skip to Main Content
বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষরে গায়ক উত্তম কুমার

আজ বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমারের মৃত্যুদিন। উত্তম কুমার শুধুই নায়ক নন, অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে তিনি তাঁর বহুমুখী প্রতিভার নিদর্শন রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুদিনে গায়ক উত্তম কুমারের জীবন নিয়ে লিখেছেন অতনু সিংহ

সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কলকাতা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেয়ানেয়া’ ছবিতে মুখ্য চরিত্র প্রশান্ত, শিল্পপতি বাবার আপত্তির কারণে লুকিয়ে গান করতেন। কিন্তু বন্ধুর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে প্রথমবার তাঁকে প্রকাশ্যে গান গাইতে হয়। সেই গান মন জয় করে নেয় মানুষের। এমনকি বাবার মনও। আর অদেখা গায়কের গান তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন শুচি নামের যে তরুণী, তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর অতিপরিচিত মানুষ প্রশান্তই আসলে সেই গায়ক। পরিণয়ে আবদ্ধ হন প্রশান্ত ও শুচি। আর প্রশান্ত চরিত্রে উত্তম কুমার ও শুচি চরিত্রে তনুজার সেই প্রেম দৃশ্যশ্রাব্যের কাহিনি ‘দেয়ানেয়া’ প্রবল জনপ্রিয় হয় বাঙালি দর্শকদের কাছে। উত্তম কুমারের লিপে শ্যামল মিত্রের সেই ‘গানের ভুবন ভরিয়ে দেবো’ আজও জনপ্রিয়। আজও জনপ্রিয় সেই দৃশ্য, মঞ্চে সরে যাওয়ার পর প্রশান্ত (উত্তম কুমার) গাইছেন, ‘যার গান শুনে একদিন/ কন্ঠে পরালে মালা/ আজ তোমাদের সভা হতে তার বিদায় নেওয়ার পালা/ ঝরে কত তারা আলোকে/ মনে রাখে বলো কে!’ কিন্তু প্রশান্তকে মনে রেখেছিল দর্শকেরা, আর মহানায়ক উত্তম কুমার আজও বাঙালির হৃদয়ে অম্লান।
পর্দায় মহানায়ক উত্তম কুমারের অভিনয়ে ও তাঁর নিখুঁত লিপসিঙ্কে বিখ্যাত সব সঙ্গীত শিল্পীর গানের দৃশ্য আজও কালজয়ী। কিন্তু মহানায়ক উত্তম কুমার বাস্তব জীবনেও অভিনয়ের পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চা করতেন, এটা বোধ হয় আজকের প্রজন্মের অনেকেই সেভাবে জানে না। উত্তম কুমার শুধু সঙ্গীতচর্চাই করতেন না, বরং অভিনয়ের মতোই সঙ্গীতেও তিনি ছিলেন পেশাদারি এক শিল্পী। মঞ্চে বহু অনুষ্ঠানে তিনি যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও রোম্যান্টিক বাংলা গান (যাকে বাংলা আধুনিক গান) পরিবেশন করেছেন। শুধু মঞ্চই নয়। বাংলা সিনেমায় সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত আয়োজক ও সুরকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে উত্তম কুমার।
‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘সব্যসাচী’ প্রভৃতি ছবিতে সুরকার হিসেবে অসাধারণ কাজ করেছেন উত্তম কুমার। ১৯৫৬ সালে নিজের অভিনীত ‘গৌরাঙ্গ’তে নচিকেতা ঘোষের সুরে গান মোট ৬টি গান গেয়েছিলেন উত্তম কুমার। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৬ সালে শচীন মুখার্জী পরিচালিত ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও সুরকার হিসেবে বহুবিধ ভূমিকায় দেখা যায় উত্তম কুমারকে। তাঁর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন, ‘যাই চলে যাই’, আর আশা ভোঁসলের কন্ঠে শোনা গিয়েছিল, দুটি গান- ‘আমার মনের মানুষ ফিরল ঘরে একটু বেশি রাতে’ এবং ‘পাতা কেটে চুল বেঁধে সে টায়রা পরেছে’।
চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করার আগে অরুণ চট্টোপাধ্যায় যখন উত্তম কুমার হয়ে ওঠেননি, তখন কলকাতা পোর্ট কমিশনার্সে চাকরির পাশাপাশি নিয়ম করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতেন শিল্পী নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অভিনয়জীবন শুরু করার আগে কলকাতার গিরীশ মুখোপাধ্যায় রোডে উত্তম কুমারের বাড়িতে নিয়মিত বসতো গান বাজনার আসর। সেখানে নানা গুণীজনের সমাবেশ হতো। অভিনয়জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর ক্রমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের মূল ধারায় নক্ষত্র হয়ে ওঠেন। তবে প্রায় ২১২টি ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছবির পরিচালনা ও প্রযোজনা করতেও দেখা গেছে উত্তম কুমারকে। পাশাপাশি গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। শোনা যায়, সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিটি উত্তম কুমারের জীবনের সাফল্য ও সাফল্যের ভিতরের অবসাদকে ঘিরেই- এ কথা নেহাত কথার কথা কি না জানা নেই, তবে সাফল্য ও কৃতিত্ব তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ঘিরেই। সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের শেষ জীবনের বিপর্যয়ে তিনিই বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের কয়েকটি ছবির প্রযোজনাও করতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি, ঋত্বিক বিদায় নিয়েছিলেন। ঋত্বিকের পাশে যখন কাউকেই সেভাবে পাওয়া যায়নি, তখন মেইনস্ট্রিম সিনেমার মহানায়ক সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছিলেন। অবশ্য তাঁকেও চলে যেতে হয়েছিল অকালেই, এমনই এক শ্রাবণের বর্ষণদিনে। আজও তাঁর বহুমুখী প্রতিভা অম্লান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top