skip to Main Content
tech-fashion-into

বিশেষ ফিচার I কর্মিশূন্য অগ্রগতি

প্রযুক্তি পোশাকশিল্পকেও গ্রাস করছে। কেননা এটি দখল করছে কর্মীর স্থান। দেখা দিচ্ছে বেকারত্বের শঙ্কা। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে যদি এমন সমস্যা দেখা দেয়? সমাধানের উপায় নিয়ে লিখেছেন মামুনুর রহমান

সকাল সাড়ে সাতটা; নভেম্বর, ২০১৭। হালকা শীতে আমি বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে। চোখ গেল শহুরে জট পাকানো গলিতে। একঝাঁক মানুষ সারি বেঁধে ছুটছে। পায়ে তাদের ত্বরিত গতি। বেশির ভাগই নারী। উদ্দেশ্য- কর্মক্ষেত্র, তৈরি পোশাক কারখানা। হ্যাঁ, এটিই বাণিজ্যিক এলাকার নিত্য সকালের চিত্র। কিন্তু সালটা যদি ২০১৭ না হয়ে ২০৩০ হতো, তাহলে কি এই চিত্র চোখে পড়ত? আমার উত্তর হচ্ছে, ‘না’। এই ‘না’-এর কারণ অটোমেশন। স্বয়ংক্রিয়তা। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মীদের বেকার হয়ে পড়ার বিষয়ে লিখতেই আজ হাতে কলম তুলে নেওয়া। ভয় নেই, শিগগিরই গার্মেন্টস কর্মীরা বেকার হয়ে পড়তে পারেন বলে যে পোশাক উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনটা নয়; বরং উৎপাদন আরও বাড়বে। এই যে কর্মী ছাড়াই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, একেই আমি বাংলায় সংজ্ঞায়িত করছি ‘কর্মিশূন্য অগ্রগতি’ হিসেবে। ইংরেজিতে যাকে বলা হচ্ছে ‘জবলেস গ্রোথ’।
কিন্তু এটি ঘটবে কীভাবে? কিসের মাধ্যমে? এখানে সেই অনুঘটকই হলো অটোমেশন। গার্মেন্টস সেক্টরে এমন সব মেশিনারিজ চলে আসবে, যা মানুষের মতো; কিন্তু মানুষের চেয়ে দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারবে। ইতিমধ্যে এমন ঘটনা ঘটছেও। বহুজাতিক জরিপ প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনজি অ্যান্ড কোম্পানির গত ১৫ বছরের টেক্সটাইলবিষয়ক সমীক্ষা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সেই সমীক্ষামতে, ২০৩০ সাল নাগাদ মোট গ্লোবাল ইকোনমি এক্সচেঞ্জ হবে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন। এতেই বোঝা যাচ্ছে উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু কর্মীর সংখ্যা বাড়বে কি? নাকি অটোমেশন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রভাবে কর্মীবিহীনভাবেই বৃদ্ধি পাবে উৎপাদন?
প্রতিবছর গার্মেন্টস সেক্টরে উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু কর্মীর সংখ্যা যা ছিল, তাই-ই আছে কিংবা কমছে; বাড়ছে না। তিন-চার বছর আগে গোটা বাংলাদেশে যে চার মিলিয়ন গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলেন, এখনো তাই। এমনকি সামনের বছর- চলতি বছরের তুলনায় গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে। দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে। কিন্তু কর্মীর সংখ্যা যেন ধ্রুবক হয়ে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় আটকে আছে।
এই জবলেস গ্রোথ বাড়তেই থাকবে; সমান্তরালে অটোমেশন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রভাবে একসময় পণ্য উৎপাদনে মানুষের প্রয়োজন পড়বে না। মেশিনই বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারবে, মানুষের চেয়ে কম সময়ে, কম খরচে। শঙ্কা জাগে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে প্রায় চার মিলিয়ন গার্মেন্টস শ্রমিক রয়েছেন, তাদের ভবিষ্যৎ কী? তারা তো বেকার হয়ে পড়বেন! এত বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান কোথায় হবে? এ ক্ষেত্রে আমরা কি প্রস্তুত? এ নিয়ে কি কোনো ভাবনা আমাদের আছে?
মাত্র এক যুগের ব্যবধানে এসব কর্মীর বেকার হয়ে যাওয়ার মতো মহাবিপদের ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে উদাসীনভাবে ঘুরছি আমরা। বিষয়টি মোটেও মামুলি নয়; হেলাফেলা করে উড়িয়ে দেওয়ারও মতো নয়। ঠিক এ মুহূর্ত থেকে তাদের বিষয়ে চিন্তা না করলে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর প্রস্তুতি ছাড়া এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই ভাবতে হবে বিকল্প পদ্ধতি কী হতে পারে। অধিকন্তু এসব কর্মী দীর্ঘদিন কেবল গার্মেন্টস সেক্টরেই কাজ করে যাচ্ছেন। তাই হুট করে তাদের অন্য পেশায় অন্তর্ভুক্ত করা বেশ কঠিন হবে। কেননা, তখন তাদের বয়সও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মহাযজ্ঞতুল্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি অন্য পেশায় অন্তর্ভুক্ত করাও হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের এত দিনের লব্ধ অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণটাই জলাঞ্জলি যাবে।
কিন্তু এই গার্মেন্টস তথা টেক্সটাইল খাতেই তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উপায় রয়েছে। কিন্তু কীভাবে? অটোমেশন কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যে বিপ্লবই ঘটাক না কেন, গার্মেন্টস থেকে ঝুট (বাতিল কাপড়) বের হওয়া কিন্তু বন্ধ হবে না। ঝুট ব্যবহার করেই তাদের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। সাধারণ একজন মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়- ঝুট দিয়ে কী কী করা যায়, বলুন তো? তিনি হয়তো বলবেন, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আরেকটু মাথা খাটিয়ে হয়তো বলতে পারেন, রুমাল তৈরি করা যায়। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, শুধু গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবহার করে এক হাজার রকমের বেশি পণ্য উৎপাদন সম্ভব। রুমাল ছাড়াও টুপি, টাই, হ্যান্ডিক্রাফটস, প্যান্টি ও হোম টেক্সটাইল তৈরি করা যায় ঝুট দিয়েই। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে ঝুটকে পুনর্ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে এই বৃহৎ অথচ দক্ষ জনশক্তিকে।

এটা করা গেলে ওই চার মিলিয়ন কর্মী ছাড়াও আরও অনেকের কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হবে। গার্মেন্টস শ্রমিকেরা তো বেকার হবেনই না, উল্টো তাদের মধ্য থেকে বের হয়ে আসবেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা। শ্রমিক থেকে তারা হয়ে উঠতে পারবেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মালিক।
ঝুটকে রিসাইকেল করে তারা গড়ে তুলতে পারবেন নতুন নতুন শিল্প। বাইরের দেশগুলোতে কিন্তু রিসাইকেলড পণ্যের বেশ কদর রয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের মালিক থেকে শুরু করে সরকার- এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা লক্ষ করা যায় না। অথচ বেকারত্ব একটি জাতির জন্য ভয়ংকর দুর্যোগতুল্য সমস্যা। কথায় আছে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। আসন্ন সংকট নিয়ে এখনই ভাবা উচিত। ঝুটের সম্ভাবনাময় সহস্রাধিক ব্যবহারের মধ্যে লো কস্ট স্যানিটারি ন্যাপকিন একটি; যা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তৈরি শুরু হয়েছে। ভারতীয় ছবি প্যাডম্যান নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত। অথচ আমাদের দেশেও যে কাজ হচ্ছে, সে খবর কে রাখে! বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। শিগগিরই এটি বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

লেখক: ডিজিএম, এসএমই ফাউন্ডেশন এবং হামফ্রে ফেলো, ডি-ল্যাব, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top