skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I প্রে, ইট, রিপিট!

অঞ্জলি আর খাওয়ার পুনরাবৃত্তি আজও আছে। নেই বাড়িতে তৈরি নাড়–, গজা আর মিষ্টি। লিখেছেন কনিষ্ক চক্রবর্তী

দুর্গাপূজা! হইহই রইরই ব্যাপার। সাজুগুজু। হাসিঠাট্টা। গল্পগাছা। খুনসুটি। আর খাওয়াদাওয়া। নাচে-গানে ভরপুর কটা দিন। সারা বছর এর অপেক্ষা।
আমার ছোটবেলা কেটেছে দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেট এলাকায়। মা, বাবা আর আমি থাকতাম একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে। খুব কাছে ছিল আমার মামাবাড়ি। অনেক দিন অবধি আমি ছিলাম দাদু-দিদার একমাত্র নাতি। মামা-মাসিদের একমাত্র ভাগনে/বোনপো। যথেষ্ট আদরে বড় হয়েছি। পূজার কটা দিন মোটামুটি মামাবাড়িতেই কাটত। পাড়ার পূজায় নয়। মামাবাড়ির পাড়ার পূজায়।

কনিষ্ক চক্রবর্তী

পূজার দিন সক্কাল সক্কাল বাবা-মায়ের সঙ্গে, নতুন জামা পরে, ট্রামে চেপে পৌঁছে যেতাম মামাবাড়ি। তারপর চটপট চলে যেতাম পূজার প্যান্ডেলে, অঞ্জলি দিতে। দুটি বিষয়ে বলার আছে এখানে। আমরা কখনো মন্ডপ বলতাম না। প্যান্ডেল বলতাম। আর পুষ্পাঞ্জলি নয়। অঞ্জলি।
অঞ্জলি দিতাম পূজার চার দিনই। এখন যেমন কেমন করে জানি অষ্টমীর অঞ্জলিটা আসল হয়ে উঠেছে। আমরা কিন্তু প্রতিদিন দিতাম অঞ্জলি।
মামাবাড়ির পাড়ার পূজাকে বলা হতো ২৩ পল্লির পূজা। আমার দাদু ছিলেন সেই পূজার এক কর্তাব্যক্তি। তাই আমরা একদম সামনে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিতাম। আফটার অল, প্রতিমার পায়ে ফুল ছুড়ে দিতে পারা ছিল নরলোক আর দেবলোকের মধ্যে হটলাইন!

অঞ্জলি দিতাম না খেয়ে। মামাবাড়ি ফিরে শুরু হতো খাওয়াদাওয়া। সবার জন্য প্লেটে করে ঘুগনি। সাদা মটর বা সাদা ছোলার। নারকেল কুচি দেওয়া। বের হতো কৌটো ভরা কুচো নিমকি আর কাঠি নিমকি। আর থাকত নারকেল নাড়ু। দুই রকম। সাদা, চিনি আর ক্ষীর দিয়ে বানানো। কর্পূরের গন্ধে ভরপুর। দু-একটা বড় এলাচির দানাও যেন মনে পড়ে। আর আখের গুড়ের। কখনোই খেজুরের গুড় নয়। সে তো শীতকালের জিনিস।
আর থাকত জিবেগজা। জিভ বা জিহ্বার মতো দেখায় বলে এই নাম। ময়দা দিয়ে তৈরি। হালকা চিনির রসে ফেলা। মুচমুচে। মিষ্টি। চকচকে। আলো ঠিকরে উঠতো রোদ পড়লে।
এরপর আসত দিদার বানানো সন্দেশ। সেও দুই রকম। নারকেল আর ক্ষীরে তৈরি। কালো পাথরের ছাঁচে ফেলে ফুল, শঙ্খ ইত্যাদি চেহারার।
এসবের পর এক কাপ করে সুগন্ধি দার্জিলিং চা। হালকা দুধ আর চিনি দিয়ে।
এমন জলখাবারের পরে দুপুরের খাবার ছিল সাধারণ মাছ ভাত। ইলিশ নয়। বেশির ভাগ সময় রুই। কখনো চিংড়িও হতো। আর অষ্টমীর দিন নিরামিষ। দুবেলাই লুচি। মনে আছে, বাড়ির কিছু মানুষ পূজার ওখান থেকে আসা ভোগ খেতেন। আমি অবশ্য কোনো দিনই ভোগের ভক্ত নই। আমি ভাত কিংবা লুচিই খেতাম।
রাতের খাবার তো আরও সাদামাটা। সারা দিন হই-হট্টগোলের পরে কোনোরকমে লুচি আর তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়া। সকালে আবার উঠতে হবে যে! প্রে, ইট, রিপিট।
বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় আবার মিষ্টি। আমার দাদু বেশ কয়েকটি পূজার কর্তাব্যক্তি ছিলেন। প্রতিমা বিসর্জনে যাওয়ার পথে মামাবাড়ির সামনে দিয়ে নেওয়া হতো। চলে গেলে বড়দের প্রণাম, ছোট ও সমবয়সীদের কোলাকুলি করে মিষ্টিমুখ করা। সে মিষ্টি বেশির ভাগ পাড়ার দোকান থেকে কেনা রসগোল্লা বা সন্দেশ। চকলেট, বাটার স্কচ, ব্লুবেরি তখনো মিষ্টির দোকানে ঢোকেনি। তবে কেশর আর বাদামের চল ছিল একটু বড় দোকানগুলোতে।
দিনকাল পাল্টেছে। আজকাল তো বিরিয়ানি, রোল, নুডলস, পিৎজা ছাড়া পূজার খাবার হয়ই না। অষ্টমীতে নিরামিষ এখনো চালু আছে। তবে এখন দশমীর দুপুরে মাংস মাস্ট। না হলে পূজা বৃথা। মিষ্টি এখন সবই কিনে আনা হয়। বাড়িতে বানানোর মানুষ আর নেই বললেই চলে। মিষ্টির দোকানগুলোও আজকাল প্রয়োজন বুঝে সেই ছোটবেলার মিষ্টিগুলো বিক্রি করে। কোনো দিন ভাবিনি গজা বা নাড়ু কিনতে যাব দোকানে।
কী আর করা? আফটার অল, চেঞ্জ ইজ দ্য ওনলি কনস্ট্যান্ট।

ছবি: ইন্টারনেট

This Post Has One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top