skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I ফ্যাশন-পোশাক-আশাক : বাঙালিনীর বদলতি তসবির- যশোধরা রায়চৌধুরী

 


All these consequences follow from the fact that the worker is related to the product of his labour as to an alien object. For it is clear on this presupposition that the more the worker expends himself in work the more powerful becomes the world of objects which he creates in face of himself, the poorer he becomes in his inner life, and the less he belongs to himself. – কার্ল মার্ক্স

গল্পটা রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে শুরু করব, না মিশেল ফুকোকে দিয়ে, ধন্ধে পড়েছি। শেষ অব্দি ঠিক করা গেল, মার্ক্স দিয়েই শুরু করি, অন্তত মার্ক্স আমাদের বাঙালির কাছে তো রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কম আপনার নন। অন্তত ছিলেন না এত দিন। এখন পরিবর্তনের জমানায় তাঁকে কি আর অত সহজে ত্যাগ করতে পারি?
একজন নারী যখন সাজেন, পোশাক থেকে শুরু করে নানা রকম অলংকার, গয়নাগাঁটি, ব্যাগ, জুতা, এখনকার ভাষায় নানা অ্যাকসেসরি দিয়ে সাজিয়ে তোলেন নিজেকে, তখন সেই ভীষণ সময়সাপেক্ষ, কঠিন কাজটাও কিন্তু একরকমের লেবার বা শ্রম বলে ভাবা চলে। আর সেই শ্রমের যে প্রোডাক্ট, বা ফল, সেটা, অর্থাৎ এক সুসজ্জিত নারীদেহ, সেটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসে না তার নিজের কোনো কাজেই, কেননা এই কাজের উপলক্ষ হলো পুরুষের মনোরঞ্জন। অন্তত এমনটাই বলবে আমাদের দীর্ঘকাল ধরে লালিত পুরুষকেন্দ্রিক বিশ্বধারণা।
উদ্দিষ্ট যে ক্রেতা তথা ভোক্তাগোষ্ঠী, তা শুধুই পুরুষ যদি হয়ে থাকে, তাহলে এই গোটা ব্যাপারটাই নারীকে তার নিজের শরীরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলবে, তৈরি হবে অ্যালিয়েনেশন, নিজের শরীরের সঙ্গে নিজের। আর হ্যাঁ, এটাই বলেছেন বামপন্থী নারীবাদীরাও। আর সত্যিই সে কথাকে অবিশ্বাস করতে পারি না, যদি মিলিয়ে নিতে পারি, নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে।
পাশ্চাত্যে সোশিওলজি অব দ্য বডি নামে যে বিষয়টির আমদানি ঘটেছে, তা কিন্তু মার্ক্স থেকেই গতি পায়, কেননা তিনিই প্রথম লক্ষ করেন, শরীরও কীভাবে হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক এক ক্ষেত্র, যার ওপরে নানা উৎপাদন প্রক্রিয়া মনোনিবেশ করেছে, তাকে বারবার বদলে দিতে চেয়েছে। (the body is not only the indirect and unintended result of social relations but the target object of a systematic processing)। এরপর আসরে অবতীর্ণ হন ফুকো সাহেব, তিনি বললেন, ক্ষমতার ক্ষেত্র এই শরীরও, এবং ক্ষমতাই তাকে সাজায়, তাকে পেশ করে সমাজে, বলে দেয়, কীভাবে দেখা হবে একটি শরীরকে, কীভাবে তা আলাদা করে নেওয়া হবে অন্য শরীরের থেকে। এই সোশিওলজি অব বডি বিষয়টি অতঃপর ঢুকে পড়ল বিদ্বজ্জনদের গন্ডিতে, বইয়ের পর বই লেখা হলো তা নিয়ে, আর, অতি সম্প্রতি, এই বিষয় জন্ম দিয়েছে আরেক নতুন বিষয়ের, যার নাম সোশিওলজি অব কনজিউমারিজম!
আমাদের এই ক্ষুদ্র কথাবন্ধ প্রচেষ্টা আসলে এই নিরিখেই ইদানীং বাঙালি তথা ভারতীয় মেয়েদের সাজপোশাককে দেখার একটা শুরুয়াত বলা যেতে পারে। কিছু কিছু পর্যবেক্ষণও বলা যেতে পারে। প্রবন্ধ বা নিবন্ধের গুরুত্ব আমি একে দিতে নারাজ, পন্ডিতেরা সেসব কাজ করবেন। নারীর পোশাকের বদলতি তসবির, মানে বদলে যাওয়া চেহারাছবি, এই নিয়েই যদি কথা বলতে বসি, আর কথাটাকে আটকে রাখি বাঙালির মেনস্ট্রিম মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের ভেতরে, নিজের অভিজ্ঞতার বলয়টা থেকেও শুরু করা যায় ব্যাপারটাকে দেখতে। আর তখন এটা দেখতে পাই, কী দ্রুতই না পাল্টে গেল মেয়েদের নিজেকে সাজিয়ে তোলাটা, এই উদ্দিষ্ট ভোক্তার নিরিখে!
একটা প্রজন্ম থেকে আর একটা প্রজন্মে, আলাদা আলাদা করে বলে দেওয়া যাবে না, মেয়েরা কার জন্য সাজেন। পুরুষের জন্য, নাকি নিজের জন্য? যদি পুরুষের জন্য হয়, তাহলে কোন পুরুষের জন্য? নিজের প্রিয় পুরুষটির জন্য, স্বামী বা প্রেমিকের জন্য, নাকি তার বন্ধুবান্ধব অন্য পুরুষদের জন্য, নাকি, বাসে ট্রামে দেখা আর আর পুরুষের জন্যও? আর যদি নিজের জন্য হয়, আয়নার সামনে বসে নিজেকে কোন চোখ দিয়ে দেখেন একটি মেয়ে? অন্য চোখে, ধার করা চোখে, পুরুষের চোখে? যেমনটা বলবেন লরা মালভি?
গত অনেকগুলো বছরে, অন্তত যে ক বছর আমি বেঁচে আছি, ষাটের শেষ থেকে সত্তর আশি ছেনে নব্বই ও দু হাজার অব্দি, আমার চোখে দেখা মেয়েদের সাজপোশাক বদলের হার এবং গতি, বদলের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধের পাল্টে যাওয়া, সব মিলিয়ে যেটুকু দেখেছি তারই আধারে আমার আজকের এই কথাগুলো। আসলে, যা-ই ঘটে, যখনই ঘটে, জিগ্যেস না করে পারি না সেই একই প্রশ্ন, যা জিগ্যেস করেছি বারবার গত কয়েক বছরে, আমাদের সনাতন সমাজের নানা রেফারেন্সেই মেয়েদের কিছু বদল কি হয়েছে আমাদের চোখের সামনে দিয়েই?
আমাদের সব হওয়া, সব বদলই কোথাও একটা গিয়ে এক সুতোয় গাঁথা হয়ে উঠছে ক্রমাগত। নারীবাদ, পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা: এ একটা দেখার দিক। বিষয় হিসেবেই কিন্তু নারীকে দেখতে অভ্যস্ত আমরা। জনপ্রিয় সাহিত্যশিল্পের কাছে সেটাই প্রশ্নচিহ্নহীন ধরে নেওয়া। উপভোক্তা নারী পুরুষ যে-ই হোন, তাঁকে আমোদ দেবে, বিনোদন দেবে নারীর এই বিষয়-মূর্তিই। এটাই পুরুষশাসিত সমাজের সহজ ছক। নারী পুরুষের মিউজ, তার প্রেরণা, তার আকাক্সক্ষার বিষয়, সম্ভোগের বস্তু, হাসিল করার পণ্য।
ফ্যাশন ব্যাপারটাকেও আমরা দেখতে পারি মেল গেজ-ফিমেল গেজ-এর দ্বৈততার নিরিখে। যে নতুন নিরীক্ষা তুলে ধরেছিলেন সিনেমা চর্চার ক্ষেত্রে লরা মালভে, তাঁর ‘ভিজ্যুয়াল অ্যান্ড আদার প্লেজারস’ প্রবন্ধে, ১৯৭৩ সালে। যা থেকে উঠে এসেছিল নতুন এক তত্ত্ব। লাকাঁ ও ফ্রয়েডের ধারা থেকেই জন্ম নিয়েছিল জনপ্রিয় ছায়াছবির নারীবাদী বিশ্লেষণের নতুন ধারণাটি, ‘মেল গেজ বা ‘পুংদৃষ্টির তত্ত্ব’। সে তত্ত্বও বলছে একই কথা। মূলস্রোত ছায়াছবি, হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলোই ধরা যাক, নারীকে দেখায় বিষয় হিসেবে। দুভাবে বিষয় করা হয় নারীকে। হয় ভয়ারিস্টিক বিষয়। সে পুরুষচোখে নারী লালসাময় বেশ্যা । নতুবা ফেটিসিস্টিক বিষয়। সে পুরুষ চোখে, পুরুষ চাহনিতে নারী দেবী, ম্যাডোনা, মা।
নারীবাদীর চোখ দিয়ে দেখলে এই ব্যাপারটাতে একটা সূক্ষ্ম বদল লক্ষ করব আমরা। আরও সোজা করে বললে, মেয়েদের দিক থেকে পোশাকের সঙ্গে তাঁর নিজ সম্পর্ককে পুনর্নির্মাণ দেখব। অন্তত আশি, নব্বই অব্দি। তারপর দেখব, নব্বই দশকের নতুন দৈত্যকে, প্রদীপের ভেতরে যে লুকিয়ে ছিল অ্যাদ্দিন। আশি থেকে যার সলতে পাকানো শুরু। বিশ্বায়ন, উদারীকরণ, ভোগবাদ। সে আর এক বহুমাত্রিক বদল। যে দিকটাই দেখি না, গত কুড়ি-তিরিশ বছরে মেয়েদের পোশাক ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে সামাজিক প্যারামিটারগুলো পাল্টাতেই দেখি। সর্বত্র ওই এক বদলে যাওয়া মূল্যবোধই উঠে আসে।
আমাদের শুরুর প্রশ্নটা বেশ সাদামাটা ছিল। গত ত্রিশ বছরে কি খুবই বেড়ে উঠেছে বাঙালি মেয়েদের রূপসচেতনতা? পোশাক-আশাক নিয়ে মেয়েরা কি আগের চেয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন? কথাটা বোধ হয় খুব ওপর ওপর হয়ে যায়, এভাবে বললে। অথচ এর চেয়ে বেশি গভীরে ঢুকে, এর চেয়ে বেশি খুঁটিয়ে, কেইবা দেখছেন, মেয়েদের সঙ্গে সাজপোশাকের সম্পর্কের হালফিলের বিবর্তন?
বাংলায় ফ্যাশন নিয়ে বই খুঁজলে যে পাব না তা নয়। তবু, মেয়েদের চোখে মেয়েদের ফ্যাশন নিয়ে বই সম্ভবত বাংলায় নেই। যেমন নেই সৌন্দর্য বা রূপবিভার বিশ্লেষণ। মানে, আমি সানন্দা পত্রিকার কথা বলতে চাইছি না কিন্তু, অথবা বলতে চাইছি না সুখী গৃহকোণ বা বিভিন্ন সংবাদপত্রের ফ্যাশনপৃষ্ঠার কথা। আমি বলতে চাইছি সেই সব ফ্যাশন ট্রেন্ডের পুনর্নিরীক্ষা, ট্রেন্ড অ্যানালিসিস অথবা তাত্ত্বিক স্তরে কোনো সূত্র খোঁজার চেষ্টা। রোজ যা ঘটে চলেছে ছিন্নবিচ্ছিন্নভাবে, মিডিয়ায় তার প্রতিফলন, মানুষের মনের উপরে তার ধাক্কা বা সূক্ষ্ম প্রভাব, তার বলয়ে বসবাস করতে করতে মেয়েদের জীবনযাপনে আস্তে আস্তে যে বদল, এসব ঘটনার একটা নির্যাস, একটা স্পষ্ট অবয়ব, কোনো আলোচনায় তৈরি হয়ে উঠছে কি? বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিকের এলাকা, এবং একজন দুজন সমাজতাত্ত্বিকের কলমে ইতিমধ্যেই নজরে এসেছে কিছু লেখায় বদলটাকে ধরার চেষ্টা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপিকার হাতেই এ বিষয়ের সঠিক মর্যাদা হতে পারে, এমন নয় হয়তোবা। নারীবাদী বয়ান নির্মাণ না করেও, খুঁটিনাটি তুলে আনা তথ্যনিষ্ঠ লেখাও তো থাকতে পারত!
মনে রাখতে হবে, গ্ল্যামার শব্দটি নিয়ে বই কে বই লেখা হয়ে গেছে পাশ্চাত্যের নারীবাদীদের কলমে।
ধরা যাক না ক্যারল ডাইহাউজের ‘গ্ল্যামার : নারী, ইতিহাস, নারীবাদ’ বইটির কথাই। এখানে গ্ল্যামারের সংজ্ঞা দিচ্ছেন ডাইহাউজ। যে গ্ল্যামার, ১৯০০ সালের আগে ব্যবহারই হতো না, হলেই খুব ঝাপসা এক অর্থে। গ্ল্যামার প্রথম যুগে এক জাদুক্ষমতার মতো, পরবর্তীকালে ভাষার প্রতি পরতে গ্ল্যামার শব্দের ক্রমবিস্তারে তার অবস্থান বিলাস, ব্যসনে, প্রাচ্য-রেশমের সূক্ষ্ম-দুর্লভতার একজটিক (বীড়ঃরপ)-এ, নাটকীয় আড়ম্বর ঐশ্বর্যে। আরও পরে, ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত স্বপ্নকল্পনার উপাদান। হলিউড সিনেমার দাক্ষিণ্যে রোজকার থোড়বড়িখাড়া জীবন থেকে পালানোর উপাদান সেই গ্ল্যামার। যা প্রত্যেক মার্কিন রমণীকে উজ্জীবিত করত, তার নিরেশ, নীরস দৈনন্দিন জীবনের নিরিখে আনন্দ দিত যে গ্ল্যামারের খোঁজ। জনপ্রিয় ফ্যাশন ও রুচির ক্ষেত্রে সিনেমার প্রত্যক্ষ প্রভাবের ব্যাপারটা মুভি থেকে টকির যুগ অব্দি স্পষ্ট হয়ে উঠল। আর, সবচেয়ে বড় যে তফাত ঘটে গেল, তা হলো, উচ্চবিত্তের আঙিনা থেকে সফিস্টিকেশন, রূপচর্চা আর পোশাকসচেতনতা নেমে এল মধ্যবিত্তের অন্দরে। অর্থাৎ সাজগোজ-গ্ল্যামার-পোশাকচর্চার মধ্যবিত্তায়নই সিনেমার সবচেয়ে বড় অবদান পাশ্চাত্যে, বিশেষত মার্কিন সমাজে।


রাবীন্দ্রিক ব্রাহ্ম মডেলে ফ্যাশন : বসবার ঘরের কালচার
বাঙালি যখন, গত ত্রিশ বছরের এলাকাবহির্ভূত হলেও, একবার রবি ঠাকুর ছুঁইয়ে না নিলে দোষ কাটে না আমাদের লেখালেখির। আশ্চর্যের কথা জীবনের ধরাছোঁয়া সব বিষয়ই কোনো না কোনোভাবে তাঁর লেখায় বিধৃত বলে, কোটেশন মেরে দেওয়াও খুব সহজ। ফ্যাশন স্টাইল তরজা তাই সেই কবেই রবি-বিষয়ীভূত!
‘অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভূষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে। পাঁচজনের মধ্যে ও যেকোনো একজন মাত্র নয়, ও হলো একেবারে পঞ্চম। অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। দাড়িগোঁফ-কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ, স্ফূর্তিভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না; মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। দেশি কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না। ধুতিসাদা থানের যত্নে কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এ রকম ধুতি চলতি নয়। পাঞ্জাবি পরে, তার বাঁ কাঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি, আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দু-ভাগ করা; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি-দেওয়া চওড়া খয়েরি রঙের ফিতে, তারই বাঁ দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের এক ছোট থলি, তার মধ্যে ওরট্যাঁকঘড়ি; পায়ে সাদা চামড়ার ওপর লাল চামড়ার কাজ-করা কটকি জুতা। বাইরে যখন যায় একটা পাট-করা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজি চাদর বাঁ কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঝুলতে থাকে; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রণ থাকে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানি লক্ষ্ণৌ টুপি, সাদার ওপর সাদা কাজ-করা। একে ঠিক সাজ বলব না, এ হচ্ছে ওর একরকমের উচ্চহাসি। ওর বিলিতি সাজের মর্ম আমি বুঝি নে, যারা বোঝে তারা বলে- কিছু আলুথালু গোছের বটে, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ডিস্টিঙ্গুইশড। নিজেকে অপরূপ করবার শখ ওর নেই, কিন্তু ফ্যাশনকে বিদ্রূপ করবার কৌতুক ওর অপর্যাপ্ত। কোনোমতে বয়স মিলিয়ে যারা কুষ্ঠির প্রমাণে যুবক তাদের দর্শন মেলে পথেঘাটে; অমিতর দুর্লভ যুবকত্ব নির্জলা যৌবনের জোরেই, একেবারে বেহিসেবি, উড়নচন্ডী, বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে, সমস্ত নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে, হাতে কিছুই রাখে না।’
রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ বোধ হয় উপন্যাসে বাংলার ইঙ্গবঙ্গ সমাজের সাজপোশাকের ডিটেলিংয়ের এক দিকদর্শন। এভাবে সূক্ষ্ম বর্ণনার ভেতর দিয়ে তুলে আনায় প্রমাণ পায়, সাজ ব্যাপারটা মেয়েদের একচেটিয়া ব্যাপার নয়, এর ‘ইউনিসেক্স’ চরিত্রটা বেশ ফুটে ওঠে। তবে, অমিত চিরকালই একটি ব্যতিক্রম। তবে এরপরই মেয়েদের ফ্যাশনদুরস্ততার বর্ণনা এসে পড়বে, যা আমাদের এই লেখার পক্ষে এক অতি উপাদেয় উপাদান-
‘এ দিকে ওর দুই বোন, যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন নতুনবাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি- ফ্যাশনের পসরায় আপাদমস্তক যত্নে মোড়ক-করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট-বিশেষ। উঁচু খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক-কাটা জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবালে অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যক ভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপ্টানো। এরা খুট খুট করে দ্রুত লয়ে চলে; উচ্চৈঃস্বরে বলে; স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুরফুর করে সঞ্চালন করে, এবং পুরুষ বন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতিকৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে।’
এরপরই পাঠক হিসেবে আমাদের তৃষিত অপেক্ষা হবে লাবণ্যের আবির্ভাবের জন্য। সেটা এই রকম-
‘একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালো পটখানা তার পিছনে, তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবি- চারি দিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র। মন্দর পর্বতের নাড়া-খাওয়া ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দোলনের উপরে- মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলে। ড্রয়িংরুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না। মেয়েটির পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট, পায়ে সাদা চামড়ার দিশি ছাঁদের জুতো। তনু দীর্ঘ দেহটি, বর্ণ চিকন শ্যাম, টানা চোখ ঘনপক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় স্নিগ্ধ, প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল আঁট করে বাঁধা, চিবুক ঘিরে সুকুমার মুখের ডৌলটি একটি অনতিপক্ব ফলের মতো রমণীয়। জ্যাকেটের হাত কবজি পর্যন্ত, দু-হাতে দুটি সরু প্লেন বালা। ব্রোচের-বন্ধনহীন কাঁধের কাপড় মাথায় উঠেছে, কটকি কাজ-করা রুপোর কাঁটা দিয়ে খোঁপার সঙ্গে বদ্ধ।’
এই যে সাজ, যা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত মেয়েদের, তির্যকভাবে যাকে বলা চলে ব্রাহ্ম সাজ, সেই ফ্যাশনদুরস্ততার পরিশীলিত বয়ান, যতটাই ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সিংক্রনিক, ততটাই বসবার ঘর, বাইরের ঘর, বৈঠকখানার কালচারে চোবানো। একেই বোধ হয় বলে স্যালঁ (salon) কালচার!
যে মেয়েরা হিন্দু অন্তঃপুরে, সেই একই সময়ে, তাঁদের সাজও হয়তোবা উঠে এসেছে শরৎসাহিত্যে অথবা তরুণতর উপন্যাস সাহিত্যের বিবরণে। কিন্তু এত স্পষ্ট ও সচেতনভাবে এসেছে কি? তবে একথা বলাই যায় যে বঙ্গবধূদের ঘরোয়া সাজের ভেতরে সেলাই করা ব্লাউজ (সে যুগের ভাষায় যা জ্যাকেট) সেভাবে কিন্তু ছিল না বললেই চলে। শেমিজ হয়তোবা এসে উঠেছে। ফ্রিল দেওয়া হাতার যে কদর্য ক্যারিকেচারটি আমাদের আজকের সময়ে বাঙালি অন্তঃপুরিকামাত্রের অঙ্গে যেকোনো নাটক বা সিরিয়ালে দেখি, অন্তত ততটা অনান্দনিক ছিল না সেই খালি গায়ে জড়ানো দিশিমতে পরা শাড়ি বা থানের বিশুদ্ধতা।
হিন্দু অন্তঃপুরের ভেতরে রাবীন্দ্রিক বিবরণের ওই জ্যাকেট- সিল্ক শাড়ির সাজ যে কতটা বেমানান ও আরোপিত ছিল, স্বয়ং রবি ঠাকুরই তা স্পষ্ট করেননি? ‘ঘরে বাইরে’তে, যখন এই ফ্যাশন গায়ের জোরে আমদানি হয় নিখিলেশের দ্বারা, বিমলের ওপরে? যে হালফ্যাশয়ানের প্রতি অগাধ সন্দেহ নিখিলেশের প্রাচীনপন্থী বিধবা বউদির। বিমলের কন্ঠস্বরে তা অনেকটা এই রকম, ‘এখনকার কালের বিবিয়ানার নির্লজ্জতা! আমার স্বামী আমাকে হাল-ফ্যাশনের সাজে-সজ্জায় সাজিয়েছেন সেই সমস্ত রঙবেরঙের জ্যাকেট-শাড়ি-শেমিজ-পেটিকোটের আয়োজন দেখে তাঁরা জ্বলতে থাকতেন। রূপ নেই, রূপের ঠাট! দেহটাকে যে একেবারে দোকান করে সাজিয়ে তুললে গো’ সেই বিমলকেই যখন সন্দীপবাবুর সামনে যাবার জন্য সাজতে দেখা যায় তখন তা এই রকম: সেদিন সকালে মাথা ঘষে আমার সুদীর্ঘ এলোচুল একটি লালরেশমের ফিতে দিয়ে নিপুণ করে জড়িয়েছিলুম। দুপুরবেলায় খাবার নিমন্ত্রণ, তাই ভিজে চুল তখন খোঁপা করে বাঁধবার সময় ছিল না। গায়ে ছিল জরির পাড়ের একটি সাদা মাদ্রাজী শাড়ি, আর জরির একটুখানি পাড়-দেওয়া হাত-কাটা জ্যাকেট। আমি ঠিক করেছিলুম এ খুব সংযত সাজ, এর চেয়ে সাদাসিধা আর-কিছু হতে পারে না। এমন সময় আমার মেজো জা এসে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তার পরে ঠোঁট দুটো খুব টিপে একটু হাসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, দিদি, তুমি হাসলে যে? তিনি বললেন, তোর সাজ দেখছি।’

চোখ রাখুন আগামী সংখ্যায়

লেখা: লেখকের ব্লগ থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top