skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I প্রাচীন ভারতের ভাস্কর্যে অলংকার

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ভাস্কর্যে অলংকারের উপস্থিতি স্পষ্ট। খাজুরাহের মন্দিরগাত্রের ফলকে সেসব নিদর্শন থেকেই সাজসজ্জার ইতিহাসের আকর খুঁজেছেন শৌভিক দাস

ভারতের মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহ নামের গ্রামটিতে প্রায় এক হাজার বছর আগে চান্ডেলা রাজবংশের রাজারা বেশ কিছু অনন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এ ধরনের স্থাপনা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই এই মন্দিরের গায়ে খোদাই করা ভাস্কর্যগুলোর ছবি বিভিন্ন বইতে (পড়ুন বড়দের বই) দেখা যেত। যেট একসময় আমরা লুকিয়ে দেখতাম।

লুকিয়ে দেখতে হতো সংগত কারণেই। ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু ছোটদের উপযোগী ছিল না। অন্তত বাঙালি মূল্যবোধের মাপকাঠিতে। ঋষি বাৎস্যায়ন প্রণীত কামশাস্ত্রে সকল বাঙালি সুদক্ষ হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, এ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন পন্থায় শিক্ষা গ্রহণ করতে যতেক কুণ্ঠা। আমার কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এই ভাস্কর্যগুলো নিয়ে ছিল অসীম কৌতূহল! কেন এগুলো বানানো হলো? কীভাবেই-বা সেগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেল, তা তৎকালীন সংরক্ষণশীল সমাজে? এ রকম নানা প্রশ্ন নিরুত্তর থেকে গেছে আশৈশব। উত্তর খুঁজতে স্বয়ং খাজুরাহে উপস্থিত হয়েও বিশেষ লাভ হলো না। শিল্পগুণ ও উৎকর্ষের অসীম উচ্চতায় হাজার বছরের ঝড়ঝাপটা সামলে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল দেউলগুলোকে ঘিরে এখনো প্রচুর কুসংস্কার ও গুজব প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, সনাতন ধর্মকে ছোট করে দেখানোর জন্য আক্রমণকারী ভিনদেশি রাজশক্তি এসব ভাস্কর্য গড়েছেন। তাতে অবশ্য গৌরব কিছু কমেছে বলে মনে হয় না। কারও কারও মতে, বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক রোষ থেকে মন্দিরকে বাঁচাতে এই ব্যবস্থা। এই মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন ছাত্রের সঙ্গে আলাপ হলো, যার থিওরিটা বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তার মতে, এই ভাস্কর্যগুলোতে বজ্রযানি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাব থাকতে পারে। তান্ত্রিক যোগীরা শারীরিক মিলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব সন্ধানের চেষ্টা করেন। আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, তবে নেপাল ও ভুটানে পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন-মূর্তি আমি দেখেছি। আরেকটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, আজ থেকে এক হাজার বছর আগে, যখন সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগী হয়ে সত্যের সন্ধানে যুবকেরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ছিলেন, অথবা শংকরাচার্যের আদর্শে ব্রহ্মচর্য পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন, তখন সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে এবং প্রজন্মপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে একধরনের রতি-উৎসব প্রচলন করা হয়। এই উপমহাদেশে রতি-উৎসব নতুন কিছু নয়। এরই আরেকটি রূপ স্বয়ম্বরা উৎসব এখনো উত্তর-পূর্ব ভারত, বর্মা, শ্যামদেশে (থাইল্যান্ড) আয়োজিত হয়; যেখানে বিবাহযোগ্য যুবক-যুবতীরা জল-উৎসবের মাধ্যমে তাদের পছন্দের পাত্র-পাত্রীকে মনোনীত করেন। এই রতি-উৎসবের জন্য অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন হয়েছিল রতি-মন্দিরের। এই মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় যে মন্দিরের ভেতরে আসলে বিশেষ কিছুই নেই। স্থানও বেশ স্বল্প। মূল আয়োজনটা নিশ্চয়ই মন্দিরের বাইরেই হতো। কাছাকাছি সময়ে ঋষি বাৎস্যায়নের জগৎ বিখ্যাত শাস্ত্রটিও প্রণীত হয়। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ বিষয়টি নিয়ে ঋষি বাৎস্যায়নের পূর্বে এত উন্নত ও বিজ্ঞানবোধসম্পন্ন গবেষণা পৃথিবীতে আর কেউ করেছেন বলে জানা যায়নি। এই শাস্ত্রে, মূল ক্রীড়া শুরুর আগে শৃঙ্গার বা ক্রীড়ার প্রস্তুতিকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এই ধারণার অনেকগুলো স্তর রয়েছে, যা সহজ করে বলা সহজ নয়। তারপরও যারা মূল শাস্ত্রটি পড়ার সময়-সাহস পাবেন না, তাদের জন্য সহজ করে আমরা এই ধাপটিকে সাজসজ্জা বলতে পারি।
ভাস্কর্যগুলোতে স্পষ্ট লক্ষ করা যায়, সাজসজ্জাকে এখানে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাচীন সমাজে নির্মিত এসব ভাস্কর্যে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কেশবিন্যাস, বস্ত্র পরিকল্পনা এবং অলংকারের সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে যখন ব্যাংক ব্যবস্থা ছিল না না, তখন মানুষ স্বর্ণালংকার গড়ে সেটিকে সম্পদ হিসেবে সঞ্চিত রাখত। তাই প্রাচীনকালে অলংকারের নকশার চেয়েও অলংকারের ওজনের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। লোকসমাজে তাই মোটা মোটা ডিজাইনের অলংকার অনেক দেখা যায়। বর্তমানেও অনেক বিত্তবান স্ত্রীকে দেখি বিশাল আকৃতির অলংকার পরে বেড়াতে যেতে। যেখানে সৌন্দর্যের চেয়ে সম্পদের প্রদর্শনটাই মুখ্য। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, এই ভাস্কর্যের সুতনুকাদের অলংকারগুলো তাদের বিভিন্ন অঙ্গের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, অলংকারকে সেখানে আধুনিক সময়ের মতো সৌন্দর্যের উপলক্ষ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে, সম্পদের স্থূল প্রদর্শনের জন্য নয়।
তখনকার দিনে নারী-পুরুষ উভয়ের দীর্ঘকেশী ছিল; তবে কেশবিন্যাসে নারীরা ছিলেন অনন্য। আশ্চর্য হয়ে দেখি, বাঁশি বাজাচ্ছেন
যিনি তার হাতের দিকেই দর্শকের মনোযোগ থাকবে, তাই তার হাতের জন্য একটি বিশেষ অলংকার ডিজাইন করা হয়েছে, যা আর কারও নেই। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার জন্য অনন্য ডিজাইন করা হতো! কণ্ঠের অলংকারের সঙ্গে মিলিয়ে হাত ও বাহুর অলংকার সৃজন করা হতো। এখনকার যুগের ম্যাচ করে পরা অলংকারের মতোই ব্যবহৃত সব অলংকারের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করা হতো। যেমন কণ্ঠে শুধু মুক্তোর মালা পরলে হাতের বাজুবন্ধটা (ব্রেসলেট) ছিল শুধু মুক্তোর। আবার স্বর্ণ বা অন্য ধাতুনির্মিত কণ্ঠের অলংকারের নকশার সঙ্গে বাহুবন্ধ বা তাগার নকশার সুচিন্তিত সামঞ্জস্য থেকে বোঝা যায় যে হাজার বছর আগেও মানুষের রুচিবোধ এখনকার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। কর্ণের কুন্তল, হাতের বলয় (বালা), কটিবন্ধ (বিছা) এবং বক্ষজুড়ে দুলতে থাকা মালিকাসহ সব অলংকারেই উচ্চ রুচিবোধের ছাপ স্পষ্ট। যুগলেরাও পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্য করেই অলংকার পরতেন। আজকাল যেভাবে কাপল ড্রেস পরে থাকে।
প্রাচীন ভারতের নারীদের প্রসাধনের বিষয়েও বেশ কিছু আভাস পাওয়া যায় এই ভাস্কর্যগুলোতে। প্রসাধনের সময় দর্পণের ব্যবহার হাজার বছর আগেও ছিল, সেটা দেখে খুব একটা আশ্চর্য হইনি। আশ্চর্য হলাম উত্তল দর্পণের ব্যবহার দেখে। পদার্থবিজ্ঞানের আলোর প্রতিফলন বিষয়ে আগ্রহ থাকলে আপনি জানবেন যে উত্তল দর্পণের সবকিছু বড় করে দেখা যায়। এ কারণে আধুনিক যুগেও উন্নত মানের আয়নাগুলোর দুই পাশে দুই রকমের কাচ থাকে। হাজার বছর আগে একটি গ্রামে সেই একই প্রযুক্তির প্রচলন ছিল।
ভাস্কর্যগুলোতে প্রসাধনরত নারীদের কপালে কুমকুম আর চোখে কাজল ব্যবহার করতে দেখা যায়। চোখে কাজল ব্যবহারে এই চর্চাটাও খুব ইন্টারেস্টিং। এত অল্প একটি উপাদানে মানুষের মুখশ্রী ও ব্যক্তিত্বে এতটা পরিবর্তন আর কোনো প্রসাধন উপকরণে হয় কি না আমি জানি না। যাকে বলে স্বল্পে সুন্দর! শ্রদ্ধেয় নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাস’-এর আদিপর্বে পড়েছিলাম যে হাজার বছর আগে থেকেই এই বঙ্গভূমিতে কাজলের ব্যবহার ছিল। আর্যরা আসার আগে আমাদের দ্রাবিড় সমাজে শ্যামবর্ণের নারীদের প্রতি একই রকম অবহেলা ছিল কি না জানা যায় না। কিন্তু কাজলের ব্যবহার যে শ্যামবর্ণের মানুষের, বিশেষত নারীদের মুখশ্রীকে উদ্ভাসিত করে তোলে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এর কারণটাও সহজ, মানুষের মুখশ্রীর সবচেয়ে হিপনোটাইজিং অংশ হচ্ছে তার চোখ। আর কাজলের ব্যবহার সেই চোখের দিকেই দর্শকের দৃষ্টি নিবেশ করতে সাহায্য করে। পরীক্ষার আগে বই পড়ার সময় আমরা যেমন বিশেষ অংশের নিচে দাগিয়ে রাখি, প্রসাধনের ক্ষেত্রে কাজলের ভূমিকাও যেমন সে রকম। কপালে টিপ পরার প্রচলনও বোধ হয় একই রকম তাগিদ থেকে হয়েছিল। চোখে চোখ রেখে কথোপকথনের চেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে আর নেই। তাই চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার জন্য এই সহজ ও সুন্দর চর্চাটি গড়ে ওঠে হাজার বছর ধরে।
কেশবিন্যাসের ক্ষেত্রেও বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। একদম সাধারণ আটপৌরে ভঙ্গি থেকে শুরু করে অভিজাতদের উঁচু করে চুল বাঁধার প্রচলন ছিল। এই অঞ্চলে চুল ঢেকে রাখার সংস্কার ছিল না বলেই মনে হয়। সে রকম শিরোভূষণ বা পাগড়ি আলাদা করে চোখে পড়েনি। চুল বেঁধে তাতে বিভিন্ন ফুল গুঁজে কেশসজ্জার চর্চা তখনো ছিল। সেই সঙ্গে ছিল চুলে সুগন্ধি ব্যবহারের চর্চা।
পোশাকের ক্ষেত্রে সেলাই করা জামাকাপড় পরার প্রচলন তখনো শুরু হয়নি। পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সেলাই ছাড়া দীর্ঘ বস্ত্র প্রচলিত ছিল। যেটা জড়িয়ে বা আধুনিক ফ্যাশনের ভাষায় যেটাকে ড্রেপিং বলা হয়। এই অঞ্চলের আবহাওয়ার কারণেই হোক অথবা ভাস্কর্যগুলোর বিষয়বস্তুর কারণেই হোক, সূক্ষ্ম সুতায় বোনা বেশ স্বচ্ছ বস্ত্রের ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। একেবারে বস্ত্রহীনতার চেয়ে যে বস্ত্রের সুচিন্তিত ব্যবহার অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে করা হতো, সে বিষয়টি প্রতিটি ভাস্কর্যেই বেশ স্পষ্ট।
এই একটা বিষয়ও খুব ইন্টারেস্টিং। খাজুরাহর ভাস্কর্যের বিষয়বস্তুতে ন্যুডিটি অপরিহার্য। কিন্তু পাশ্চাত্যের ন্যুডিটি থেকে প্রাচীন ভারতের ন্যুডিটি বেশ আলাদা। পাশ্চাত্যের ভাস্কর্যে কিংবা চিত্রকলায় যখন ন্যুডিটিকে উদ্যাপন করা হয়, তখন সেখানে কোনো ধরনের বস্ত্র বা অলংকারের উপস্থিতি বরদাশত করা হয় না। একটা সুতাও না। সেখানে প্রকৃতিপ্রদত্ত শারীরিক সৌষ্ঠব এবং বিভিন্ন অঙ্গের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলাই শেষ কথা। তার বিপরীতে প্রাচীন ভারতের এই ভাস্কর্যগুলোতে আমরা দেখতে পাই যে প্রকৃতিপ্রদত্ত সুতনুর সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে অলংকারের ব্যবহার যেন অপরিহার্য। বস্ত্রের ব্যবহার কখনো কখনো গৌণ হলেও গয়না কখনোই গৌণ নয়। সেই পূর্বপুরুষদের উন্নত রুচিবোধ দেশকাল পেরিয়ে আমাদের ডিএনএতে নিশ্চয় স্থান করে নিয়েছে। আমাদের সাজসজ্জায়ও তাই গয়না যেন অসম্পূর্ণ।

লেখক: জাতিসংঘের কর্মকর্তা; নেশা পরিব্রাজন।
Email: showvikbd@gmail.com
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top