skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I বাংলাদেশের চিন্তাশীল ছবির নির্মাণশৈলী

বিষয়ে চিন্তাশীলতা আর আঙ্গিকে নান্দনিকতা- এ দুয়েই তৈরি হয় উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র। তাতে কাহিনি নির্বাচন থেকে নির্মাণের নানা পর্যায়ে উদ্ভাবনী কৌশল জরুরি। এসব শর্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কতোটা মান্য হয়েছে, সেই প্রশ্নে আলোকপাত করেছেন ড. নাদির জুনাইদ

‘রূপালি সৈকতে’ ছবিতে ব্যবহৃত একটি পোস্টারের দৃশ্য

একটি চলচ্চিত্রকে তখনই সুনির্মিত বলা যায়, যখন চলচ্চিত্রকার কেবল গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাহিনি নির্বাচনের মধ্যেই তার দায়িত্ব শেষ করেন না, চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীকেও সেই সঙ্গে করে তোলেন নান্দনিকভাবে নতুন ও আকর্ষণীয়। ভাষার উৎকর্ষ যেমন কোনো লেখার মান বাড়িয়ে তোলে, তেমনি কোনো চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধরনের শটের ব্যবহার, শব্দ বা নীরবতার জুতসই প্রয়োগ, রঙের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি, সম্পাদনার নানা কৌশল এবং বিভিন্ন বস্তু, প্রতীক আর স্পেস সুচিন্তিতভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে তৈরি হয় চলচ্চিত্রভাষা, যা চলচ্চিত্রকে করে তোলে অর্থপূর্ণ ও সুন্দর। চলচ্চিত্রভাষার উদ্ভাবনী প্রয়োগ যে ছবিতে দেখা যায়, সেটি ভিন্ন হয়ে ওঠে গতানুগতিক ফর্মুলায় তৈরি চলচ্চিত্র থেকে। সুনির্মিত চলচ্চিত্র তাই চিন্তাসমৃদ্ধ। কারণ, এ ধরনের ছবিতে বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলী- দুটি দিককেই অগতানুগতিক আর আলাদা করে তোলার চেষ্টা করা হয়। কেবল দর্শকের ম

সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শেষ দৃশ্য

নোরঞ্জনের জন্য অতিব্যবহৃত বিনোদনমূলক পদ্ধতি এখানে ব্যবহার করা হয় না। চিন্তাশীল চলচ্চিত্রে পরিচালকের লক্ষ্য থাকে দর্শককে বিনোদনে বুঁদ করে রাখার পরিবর্তে বর্তমান সমাজ, রাজনীতি অথবা অতীতের কোনো সময় কিংবা মানুষের মনের কোনো জটিল অনুভূতি প্রভৃতি সম্পর্কে গভীর কোনো বার্তা বা বক্তব্য তুলে ধরা। আর তা সম্ভব হয় নান্দনিকভাবে নতুন এবং আকর্ষণীয় চলচ্চিত্রভাষার মাধ্যমে। মুনাফা অর্জনের জন্য চটক আর চাকচিক্যে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা সিনেমার উদ্দেশ্য কেবলই বিনোদন জোগানো। চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী চটকদার বিষয়ে প্রাধান্য দেয় না। একে সৃজনশীল ও নান্দনিক হতে হয়। তাতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন জটিল চলচ্চিত্র কৌশল, যা দর্শককে চিন্তা করতে বাধ্য করে। একই সঙ্গে ছবির কাহিনি হালকা বিনোদন দেওয়ার পরিবর্তে দর্শক-মনে সৃষ্টি করে সমাজ-সচেতনতা।
চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের এই রূপের সঙ্গে তাই মূলধারার বিনোদনধর্মী ছবির মিল নেই। কারণ, মূলধারার ছবিতে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেই ছক-বাঁধা ফর্মুলা, যা বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন শ্রেণির দর্শককে বিনোদন জোগাতে ব্যর্থ হবে না। অবশ্য হলিউড বা বলিউডের মূলধারার কোনো কোনো ছবিতে বিনোদনের পরিবর্তে সমাজসচেতন বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা প্রাধান্য পেয়েছে। আর্ট বা এক্সপেরিমেন্টাল ছবির নির্মাণশৈলীর মতো উদ্ভাবনী না হলেও, কিছু মূলধারার ছবির নির্মাণশৈলীতে নতুনত্বের ছাপ আছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি আলোচিত ছবির কথা যেমন বনি অ্যান্ড ক্লাইড (১৯৬৭), দ্য গ্র্যাজুয়েট (১৯৬৭), ইজি রাইডার (১৯৬৯), মিডনাইট কাউবয় (১৯৬৯) প্রভৃতি। এই ছবিগুলো শৈল্পিক বা আর্ট সিনেমা নয়। কিন্তু কাহিনির ভিন্নতা আর নির্মাণশৈলীর অভিনবত্ব এই ছবিগুলোকে হলিউডে নিয়মিতভাবে তৈরি বাণিজ্যিক ছবিগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় চলচ্চিত্রকার মণি রত্নমের রোজা (১৯৯২), বোম্বে (১৯৯৫), দিল সে (১৯৯৮) ছবিতে নানাবিধ বাণিজ্যিক উপাদান, যেমন- নাচ ও গান, জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, রোম্যান্টিক প্লট, নাটকীয়তা, কাহিনির সরল ধারাবাহিকতা প্রভৃতি ব্যবহৃত হলেও এগুলোয় সমকালীন বিভিন্ন সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সে কারণে এই ছবিগুলোয় একধরনের গভীরতা তৈরি হয়েছে, যা গতানুগতিক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। সমাজ-সচেতন কাহিনির কারণে ছবির নির্মাণশৈলী আর সংলাপেও কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ সালে তৈরি ভূতের ভবিষ্যৎ ছবিতে একদিকে যেমন বিনোদনের বিভিন্ন উপাদান আছে, অন্যদিকে পরিচালক এই ছবির নির্মাণশৈলীকে করে তুলেছেন সৃষ্টিশীল। ছবিতে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন বিষয় এবং চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ বারবার উল্লেখ করার যে বিশেষ পদ্ধতি, যা সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ বা আত্মবাচক পদ্ধতি নামে পরিচিত, ভূতের ভবিষ্যৎ ছবিতে বারবার তা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ছবির বক্তব্যেও প্রধান হয়ে উঠেছে সমাজের সমালোচনা। ফলে দেখা যায় মূলধারার ছবির পরিসরের মধ্যে নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও কখনো নান্দনিকভাবে নতুন নির্মাণশৈলী ও সমাজসচেতন বক্তব্য ব্যবহার করা হয়।

‘সূর্যকন্যা’ ছবির দৃশ্য

অবশ্য এ ধরনের চলচ্চিত্রের সংখ্যা কম। নির্মাণশৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নান্দনিকভাবে নতুন চলচ্চিত্রভাষা সৃষ্টি করা মূলধারার বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের লক্ষ্য নয়। সমকালীন কিংবা অতীতের কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ তৈরি করা নয়, বরং দর্শকদের বিনোদন জোগানোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক লাভ অর্জন করাই বিনোদনধর্মী ছবির উদ্দেশ্য। চিন্তাশীল ছবির ধারণাটি তাই মিলে যায় মূলধারার বাণিজ্যিক ইন্ডাস্ট্রির বাইরে নির্মিত স্বাধীন বা বিকল্প ধারার ছবির সঙ্গে। বিভিন্ন দেশেই মূলধারার ছবির পাশাপাশি বিকল্প ধারার ছবি বা অলটারনেটিভ সিনেমা আছে, যে ছবি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত মূলধারার ছবির মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করে নির্মিত হয়। প্রকৃত অর্থে বিকল্পধারার ছবি হয়ে উঠতে গেলে তাই মূলধারার ছবির মূলনীতি অর্থাৎ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যকে যেমন কম গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তেমনি মূলধারার ছবির চাকচিক্যময় বিনোদনমূলক গতানুগতিক ফর্মুলা ব্যবহারের পরিবর্তে উদ্ভাবনী চলচ্চিত্রকৌশল ব্যবহার করা এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। সেই সঙ্গে ছবির কাহিনিও করে তুলতে হয় বাস্তবধর্মী ও জীবনঘনিষ্ঠ। সমাজে কিংবা ব্যক্তির জীবনে যা ঘটছে, তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে দর্শককে সচেতন করে তোলা, দর্শকের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করা এবং দর্শককে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করা হয়ে ওঠে বিকল্প ধারার ছবির কাহিনির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বিনোদন বা চাকচিক্য বিকল্প ধারার ছবিতেও থাকতে পারে। তবে তা নতুন নির্মাণশৈলীর ব্যবহার এবং কাহিনির মাধ্যমে সমাজসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূলধারার বাইরে নির্মিত ছবি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র শক্তিশালী ছবি হিসেবে স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও চলচ্চিত্রকারদের কাছ থেকে। চিন্তাশীল চলচ্চিত্রে আগ্রহী সারা বিশ্বের দর্শকদের কাছেই বাংলা চলচ্চিত্র পরিচিত সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ছবির কারণে। এই তিন বিখ্যাত পরিচালকের বক্তব্যধর্মী, রাজনীতিমনস্ক ও সমাজসচেতন আর নির্মাণশৈলীর দিক থেকে অগতানুগতিক চলচ্চিত্র ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিচালকদেরও চিন্তাঋদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ভারতে মূলধারার ছবি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সমাজসচেতন এবং সৃজনশীল নির্মাণশৈলীর চলচ্চিত্র তৈরি করার গভীর আগ্রহ বিভিন্ন পরিচালকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের তৈরি করা সেই বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র ভারতীয় নতুন সিনেমা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।

‘ঘুড্ডি’ ছবিতে পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’র ব্যবহার

বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশে গড়ে ওঠা নতুন সিনেমার মতো কোনো শক্তিশালী আন্দোলন আমরা দেখতে পাইনি। এ দেশে বিভিন্ন দশকে জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক মাসুদের মতো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার কাহিনি ও নির্মাণশৈলী- দুই দিক দিয়েই অগতানুগতিক কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যেগুলো কাহিনি ও চলচ্চিত্রভাষার দিক থেকে প্রশংসা অর্জন করেছে। কিন্তু বেশ কিছুসংখ্যক পরিচালকের একসঙ্গে শৈল্পিক ও সমাজসচেতন চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা বাংলাদেশে কখনো আমরা দেখতে পাইনি। ফলে এখানে কাহিনি এবং নির্মাণশৈলী- দুই দিক থেকেই চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেশি নয়। বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে একটি দিক লক্ষণীয়, তা হলো কাহিনি বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তোলা হলেও প্রায়ই দেখা যায়, পরিচালকেরা ছবির নির্মাণশৈলী উদ্ভাবনী ও আকর্ষণীয় করে তুলতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান না। ফলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে নান্দনিকভাবে নতুন চলচ্চিত্রভাষা আমরা দেখতে পাই না। নির্মাণশৈলীকে অভিনব করে না তোলার অর্থ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিককে অবহেলা করা। কারণ, চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধরনের শট আর সম্পাদনার বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমেই অর্থ তৈরি করা হয়। আর এই প্রয়োজনীয় দিকটিকে অবহেলা করলে চলচ্চিত্র আর শিল্পমাধ্যম থাকে না। কারণ, যেকোনো শিল্পমাধ্যমেই আঙ্গিক বা নির্দিষ্ট ভাষা নান্দনিক এবং সৃজনশীল করে তোলার গুরুত্ব অনেক বেশি। সাদামাটা এবং গতানুগতিক আঙ্গিকের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য পরিবেশন করা হলে সেই শিল্পমাধ্যম উঁচু মান অর্জন করেছে তা বলা যায় না। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারদের ছবিতে আমরা নান্দনিকভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং উদ্ভাবনী চলচ্চিত্রভাষা দেখতে পেয়েছি। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্রকৌশল, যা ভারতের অন্য বহু ছবি থেকে তাদের ছবি পৃথক করে তুলেছে। সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), জন-অরণ্য (১৯৭৫), ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪), মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ (১৯৭০), কলকাতা ৭১ (১৯৭২), পদাতিক (১৯৭৩), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯), আকালের সন্ধানে (১৯৮২) প্রভৃতি চলচ্চিত্র বক্তব্যের পাশাপাশি নির্মাণশৈলীর দিক থেকেও অত্যন্ত অভিনব ও আকর্ষণীয়। একটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে- তিনজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকারের ব্যবহৃত উদ্ভাবনী নির্মাণশৈলী বাংলাদেশের বিকল্প ধারার পরিচালকদের কতটা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছে?
মৃণাল সেন সেই ১৯৭০-এর দশকেই নিজের ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন আত্মবাচক পদ্ধতি এবং জার্মান নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখ্ট প্রবর্তিত বিভিন্ন কৌশল, যা দর্শকদের নিষ্ক্রিয় রাখার পরিবর্তে তাদের সক্রিয় করে তোলে। এমনকি, ব্যবহার করেছিলেন ছবির চরিত্রদের দর্শকের দিকে তাকিয়ে সরাসরি কথা বলার জটিল পদ্ধতি। অর্থ তৈরি করেছিলেন মন্তাজ দৃশ্য আর বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে। তার ছবির পর্দায় দেখা যায় বিভিন্ন লেখা, যা সমকালীন অস্থির রাজনীতির নানা দিক সম্পর্কে দর্শকদের সচেতন করে তোলে। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী মৃণাল সেনের ছবির মতো বেশি অভিনব এবং পরীক্ষামূলক না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে নেগেটিভ ইমেজের ব্যবহার, বারবার ফ্ল্যাশব্যাক, জাম্প কাট, সময় আর স্থানের অস্পষ্টতা, জটিল প্রতীকের মাধ্যমে অর্থ তুলে ধরা, ভয়েসওভারে বক্তব্য দেওয়া ইত্যাদি ছবির নির্মাণশৈলী অগতানুগতিক করে তোলার আগ্রহ নির্দেশ করে। ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগ ত্রয়ী ছবিগুলোয় এবং পরবর্তীকালে সমকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে তৈরি যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো ছবিতেও বারবার বিভিন্ন দেশজ প্রতীকের মাধ্যমে অর্থ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা ছবির ভাষাকে ভিন্ন করেছে অন্য অনেক চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী থেকে। বাংলাদেশে এই পর্যন্ত নির্মিত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকে নিজের বিভিন্ন ছবিতে আলমগীর কবির সচেতনভাবে নতুন এবং উদ্ভাবনী চলচ্চিত্রকৌশল ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। তার ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্যকন্যা (১৯৭৬), রূপালি সৈকতে (১৯৭৯) ছবিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ আর সমালোচনা যেভাবে অভিনব ও পরীক্ষামূলক নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, তেমন প্রচেষ্টা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিরল। নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যরে ছবি ধীরে বহে মেঘনায় কবির ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দৃশ্য, ছবির চরিত্রদের ভাবনা শোনানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ইন্টারনাল মনোলোগ, কখনো ভয়েসওভারের মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই ছবিতে চরিত্রদের কথোপকথন নিছক সংলাপ থাকে না, তা হয়ে ওঠে বার্তা এবং প্রকাশ করে পরিচালকের রাজনৈতিক অবস্থান।

‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়গুণ

সূর্যকন্যা ছবিতে কবির পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি শোষণের সমালোচনা তুলে ধরেছেন। বাস্তবের এই টিকে থাকা সমস্যা দেখানোর জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন একটি ফ্যান্টাসি কাহিনি। এমন রূপকধর্মী কাহিনির মাধ্যমে সমালোচনা তুলে ধরার কৌশল ছিল বাংলাদেশি ছবিতে নতুন। রূপালি সৈকতে ছবির নির্মাণশৈলী নতুনত্বের দিক থেকে অতিক্রম করে গিয়েছিল কবিরের আগের ছবিগুলোকেও। বাংলাদেশের বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্মিত খুব কম ছবিতেই রূপালি সৈকত-এর মতো জটিল নির্মাণশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন দিক দেখানোর মাধ্যমে এই ছবি হয়ে উঠেছিল সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ। এই জটিল কৌশল বাংলাদেশের ছবিতে ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। অথচ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শৈল্পিক ছবিতে এটি ব্যবহৃত হয় আলমগীর কবির এখন থেকে ৩৯ বছর আগেই নিজের চলচ্চিত্রে তা ব্যবহার করেছিলেন।
চলচ্চিত্রের মধ্যে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন প্রসঙ্গ এবং অন্য চলচ্চিত্রের দৃশ্য বারবার দেখানোর মাধ্যমে নির্মাণশৈলী অভিনব আর আত্মবাচক করে তোলা হয়েছিল সৈয়দ সালাহ্উদ্দিন জাকীর ঘুড্ডি (১৯৮০) ছবিতেও। এই ছবিতে একদিকে যেমন ব্যবহার করা হয়েছিল জনপ্রিয় ছবির বিভিন্ন উপাদান, তেমনি বারবার বিভিন্ন সংলাপ আর দৃশ্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছিল রাজনৈতিক আর সামাজিক সমালোচনা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দৃশ্যে পরোক্ষভাবে সমালোচনা করা হয়েছে কেবলই মুনাফাপ্রত্যাশী ফর্মুলানির্ভর মূলধারার চলচ্চিত্রের। রূপালি সৈকতে অতীতের ঘটনাবলিকে রূপক হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান সময়ে টিকে থাকা একই রকমের রাজনৈতিক সমস্যার প্রতি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আর ঘুড্ডি ছবিতে সরাসরি তুলে ধরা হয়েছে সমকালীন বাস্তবতা। ঢাকা শহর এখানে হয়ে উঠেছে যেন একটি স্বতন্ত্র চরিত্র। শহরের বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমেই তুলে ধরা হয়েছে হতাশা আর রাজনৈতিক শঠতার সমালোচনা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নির্মিত বেশির ভাগ বিকল্প ধারার ছবির কাহিনি গ্রামকেন্দ্রিক। শহর কখনো কোনো ছবিতে দেখানো হলেও এর অস্থির, জটিল, নির্দয় রূপ এবং এখানে মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা কার্যকরভাবে দেখানোর পরিবর্তে বরং দেখানো হয়েছে চাকচিক্যময় চেহারা। কিন্তু সূর্যকন্যা, রূপালি সৈকতে, ঘুড্ডি, শেখ নিয়ামত আলীর দহন (১৯৮৫) শহরের পটভূমিতে তুলে ধরেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন বৈষম্য আর হতাশার বিবরণ। শহরের রূপ কার্যকরভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে অন্য অনেক সমকালীন চলচ্চিত্র থেকে আলাদা হয়ে ওঠা আরেকটি ছবি হলো এনামুল করিম নির্ঝরের আহা! (২০০৭)। আগ্রাসী নগরায়ণের নির্দয় প্রভাবে হারিয়ে যাওয়া ঢাকা শহরের পুরোনো রূপ আর নদীর দূষিত হয়ে ওঠার হতাশাজনক বিবরণ উঠে এসেছে এই ছবিতে। বিভিন্ন দৃশ্যে দুর্বোধ্য কিছু রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালক দর্শককে চিন্তা করতে বাধ্য করেছেন। ছবির শেষ দৃশ্যও তৈরি করে অস্পষ্টতা। এই দুর্বোধ্যতা যে অস্থিরতা তৈরি করে দর্শক-মনে, তাই যেন টিকে আছে বর্তমান শহরে, যেখানে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বস্তি আর প্রকৃতির স্নিগ্ধতা। নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে পরিচালক কার্যকরভাবেই সৃষ্টি করেন ছবির বক্তব্য।

‘মাটির ময়না’ ছবির দৃশ্য

বাংলাদেশে নির্মিত খুব গুরুত্বপূর্ণ ছবি সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯)-তে গ্রামীণ জীবনে টিকে থাকা শোষণ, হতাশা, নির্যাতন, আশা, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তুলে ধরা হয়েছে ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সূচিত নয়াবাস্তববাদী শৈলীর মাধ্যমে। গ্রাম এই ছবিতে লাভ করেছে এক স্বতন্ত্র মাত্রা। অভিনয়ের সাবলীলতা, সংলাপের গভীরতা, গ্রামের দৃশ্যের বিশ্বস্ত উপস্থাপন, বিভিন্ন প্রতীক আর শটের মাধ্যমে অর্থ নির্মাণের পাশাপাশি এখানে প্রকাশ করা হয়েছে দেশভাগের সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুচিন্তিত সমালোচনা। গ্রামীণ জীবন উঠে এসেছে তারেক মাসুদের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র মাটির ময়না (২০০২)-তেও। অতীতকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে পরিচালক বর্তমান সময়ে টিকে থাকা সমস্যার সাহসী সমালোচনা এই ছবিতে তুলে ধরেছেন। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং সংকীর্ণতার সমালোচনা তুলে ধরতে গিয়ে তারেক মাসুদ বিভিন্ন রূপকের সাহায্যে আলো আর অন্ধকার, মুক্তচিন্তা আর বদ্ধচিন্তার পার্থক্য বারবার প্রকাশ করেছেন। কাজী সাহেবের ঘরের জানালা বারবার বন্ধ করা আর খোলা, রাস্তায় এক দৃশ্যে কাজী সাহেবের পেছনের দেয়ালে হালকা বিনোদনধর্মী ছবির পোস্টার আর উল্টো দিকের দেয়ালে তার ছোট ভাই মিলনের পেছনে দেখতে পাওয়া ধারালো রাজনৈতিক সেøাগান, মাদ্রাসায় শূন্যে বল দিয়ে রোকনের খেলা আর তার আলাদা জগৎ, মাদ্রাসার দুজন শিক্ষকের ভিন্ন ধরনের মানসিকতা এবং অবস্থান প্রভৃতি নির্দিষ্ট অর্থ সৃষ্টি করে। ছবির কাহিনির এগিয়ে চলাও গতানুগতিক নয়। একটি দীর্ঘ ফ্ল্যাশব্যাক ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে। মাসুদ যে লোকজ গানগুলো ছবিতে ব্যবহার করেছেন, তা ছবির বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায় অর্থাৎ দর্শককে বিনোদন দেওয়ার পরিবর্তে গান এই ছবিতে হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকৌশল, যার মাধ্যমে উঠে আসে নির্দিষ্ট অর্থ। মাটির ময়নার সাহসী বিষয়বস্তু এভাবে আরও কার্যকর হয়ে ওঠে নির্মাণশৈলীর নতুনত্বের জন্য।
বাংলাদেশে নির্মিত এই চলচ্চিত্রগুলোতে কাহিনি আর চলচ্চিত্রভাষা- দুটি দিককেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে চলচ্চিত্রগুলো হয়ে উঠেছে সুনির্মিত। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে এই প্রশ্নটি করতে হয়- বাংলাদেশে বর্তমানে নির্মিত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে নির্মাণশৈলী নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় ও উদ্ভাবনী করে তোলার জন্য কতটা সচেতনভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে? বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বর্তমানে প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কিন্তু মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কি উঁচু মানের ছবি হিসেবে স্বীকৃতি আর প্রশংসা অর্জন করতে পারছে? বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রতাত্ত্বিকেরা এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে অবগত থাকলেও বাংলাদেশের চিন্তাশীল চলচ্চিত্র কতটা পরিচিত তাদের কাছে? অনেক আগেই সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল বাংলা চলচ্চিত্রকে যেমন বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের ছবির গভীরতা আর নান্দনিকতার জন্য, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখনো তেমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। বাংলাদেশের নতুন সময়ের পরিচালকদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন যে, কোন কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে কোনো চলচ্চিত্র বিশ্বমানের হয়ে উঠতে পারে। জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক মাসুদ, মসিহ্উদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, সৈয়দ সালাহ্উদ্দীন জাকী, তারেক মাসুদ প্রমুখ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার তাদের কাজ যেমন বক্তব্য আর নির্মাণশৈলী- দুই দিক দিয়েই ভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন, সেই উদাহরণও অনুপ্রাণিত করতে পারে এই দেশের নতুন সময়ের চলচ্চিত্রনির্মাতাদের। চিন্তাশীল পরিচালকেরা এতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, আমরা সেই প্রত্যাশাই করি।

লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top