skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I প্রকৃতির বরপুত্র

ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বসে দেখতেন, কী করে সেলাইয়ের ফোঁড়ে সাদা অথবা রঙিন কাপড়ের জমিনে ফুটে ওঠে জীবন। সেখান থেকে শেখার ইচ্ছে। পরে সেটাই হয়ে যায় ধ্যানজ্ঞান। উন্নীত করেন শিল্পের পর্যায়ে। তাঁর সূচিকর্ম করা পোশাক পরেছেন সুপারমডেলরা। সেসব ছাপা হয়েছে ভোগসহ অন্যান্য বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিনে। ঝিনাইদহ ঘুরে এসে, একাধারে সূচিশিল্পী আর প্রকৃতিপ্রেমিকের প্রতিকৃতি বর্ণমালায় মূর্ত করেছেন জুনেদ আহমাদ মুহতাসিম মিশাল

আমিনুল ইসলাম। প্রকৃতির বরপুত্র বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। তাঁর হাতে যেমন কাপড়ের উপর মূর্ত হয় নানা নকশা, তেমনি তাঁর স্পর্শের আদুরে আহ্লাদে নেচে ওঠে সবুজ। ঢাকায় তাঁর আবাসখানি সবুজে সাজানো। তবে ইট-কাঠ-পাথরের এই শহরে নয়, তাঁর মন পড়ে থাকে গ্রামে। ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। সেখানে ছুটে যান তিনি সময় পেলেই। একটা স্বপ্নের বাগান করেছেন সেখানে। ভরিয়ে তুলেছেন দেশি-বিদেশি গাছে। ফুল-ফল-ঔষধি সবই আছে। নিজের এমন একটা বাগানের স্বপ্ন তিনি দেখতেন ছোটবেলায়। যেখানে থাকবে সারি সারি গাছ, অগণন ফুল বিছানো থাকবে চাদরের মতো। তাতে দেখা যাবে পাখিদের ওড়াওড়ি।
ছোটবেলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসতেন ফুলের গাছ। বাড়ির সামনে নিজের মতো করে খানিকটা জায়গা নিয়ে সাজাতেন নিজের ছোট্ট স্বপ্ন। তাতে প্রকাশ করতেন গাছের প্রতি ভালোবাসা। এই আবেগ আকার পেতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকে। ঝিনাইদহের শৈলকুপায় নিজেদের পুরোনো ভিটেবাড়ির পাশে আট বিঘা জায়গা কিনে নিয়ে শুরু করেন কাজ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছ সংগ্রহের কাজে হাত দেন। বিভিন্ন প্রজাতির কিংবা একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন ধরন এক জায়গায় এনে সাজানো শুরু করেন।
ঝিনাইদহ মোড়ে একটা সুন্দর ফুলের গাছ ছিল। দেখতে খুব ভালো লাগত। প্রতিবার ভাবতেন, যদি এই গাছের একটা চারা পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুদিন পরে নগরের উন্নয়নকাজের জন্য গাছটা কেটে ফেলা হলো। এই ঘটনা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। খোঁজা শুরু করলেন সেই গাছ। কিন্তু গাছের নামটা জানা ছিল না। বেশ কিছুদিন খোঁজার পর বের হলো, সেই গাছ আছে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ক্যাম্পাসে। এরপর অনুমতি নিয়ে সেই গাছের কলমের চারা তৈরি করে এনে লাগালেন নিজের বাগানে। জানতে পেরেছিলেন, গাছটির নাম কূটরাজ।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার চাঁদপুর গ্রামে আমিনুল ইসলামের স্বপ্নবাগান ঘেরা বাড়ির মূল ফটক দেখে কোনোভাবেই মনে হবে না, গ্রামের বাড়িতে আসা হয়েছে। মূল ফটকের দেয়ালের শুরু যেখানে, সেখান থেকে গাছের সমারোহ দেখা যায়। বাড়ির বাইরের দেয়াল আর রাস্তাজুড়ে গাছের সারি। নানা ফুল ও গাছ রাস্তাকে ঢেকে যেন আলাদা এক মোহময় আবহের সৃষ্টি করছে। মূল ফটকের উপর থেকে ঝুলছে নানা ধরনের ফুলের গাছ আর ক্যাকটাসের সারি।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সবুজের পাহাড়। সুন্দর করে সাজিয়েছেন আমিনুল ইসলাম। তিনতলা শহুরে বাড়ির পুরো দেয়ালজুড়ে কার্পেটিং লতা বেয়ে উঠেছে। সামনে বিশাল বাগানে বিছিয়ে রাখা হয়েছে ফুলের চাদর। লাল-হলুদ-সবুজে চোখ যেন সরতে চায় না। মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় শহুরে সব যান্ত্রিকতা। আনন্দে ভরে ওঠে হৃদয়।
‘আমি শহরকে নিয়ে এসেছি গ্রামে; আর গ্রামকে নিয়ে গিয়েছি শহরে।’ বললেন আমিনুল ইসলাম।
এ বাড়ির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো পাখি। না, কোনো পোষা পাখি নয়। নানা ধরনের পাখি এখানে এসে বাসা বাঁধে। খুব ভোর থেকে শুরু হয় তাদের ডাকাডাকি। পাখির ডাকেই ঘুম ভেঙে যায়। এদের মধ্যে চোখে পড়ে মুনিয়া, কানাকুও, শালিক, ঘুঘু, ময়না ইত্যাদি।
বাড়িতে ঢোকার পথেই একটা পুকুর আছে। পুকুরের চারপাশে আছে নানা ধরনের গাছ। এসব গাছ যেমন ফুলের, তেমনি ফলেরও। অথচ বাদ যায়নি ছোট্ট পান পরাগের গাছটিও। পুকুরে মাছ আছে পাঁচমিশালি। এলাকার হাওরে ধরা মাছ এনে ছাড়া হয় পুকুরে।
তিনতলা এই বাড়ির ভেতরের সাজ একদম আলাদা। থাকার ঘর দ্বিতীয় তলায়। সেখানে গ্রিল দেয়া খোলা বারান্দা, সামনে ছোট ছাদ আর দুদিকে সানশেড বেয়ে বেড়ে ওঠা লতা। সানশেডেও বাগান আছে। মূলত এই বাগানের সার্থকতা হলো, এখানে সব কামরার জানালার সামনে একটা ফুল গাছ আছে। এই যেমন বেলি কিংবা কামিনী। সেখান থেকে ঝুলে পড়া ড্রাগন চেরির গাছ। রাতের এসব ফুলের ম-ম গন্ধ মাতাল করে দেয় দেহমন। মনে আসে: ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না/ একলা জেগে রই’।
তিনতলার সাজ একদম আলাদা। সেখানে রান্নাঘর আর খাবার ঘর। দুপাশে খোলা ছাদ। আর ছাদজুড়ে আছে সারি সারি গাছ। আছে বিভিন্ন জাতের কলমের আমগাছ। পাশে ড্রাগন আই, পিচ, বিভিন্ন জাতের বেরি, লিচু, জামরুল ইত্যাদি। আছে ছোট্ট চায়নিজ বাঁশের ঝাড়। মাঝের খাবার ঘরের সামনে লাগানো ফুলের সারি। এসবই লাগানো হয়েছে বাইরের দিকটায়। অর্থাৎ বাড়ির বাইরের সানশেডটায় লম্বা একটা কংক্রিটের টব ডিজাইন করা হয়েছে। সেখানে মাটি ভরে লাগানো হয়েছে গাছ।
আমিনুল ইসলাম গাছ সংগ্রহের জন্য ঘুরেছেন বিভিন্ন জায়গায়। দেশে কিংবা বিদেশে যখন কোনো কাজে বা ঘুরতে গিয়েছেন, ফিরেছেন কোনো না কোনো গাছ নিয়ে। অপেক্ষাও করতে হয়েছে কোনো কোনো গাছের জন্য। যেমন বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট চৌবাচ্চা আছে, সেখানে আছে আমাজন লিলি। গাছটা পাওয়া যায় বাংলাদেশের বলধা গার্ডেনেই। সেখান থেকে চাইলেই গাছ আনা যায় না। তিনি অনেক দরজা ঘুরেছেন এর জন্য। অবশেষে পেয়েছেন এর একটি চারা। গাছের পাতাটার উপরটা দেখতে শাপলা ফুলের মতো। কিন্তু নিচের দিকটায় রয়েছে অসংখ্য কাঁটা। এর পাতাগুলো বর্ষাকালে ভারী হয় এবং বেশ বড়ও হয়। এই সময় তিনি সকালের নাশতাটা এর উপরেই করেন।
আমিনুল ইসলাম নিজের প্রচেষ্টায় খুঁজে বের করেছেন হারিয়ে যাওয়া বা বিলুপ্তপ্রায় সব গাছ। তাঁরই আগ্রহের কারণে আজ অনেক বিলুপ্ত প্রজাতির উদ্ভিদ বেঁচে আছে এই স্বপ্নের বাগানে।
‘ছোট ছোট পরিকল্পনা নিই। লেগে থাকি। সেগুলো ক্রমে আকার পায়। স্বপ্ন পূরণ হলে অদ্ভুত তৃপ্তি পাই।’ কথায় কথায় নিজের এই অনুভব ব্যক্ত করছিলেন।
তাঁর বাগানে আছে কেশিয়া, কৃষ্ণচূড়া, নাগলিঙ্গম (এই গাছের গা বেয়ে ফুল ফোটে), ছয় ধরনের অশোক, হলুদ-সাদা-লাল পলাশ, হলুদ-সাদা-লাল-গোলাপি-ম্যাজেন্টা কাঞ্চন, তিন থেকে চার রঙের গন্ধরাজ, কূটরাজ, অপরাজিতা, নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী, পাম, মল্লিকা, ছাতিম, পাকুড়, ভেলভেট চেরি, কামিনী ইত্যাদি। আছে নানা ধরনের পাতাবাহার; সঙ্গে আছে রিঠা, রক্ত ও শ্বেত চন্দন। আর ফলের গাছের তো কথাই নেই। রয়েছে আম, জাম, লিচু, ড্রাগন আই, জামরুল, পিচ, নানা জাতের বেরি, সফেদা, জলপাই, কামরাঙা, ডালিম, পেঁপে ইত্যাদি।
‘ছোটবেলায় আব্বা বলতেন, যেন আমার ছোট ফুলবাগানে কিছু সবজির গাছ লাগাই। তখন আব্বার কথা সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও আজ নিজের এই বাগানে সেটা করছি।’ আমিনুল ইসলামের এই বাগানঘেরা বাড়ি গ্রামীণ সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাচ্চারা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একবার ঢুকে দেখে যায়। মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে মানুষ আসে কেবল তার বাড়ির ভেতরে বাগান দেখার জন্য। আমিনুল ইসলাম নিজের বাড়ির বাইরেও, গ্রামের রাস্তার দুই পাশে লাগিয়েছেন অসংখ্য গাছ। তার মতে, এতে পুরো গ্রামেরই শোভা বাড়বে। নিজের গ্রামটাকে দৃষ্টিনন্দন বাগানে পরিণত করতে চান তিনি। সবাইকে সম্পৃক্ত করতে চান তাঁর স্বপ্নে।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top