skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I খাদ্যসংযমের ইতিবৃত্ত

বেশি মুটিয়ে গেলে দেখা দেয় নানান অসুখ- এই ভাবনা আজকের নয়। প্রায় তিন শ বছর আগে, ইংল্যান্ডে স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পরিমিত আহারের পদ্ধতি চালু হয়েছিল। লিখেছেন শুভ্র মিসির

স্বাস্থ্যই যখন সকল সুখের মূল, তখন স্বাস্থ্যের প্রতি বাড়তি নজর না দিয়ে কি আছে উপায়! এই শরীর সুস্থ রাখতে আমাদের কতই না চেষ্টা। এত কিছুর পরও কি সুস্থ থাকতে পারছিÑ প্রশ্ন থেকেই যায়। খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই সুস্থ থাকতে পারি, মোটা দাগে এ কথায় সন্তুষ্ট হবেন অনেকেই। কিন্তু সুস্থ থাকার শর্ত, নিয়ম আমরা কতটা জানি এবং মানি?
শরীর যখন অসুখের কবলে পড়ে, সুস্থতা যখন আমাদের ছেড়ে পালায়Ñ ডাক্তার, ওষুধ আর নানা টেস্টে জীবন দুর্ভার হতে থাকে, তখন হয়তো মনে হয়- ইশ্, একটু নিয়ম যদি মেনে চলা যেতো! ঠিক তাই, চোর পালালেই তো বুদ্ধি আসে! অ্যানাটমির ভাষায়, আমাদের শরীর অনেকটা যন্ত্রের মতো। যন্ত্র যেমন সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করলে বিগড়ে যায়, তেমনি শরীরও।
সুস্থ থাকার প্রধান এক শর্ত হলো ‘ডায়েট’ বা পরিমিত আহার কিংবা বলা যায় খাদ্য সংযম। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পরিমিত আহারের কথা বলা হয়েছে। শরীরের জন্য উপকারী ও অপকারী দুই রকমের খাবার নিয়ে রয়েছে অজস্র বিধিনিষেধও। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করবেন ডায়েট? ডায়েট কি শুধু সুস্থতার জন্য, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কারণও!
এর উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে প্রায় তিন শ বছর পেছনে। আঠারো শতকের শুরুতে ডায়েট ডাক্তার, কম চর্বিযুক্ত খাবার, ব্যায়াম, ডায়েট চার্ট, ডায়েট পিলসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ইউরোপজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মনে করা হয়, ভিক্টোরিয়ান যুগেই (১৮৩৭-১৯০১) আধুনিক ডায়েট ব্যবস্থা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্থূলকায় মানুষেরা ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়- এটা বোঝার পরই ১৭৯৭ সালে স্কটিশ মিলিটারি সার্জন জন রোল্লোর ‘নোটস অব আ ডায়াবেটিক কেস’ প্রবন্ধে মিট ডায়েটের উপকারিতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। ব্রিটিশ ডাক্তার ম্যাথু ডবসন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের প্রস্রাবে গ্লুকোজের অত্যধিক উপস্থিতির কথা জানান। তবে আধুনিক সময়ের ডায়েটিশিয়ানদের মধ্যে জনপ্রিয়তম মানুষটি হলেন ইংরেজ ভদ্রলোক উইলিয়াম বেন্টিংক। ১৮৬৩ সালে তার ‘লেটার অন করপুলেন্স, অ্যাড্রেস টু দ্য পাবলিক’ পুস্তিকায় তিনি ডায়েট নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা বা ডায়েট প্ল্যান প্রণয়ন করেন। তিনি পরিমিতভাবে চার বেলা খাওয়ার কথা বলেন। তার খাদ্যতালিকায় ছিল মাংস, সবুজ শাকসবজি, ফল ও ড্রাই ওয়াইন। খাদ্যতালিকা থেকে তিনি চিনি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, ভাত, বিয়ার, দুধ ও বাটার বাদ দেন। এখনকার ডায়েট ব্যবস্থা বা ডায়েট প্ল্যান এসেছে তার হাত ধরেই। ১৮৬৩ সালে তার লেখা ওই ছোট্ট বইটির সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। ডায়েটের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রথম যে বইটি বেস্ট সেলারের মর্যাদা লাভ করে, সেটা কিন্তু আজ থেকে ১০০ বছর আগের। ক্যালরি কমিয়ে ওজন কমানোর চিন্তা থেকে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় আমেরিকান ডাক্তার ও কলামিস্ট লুলু হান্ট পিটারসের বই ‘ডায়েট অ্যান্ড হেলথ: উইথ কি টু দ্য ক্যালরিস’।
তবে এ সম্পর্কিত ভুলগুলো শুধরে দেবে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের অধ্যাপক ড. করিন্না ওয়েগনারের ‘প্যাথলজিক্যাল বডিজ’ বইটি। গবেষণাধর্মী এই বইয়ে লেখক দেখিয়েছেন, মধ্য ভিক্টোরিয়ান যুগে মুটিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে মানুষ একপ্রকার যুদ্ধই ঘোষণা করেছিল! ওজন কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন ছিল তাদের বিনোদনের মতোই! স্থূলতা কমিয়ে শরীরকে আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং আত্মসংযম নিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি ও বিতর্কেরও কমতি ছিল না। ডায়েটের পাশাপাশি সেই সময়ে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছিল সংযম ও খাদ্যের শৃঙ্খলার ওপর। অত্যধিক মোটা মানেই হলো আপনার নৈতিকতার অভাব আছে, আপনি দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং নিয়মের বাইরের একজন অসামাজিক মানুষ!
ড. করিন্না ওয়েগনার তার ‘প্যাথলজিক্যাল বডিজ’ বইটিতে দেখাতে চেয়েছেন, ভিক্টোরিয়ান যুগেরও আগে জর্জিয়ান যুগের (১৭১৪-১৮৩৭) শেষ দিকে মূলত মানুষ প্রথম মুটিয়ে যাওয়া সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ড. ওয়েগনারের ভাষ্য, ‘জর্জিয়ান যুগে ব্রিটেনজুড়ে মানুষদের মধ্যে ছিল বেশ আরামপ্রীতি, খাবারের প্রতি অত্যধিক মোহ, মদ্যপান এবং আনন্দ উপভোগের প্রবণতা, যেন তারা এসবের জন্যই বেঁচে আছে।’
তবে জর্জিয়ান যুগের মানুষদের এই অসংযত জীবন যাপন এবং মুটিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে প্রথম যে মানুষটি কাজ শুরু করেন, তার নাম জর্জ চেইনি। স্কটিশ এই চিকিৎসককে আধুনিক যুগের প্রথম ডায়েটিশিয়ান হিসেবে আখ্যা দেন স্বাস্থ্যবিদেরা। তিনিই প্রথম ডায়েট বা পরিমিত আহারের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আনার পদ্ধতি শুরু করেন।
ড. করিন্না ওয়েগনার লিখেছেন, তিনি তার খাদ্যতালিকা থেকে মদ ও মাংস বাদ দেন। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় ৩২ কেজি ওজন কমাতে সক্ষম হন। জর্জ চেইনি তার এই সফলতার গল্প বলেছেন ১৭৪০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ন্যাচারাল মেথড অব কিউরিং (সিক) দ্য ডিজিজ অব দ্য বডি অ্যান্ড দ্য ডিজঅর্ডার অব দ্য মাইন্ড’ শিরোনামের বইয়ে। চেইনি ডায়েটের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আয়ের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করে সমাজের ধনীদের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন। তিনিই হলেন প্রথম আধুনিক ডায়েট ডাক্তার। জর্জ চেইনির এই পদ্ধতি খুব সহজেই সফলতার মুখ দেখে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, ডায়েট ডাক্তার হিসেবে নতুন চিকিৎসা পেশারও প্রচলন ঘটে। ওজন কমিয়ে ফেলার অনুশীলন ফ্যাশনে পরিণত হয় তখনকার ব্রিটিশ সমাজে।
ড. ওয়েগনার তার বইয়ে আরও দেখাতে চেয়েছেন, ডায়েট সিস্টেমের প্রচলন যেমন চিকিৎসাব্যবস্থায় নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে, তেমনি এটি ব্রিটেনের রাজনীতিকেও দারুণ প্রভাবিত করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ডায়েটের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোথায়? এখানেই মূলত ড. ওয়েগনারের সফলতা। আর্থিকভাবে ও জীবনযাপনের দিক দিয়ে জর্জিয়ান সমাজের নিচু স্তরের মানুষদের সঙ্গে ওপরের মহলের বিস্তর ফারাকের ফলে অসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল সে সময়। পাশাপাশি ফরাসি বিপ্লবের যাত্রাকালে সবার মনে প্রশ্ন উঠেছিল, ব্রিটেন কি তার রাজত্ব এবং বিশ্বজোড়া আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে, নাকি ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে? এই চিন্তার প্রধান কারণ হলো, সে সময়কার রাজা চতুর্থ জর্জের অসংযত জীবনাচার, তার স্থূলকায় বিশাল দেহ এবং শাসনের অব্যবস্থাপনা। ড. ওয়েগনারের ভাষায়, ‘রাজা চতুর্থ জর্জের আনফিট শরীরই হলো তার অব্যবস্থায় পূর্ণ শাসনব্যবস্থার প্রতিরূপ। রসনায় তার প্রিয় ছিল পার্সিয়ান ও ফ্রেঞ্চ খাবার। এটা কোনোভাবেই দেশপ্রেমের উদাহরণ হতে পারে না। অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভ এবং এসব বিষয়ের ফলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটার সম্ভাবনা দারুণভাবে দেখা দেয়।’
সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যখন অস্থিরতা ঘনিয়ে আসতে থাকে, তখনই স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় এবং সচেতনতায় জর্জ চেইনির ডায়েট ব্যবস্থা কার্যকরভাবেই প্রভাব রাখে জর্জিয়ান সমাজে। পাশাপাশি রাজার পক্ষ থেকেও বিদেশি খাবার না খেয়ে দেশীয় খাবার গ্রহণের প্রতি জনগণকে উৎসাহিত করা হতে থাকে। রাজা চতুর্থ জর্জের শরীর নিয়ে চিন্তা ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবই মূলত সে যাত্রায় তাকে ও ব্রিটিশ রাজত্বকে রক্ষা করে। তার শাসন আমলের পরপরই শুরু হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ। ভিক্টোরিয়ান যুগের রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় জর্জিয়ান যুগের ডায়েট-বিষয়ক ভাবনাটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন ড. ওয়েগনার। এসব দেখেশুনে বলতেই হয়, ডায়েট শুধু শরীর সুস্থ রাখারই উপায় নয়, বরং এটা নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায়ও কম গুরুত্ব বহন করে না।
ডায়েটের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। ফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করে, শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন উপাদান রয়েছে যেসব খাবারে, সেসবের প্রতি আগ্রহ ও জ্ঞান- দুটোই রয়েছে অধিকাংশ মানুষের। তবু কখনো কখনো রসনার লোভ না সামলাতে পেরে মজার মজার খাবার খেয়ে মুটিয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে দেখা যায় অনেককে। তখন ডাক্তার, ডায়েট চার্ট, স্লিম পিল, মর্নিংওয়াকসহ কত কিছুই না করতে দেখা যায় তাদের।
সময় থাকতে সাবধান। বেশি মুটিয়ে গিয়ে রাজত্ব হয়তো হারাতে হবে না কিন্তু সবার চোখে আনফিট চিহ্নিত হতে নিশ্চয়ই কেউ চাইবেন না। সুতরাং, সুস্থ থাকতে হলে বা সুখে থাকতে হলে পরিমিত আহারের কোনো বিকল্প নেই।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top