skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I দুর্গাপূজার ভোজ পার্বণ

কলকাতায় দুর্গাপূজার দিনগুলো রসনার উৎসবে জমজমাট হয়ে ওঠে। দেবীর ভোগে বিচিত্র পদ তো আছেই, স্বাদসন্ধানীদের জন্য রেস্তোরাঁগুলোরও আয়োজনে বৈচিত্র্যের কমতি থাকে না। লিখেছেন পাঞ্চালি দত্ত

শরতের নীল আকাশে মেঘের ভেলা, কাশফুলের দুলুনি, দূর গ্রাম থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ জানান দিচ্ছে, পূজা আসার বাকি মাত্র দু-চার দিন। সব প্রস্তুতি শেষ। এবারে শুধু মাকে দেখার পালা মন ভরে। শহরে আলোর ঝলসানি, লাখ লাখ টাকার প্যান্ডেল, বিশাল মূর্তি, দোকানে উপচে পড়া ভিড় পূজার জৌলুশকে ভরিয়ে তোলে দশ হাত ভরে। কিন্তু গ্রাম-বাংলায়! হ্যাঁ, জৌলুশহীন হলেও যে মা সবার কাছে সমান, তাই তার আগমনের আনন্দ তাদের কাছে ধরা দেয় পূজা-প্রকৃতি-পরমাত্মার মেলবন্ধনে, শিশিরের ফোঁটায়, শিউলিগাছে, শরতের স্নিগ্ধ বাতাসে, শাপলা ফুলে, কাশবনে, দিঘির টলটলে জলে। গ্রাম-বাংলার এই সৌন্দর্য, অপার আনন্দ শহুরে আয়নায় বড়ই মলিন।
পৃথিবীতে যেকোনো উৎসবই হোক না কেন, প্রতিটি জাতির থাকে নিজস্ব কিছু নিয়ম এবং সেই সঙ্গে উৎসবকে আরও হৃদ্যতায় ভরিয়ে দিতে থাকে সেই অঞ্চলের ট্র্যাডিশনাল নানা রকম খাবার। খাবারের এই নিয়মকে কিন্তু কেউ শাসন কিংবা আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ করেনি। এমনটি গড়ে উঠেছে ভালোবাসার বন্ধনে, আশপাশের মানুষের সঙ্গে উৎসবকে ভাগ করার আনন্দে ধর্মীয় উৎসবটিও কিন্তু তাই। আমাদের পূজা-আর্চা, রীতি-নীতি, খাবার-দাবারÑ এ সবকিছুই গড়ে ওঠে আমরা কোথায়, কোন পরিবেশে আছি। যেমন গ্রাম-বাংলার নানা রকম ফল, খই, চিড়ে, মুড়কি, দুধ, দই, বাতাসা, বাড়িতে বানানো নারকেলের নাড়ু, ছানার সন্দেশ, ঘি, লুচি, সুজি, চাল…এ ধরনের গ্রামীণ সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে দেবদেবীকে পূজা করা হতো। এখন পর্যন্ত এই প্রথাই চলছে। দীর্ঘদিন ধরে হয়তো আমরাই অবচেতনে ঠিক করে ফেলেছি ঈশ্বরের প্রিয় খাবারগুলো। যেমন মা লক্ষ্মী, যিনি ধনদেবী, তিনি ভালোবাসেন ইক্ষু অর্থাৎ আখ। এ ছাড়া চিড়ে ও নারকেল কোরাও ওনার খুব প্রিয়। ঠিক তেমনি মাঘ মাসে সরস্বতীপূজার সময় খই দই দেবার নিয়ম রয়েছে দেবীকে। গোপালের প্রিয় নাড়ু, শিব ঠাকুরের বেল। একটা বিষয় লক্ষ করলে দেখা যায়, মৌসুমি ফলগুলোকেই সেই বিশেষ দিনের বিশেষ পূজার দেবতাকে নিবেদন করছি আমরা তাঁদের প্রিয় ফল বলে। অর্থাৎ প্রকৃতি আমাদের জন্য যখন যে ফল উপহার দেয়, সেগুলোই ঈশ্বরকে উৎসর্গ করি। হয়তো তাঁর সৃষ্টিকে সম্মান ও ভালোবাসা জানানোর উদ্দেশ্যেই এই নিবেদন।
এবারে আসি দুর্গা মায়ের মর্ত্যে আসার গল্পে। আমাদের বিশ্বাস যে শরতে মা আসেন আমাদের মাঝে। অর্থাৎ তাঁর বাবার বাড়ি ঘুরতে আসেন চারটে দিনের জন্য। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী। দশমীতে তিনি আবার ফিরে যান স্বামীগৃহে। এই কদিন আমরা মাকে কীভাবে আদর-যতœ করব, সেই আনন্দে মাতোয়ারা। নিজেরাও নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে, নাচে-গানে মায়ের চরণে অর্পণ করি শ্রদ্ধা। আর খাবার! নানা রকম রান্না করে মাকে ভোগ দেওয়া হয়। সঙ্গে আমাদেরও ভূরিভোজ চলে এই কটা দিন। বাড়িতে কী খাব, কোন রেস্তোরাঁয় কী খাব- এই নিয়ে শুরু হয় প্ল্যানিং। তবে মজার ব্যাপার হলো, তখন মন ও রসনা শুধুই চায় ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো। সেসব নিয়ে আলোচনা করার আগে দুর্গা মায়ের ভোগের কিছু গল্প না করলে লেখার সার্থকতা থাকবে না। মায়ের উদ্দেশে যখন এই ভোগ আমরা তৈরি করি, তার যে স্বাদ, আমরা হাজার চেষ্টা করলেও যখন নিজেদের জন্য রাঁধি, সেই স্বাদ হয় না। এ এক অদ্ভুত বিষয়। এগুলোর কোনো যুক্তি হয় না। পূজার এই কদিন নানা রকম ব্যঞ্জনের আয়োজন করা হয়। সপ্তমীর সকালে থাকে নানা রকম ফল, মিষ্টি, চালের নৈবেদ্য, সুজি। দুপুরে ভোগ দেওয়া হয় খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। আর রাতে থাকে নানা রকম ফল, মিষ্টি, দুধ, সাবু, মিছরি ইত্যাদি। অষ্টমীতে সকালের মেনু প্রায় একই রকম। তবে দুপুরের খাবার পাল্টে যায়। মহাষ্টমী বলে কথা! সেদিন সাধারণত ভোগ দেওয়া হয় পোলাও, ছানার কালিয়া, ধোঁকার ডালনা, আলুর দম, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। অষ্টমীতে কিন্তু দুবার অন্ন ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপূজার পর আবারও ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপূজা হলো ঠিক সেই মুহূর্ত যখন দেবী দুর্গা অসুরকে নিধন করেছিলেন। অতঃপর, যাগ যজ্ঞ, আরতি ইত্যাদির পর অন্ন ভোগে দেওয়া হয় খিচুড়ি, ভাজা, সবজি, পায়েস ইত্যাদি। নবমীর দিন ভোগ দেওয়া হয় সাদা ঝরঝরে ভাত, বাঁধাকপির ঘণ্ট, ফুলকপির ডালনা ইত্যাদি। তবে মেনু যার যেমন ইচ্ছে, সে সেভাবেই ঠিক করে। কোনো বাঁধাধরা নেই যে বিশেষ দিনে বিশেষ খাবারটি দিতে হবে। তবে ভোগ হয় একেবারে খাঁটি বাঙালিয়ানায়। চাটনি ও মিষ্টি কিন্তু এক্কেবারে ফিক্সড এই তিন দিনই। বিশ্বায়নও এই ভোগের কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। চিরাচরিত ভোগের পরিবর্তে মন যদিওবা কখনো মেনে নেয় অন্য ধরনের ভোগÑ রসনা বিদ্রোহ করবে, এ কিন্তু ধ্রুব সত্য।
আমরা জানি রাজা সুরথের আমল থেকে শুরু করে কালক্রমে জমিদার বাড়িতে গান, বাজনা, বাইজি নাচ, খাওয়াদাওয়া, দান ধ্যানসহ জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করা হতো দুর্গোৎসব। তবে বনেদি বাড়িগুলো পূজার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য থেকে সরে গিয়েছিল অনেকটাই। ইংরেজদের তোষামোদ করা, ধনের গরিমা প্রকাশ, বংশমর্যাদা, দেদার টাকা ব্যয় করে আত্মগরিমা দেখানো…এসব হয়ে গেল প্রধান। সমাজের উচ্চবর্ণের শ্রেণিরা একমাত্র এই পূজায় আসার আমন্ত্রণপত্র পেল। ফলে অন্য স্তরের মানুষেরা পূজার এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত রইল। অতএব, তারাও এই আনন্দে শামিল হতে সবাই মিলে চাঁদা তুলে শুরু করলেন পূজা এবং সেটাই হয়ে যায় পরবর্তীকালে সর্বজনীন শারদীয়া পূজা। উত্তর কলকাতা এবং দক্ষিণ কলকাতার বনেদি বাড়ির পূজাতে একটু অমিল রয়েছে। তার প্রথম অমিল হলো, উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়িগুলো বিশ্বাস করে যে যেহেতু তারা ব্রাহ্মণ নয়, তাই অন্ন ভোগ মাকে নিবেদন করা যায় না। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার বনেদি বাড়ি আবার সেই রীতিতে বিশ্বাসী নন। যেমন সাবর্ণ বনেদি বাড়ির পূজায় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, পোলাও, ইলিশ মাছ, পোনা মাছ এ ধরনের খাবার দেওয়া হয়। বলে রাখি, যারা শাক্ত মতে পূজা করেন, তারা ভোগে আমিষ জাতীয় খাবার রাখেন। কিন্তু যারা বৈষ্ণব প্রথায় পূজা করেন, তারা শুদ্ধ নিরামিষ আহার মাকে সাজিয়ে দেন। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির আরেকটি বিশেষত্ব হলো বিজয়া দশমী অর্থাৎ যেদিন মা ফিরে যাবেন তার স্বামীর বাড়ি, সেদিন পান্তাভাত দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে কচুশাক। নবমী রাতে তৈরি করে রাখা হয়। কারণ, পরদিন মায়ের সঙ্গে সারা দিন কাটিয়ে তাকে স্বামীর বাড়িতে পাঠাতে হবে। বিপুল ধনসম্পত্তির অধিকারী জমিদার বাড়ি শোভাবাজার রাজবাড়ির কথা না উল্লেখ করলেই নয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজা শুরু হয়। উত্তর কলকাতা, তাই এখানে অন্ন ভোগ দেওয়ার রীতি নেই। ফল, চাল (কাঁচা) নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভিয়েন বসানো হয়। নানা রকম মিষ্টি প্রস্তুত করে মাকে দেওয়া হয় ভোগ, যেমনÑ গজা, দরবেশ, পানতোয়া, পক্কনী, চন্দ্রপুলি, বালুসাই, রধবল্লভি, কচুরি, শিঙাড়া, নিমকি, ক্ষীর তক্তি, লবঙ্গ লতিকা, পেরাকি, মতিচুর, জিভে গজা, ডুমো গজা, জিলাপি ইত্যাদি। অনেক মিষ্টি কারিগরের অভাবে এখন আর করা হয় না। যেমন- চাঁদ সই, মগধ, সমেশা, খুরমা, পুর কান্তি। লাহা বাড়িতেও অন্ন ভোগ নেই। ভিয়েন এখানেও পূজার এই কদিন তৈরি করে নানা রকম মিষ্টি। তবে লাহাবাড়িতে পূজার এ কদিন সবাই নিরামিষ আহার করেন।
যেহেতু উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির লোকেরা মাকে অন্ন ভোগ রেঁধে দেন না, তাই বিপুল পরিমাণ কাঁচা চাল, ডাল দেবার রীতি রয়েছে।
এবারে চলে আসি রেস্তোরাঁর গল্পে। পূজার সময় রেস্তোরাঁয় তিল ধারণের জায়গা থাকে না। বিশেষত রাতে সবাই রেস্তোরাঁয় খেতে পছন্দ করে। নানা রকম কুজিন থাকলেও সেই সময় প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁ চেষ্টা করে ট্র্যাডিশনাল বাঙালি মেনু রাখতে। অনেক রেস্তোরাঁয় বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে মাটির পাত্রে খাবার পরিবেশন করে, আবার কিছু রেস্তোরাঁ ব্যবস্থা করে কাঁসার বাসনে। বাঙালি খাবারের তখন বেশি চাহিদা থাকে। তাই সেই সুবিধার্থে রেস্তোরাঁয় থাকে থালি এবং বুফের ব্যবস্থা। আইটেমের মধ্যে থাকে শুক্ত, ছোলার ডাল, মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, ঝুরি আলু ভাজা, আলু পোস্ত, ছানার কোফতা কারি, মুড়িঘণ্ট, মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক, রুই কালিয়া, পাবদার ঝোল, চিংড়ির মালাইকারি, চিতল মাছের মুইথ্যা, পাঁঠার মাংস, মুরগির ঝোল, চাটনি, দই, মিষ্টি। তবে রেস্তোরাঁ অনুযায়ী একটু-আধটু পাল্টে যায় মেনু। জুড়ে যায় আরও অনেক বাঙালি রান্না।
যেকোনো উৎসব রসনা ছাড়া হয় না। বিশেষত এ ব্যাপারে এপার-ওপার বাংলা সমানে সমানে গোল দিয়ে চলে। পূজার এই কটা দিন যখন রাতের বেলা সব আনন্দ, ঘোরা, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পরিবারের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসি, তখনো কিন্তু আমরা আড্ডার সঙ্গত হিসেবে মুখে পুরতে থাকি ‘পান’। আহা, নরম মোলায়েম পান, তার গায়ে যতœ করে লাগানো থাকে খয়ার, তারপর সুগন্ধিযুক্ত নানা রকম মসলা, এলাচি, সুপারি…গল্পের আমেজটাই যেন পাল্টে যায়! গ্রাম-বাংলার পুকুরপাড়ের সারি সারি সুপারিগাছের ছায়ার খেলা পুকুর জলে দেখার আর সুযোগ হয় না…কিন্তু এই পূজা যেন একটু করে হলেও সবকিছুকে ফিরিয়ে দেয় এই কটা দিন। তাই তো অপেক্ষায় থাকি। আসছে বছর আবার হবে।

লেখক: কলকাতার হ্যাংলা হেঁশেলের সাংবাদিক
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top