক সকালে জার্কাতা শহরের কেন্দ্র তানাহ আবাঙ থেকে মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরে পাল বাতু নামের এক জায়গায় হাজির হলাম। এখানে বাটিক প্রশিক্ষণের একাধিক কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রুমাহ বাটিক বেশ প্রসিদ্ধ। এখানে সারা বছর বাটিক শেখানো হয়। এই কেন্দ্রের বিশেষত্ব হচ্ছে মূক ও বধিরদের কাজ শিখিয়ে তাদের তৈরি বাটিকের কাপড় এবং বিভিন্ন পণ্য বিক্রির মাধ্যমে জীবিকার ব্যবস্থা করা। তাদের স্বনির্ভর করে তোলা।
রুমাহ বাটিক বস্তুত একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালনা করেন বুডি হারিয়ান্তো। হ্যারি নামেই তিনি পরিচিত। যা হোক, আমি আর হারমিন সেখানে পৌঁছে দেখি তাদের নিয়মিত কাজ চলছে। প্রথমে সাক্ষাৎ হয় বুডির সঙ্গে। তিনি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেখানে এক প্রশিক্ষার্থী অ্যাঞ্জেলের সঙ্গেও আলাপ হয়। ভালো ইংরেজি বলতে পারেন বলে পরবর্তী সময়ে আমাকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব অ্যাঞ্জেলের ওপর বর্তায়। সে জাকার্তার নয়। বিবিএ শেষ করে শখের বশে বাটিক শিখছে। তারপর নিজের শহরে চলে যাবে। সেখানে তার দাদুর গাড়ির ব্যবসা আছে। তাতে যোগ দেবে।
ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি কাপড়ের ওপর ঝুঁকে সবাই রঙ করতে ব্যস্ত। পাশে তিনটি বার্নারে মোম জ্বালানো হচ্ছে। অন্তত আধঘণ্টা জ্বালানোর পর সেই মোম কাপড়ে প্রয়োগ করতে হয়। এ জন্য রয়েছে একটি বিশেষ টুল। ওদের ভাষায় চ্যান্টিং। কাঠের হাতল। মাথায় পিতলের কনটেইনার; তাতে তরল মোম নিতে হয়। আর এর মাথায় হালকা বাঁকানো তার। অনেকটা শুঁয়োপোকার অ্যান্টেনার মতো। এটা দিয়েই নকশার ওপর মোম লাগাতে হয়।
আমিও তাদের সঙ্গে একটা টুলে বসে যাই। এক টুকরো কাপড় দেওয়া হয় আমাকেও। সেটা বাঁ হাতে রেখে চ্যান্টিং দিয়ে নকশার লাইনের ওপর মোম দিতে হয়। আর মোম একটু পরপর বদলে নিতে হয়। এই কাজ বেশ কঠিন। আর ক্লেশসাধ্যও বটে। অথচ তারা অনায়াসে নানা সাইজের কাপড়ে এই নকশা করে যাচ্ছে। আমিও চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু লাইন এঁকেবেঁকে যেতে থাকে। একপর্যায়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে হারমিনকে বলি আমাকে সাহায্যের জন্য। ওর অবশ্য স্কুলে থাকার সময় প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল। ফলে সে দ্রুতই কাজটা করে ফেলে। চ্যান্টিং দিয়ে মোম লাগানোর সময় গরম মোমে আমার বাঁ হাতের তালু পুড়েছে কয়েক জায়গায়।
এরপর দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় রঙ করা। হারমিন, অ্যাঞ্জেল এবং আরও দু-একজন নানা রঙের রঙ কটন বাডে লাগিয়ে মোম লাগানো অংশের বাইরে পুরো কাপড়ে নান্দনিকভাবে ভরিয়ে তোলে। এখানে যে রঙ করা হয়, তা কৃত্রিম। তবে প্রাকৃতিক রঙও ব্যবহার করা হয়। রঙ লাগানো শেষ হলে তা রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। দিনটা ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। তাই দ্রুত শুকিয়েও যায়। এটা ছিল তৃতীয় ধাপ। পরের ধাপে এই কাপড়কে সোডিয়াম সিলিকেটের দ্রবণে চুবিয়ে নিতে হয়। একে তারা ওয়াটার গ্লাস বলে। ওয়াটার গ্লাস ভালো করে কাপড়ের ওপর লাগানোর পর খানিক অপেক্ষা করে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নেওয়া হয়। এরপর গরম পানিতে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রেখে আবার ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। ততক্ষণে ডিজাইন ফুটে ওঠে। বাকিটা হলো রোদে শুকিয়ে নেওয়া। হয়ে গেল বাটিক। তবে আমি যে চ্যান্টিংয়ে কাজ করেছি, সেটা সহজ। তাতে ছিল একটি শুঁড়। আবার একাধিক শুঁড়ওয়ালা অ্যান্টেনাও আছে। দুইটা, তিনটা, পাঁচটা। খুব জটিল সব ডিজাইন সেসব চ্যান্টিংয়ে করা হয়। এক্সপার্ট না হলে কাজটি দুরূহ।

বাটিক শিল্পীদের সঙ্গে লেখক

এই বাটিকের কঠিন কাজটা হলো ডিজাইনের রেখা বরাবর মোম দিয়ে আউটলাইন করা। এর ওপরই নির্ভর করে বাটিকের সৌন্দর্য। কাজ কাঁচা হাতের নাকি পাকা হাতের, দেখেই বলে দেওয়া যায়। এই বাটিকের মূল্যও বেশি। সুতি ও সিল্ক দুই ধরনের কাপড়েই করা যায়। সেদিন আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দুই কর্মকর্তাও ছিলেন। তারা চাক্ষুষ করেন বিষয়টা। কিন্তু তাদের মিটিং থাকায় আগেই চলে যান। আর হারমিনকেও চলে যেতে হয়। আমি থেকে যাই কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। পরে একটি ট্যাক্সি ধরে চলে আসি মেইন প্রেস সেন্টারে। সঙ্গে ছিল চমৎকার এক অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে কারুশিল্প নিয়ে কাজ করছি বহুদিন ধরে। জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের একজন কর্মী হিসেবেও সক্রিয় আছি। মনে হয়েছে, এখান থেকে ট্রেনার নিয়ে এসে বাংলাদেশে এই বাটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় খুব ভালোভাবেই। দেখা যাক সেটা করা সম্ভব হয় কি না।
sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: লেখক ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top