skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I ব্যক্তিগত ডাকনাম

আদর করে কাছের মানুষটিকে আমরা কত নামেই না ডাকি! তা হোক শিশুতোষ কিংবা উদ্ভট—প্রেমের প্রকাশে এর চেয়ে অব্যর্থ আর কিছু তো নেই। লিখেছেন সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন

ঝাঁ-চকচকে এক আধুনিক ক্যাফেতে বসে আছি। একটু দূরেই টেবিলে এক তরুণ কপোত-কপোতী বসে আছে। মেয়েটি ছেলেটির শ্মশ্রুমন্ডিত গালে বড্ড আদরে হাত বোলাতে বোলাতে আহ্লাদি স্বরে বলল, ‘আমার তমি, তমি সোনা…’ (আমার টমি, টমি সোনা)। আর ছেলেটি যেন সেই আদরে আটখানা। আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটিও কৃত্রিম সারমেয় কণ্ঠে ‘ভৌ, ভৌ’ করে প্রেমিকার আদরের জবাব দিয়ে দিল। বুঝলাম, এ হচ্ছে প্রেমিকার আদরের ডাক। এখন যদি আমি গিয়ে ছেলেটাকে টমি বলে ডাক দিই, তাহলে কিন্তু উত্তরটা শুধু ভৌ ভৌ-এ সীমিত থাকবে না, টমি কামড়েও দিতে পারে। ওই ডাক শুধু প্রেমিকার জন্য বরাদ্দ। ব্যক্তিগত ডাকনাম। আমার এক খুব কাছের বন্ধুকে তার স্ত্রী বিয়ের ২০ বছর পরে এসেও ‘কইজ্জু’ বলে ডাকে। কলিজা থেকে কলিজু সেখান থেকে কইজ্জু। ওদের প্রেম বেঁচে থাকুক হাজার বছর।
অতীতে এই ধরনের ডাকনামের এমন উচ্ছ্বাস শুধু দেখতে পেতাম বাড়িতে কোনো ফুটফুটে বাচ্চা এলে। কাছের মানুষদের সবার কাছে তার জন্য একটা করে আলাদা আলাদা অদ্ভুতুড়ে নাম থাকে। অনেক সময় আজীবন সেই নাম রয়ে যায়—ঠান্ডু, ডাব্বু, পটোল কিংবা নিদেনপক্ষে খোকা। এইসব নামের ভিড়ে কখন যে সেই গাল ভরা ভারি নামটা হারিয়ে যায়, তার খোঁজই পাওয়া যায় না। পঞ্চাশ বছর বয়সের বিশাল গোঁফওয়ালা রাশভারী মানুষটার নাম জানা গেল ঠান্ডু মামা! ভাবা যায়! আমার একমাত্র শ্যালকের নাম ক্যাসপার; কারণ, জন্মের সময় এত ধবধবে ফর্সা বাচ্চা দেখে কোনো এক চাচা মজা করে বলেছিল, ‘আরে, এ তো একদম ক্যাসপার দ্য ফ্রেন্ডলি ঘোস্ট’, ব্যস, সেই থেকে নাম ক্যাসপার। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আজকের ৩৮ বছরের ক্যাসপারকে তার স্ত্রী এমন কোনো আদরের নামে ডাকে, যা আমাদের শোনাই হয়নি কখনো। ওই নামটা ক্যাসপারের জন্য তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত। আমার ধারণা, ভালোবাসায় দেওয়া ভালোবাসার এই ব্যক্তিগত ডাকনামের চল আগেও ছিল, কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের ওই ভিড়ে এবং চাপে সেই নাম জানা যেত না। কিন্তু আজকের এই শহুরে নিউক্লিয়ার পরিবারের উদ্ভব, সম্পর্কের সমান্তরালতা এবং আধুনিক সমাজে বিবাহ-পূর্ববর্তী নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্কের সামাজিকায়নের কারণেই বোধহয় এসব—সোনু, জান, পাখি, ময়না, কুশু, জান বাচ্চা ইত্যাদি নানান নামের বেশ বড়সড় মানুষদের আমরা হরহামেশা দেখতে পাচ্ছি। আমার অবশ্য এই ধরনের ডাকনাম অন্য কারণে ভালো লাগে; এসব নামে ধর্ম, বংশ, বর্ণের কোনো লেশমাত্র থাকে না। সবাই শুধুই মানুষ। আবার আধুনিকতার চক্করে উল্টোটাও হয়। একই মানুষের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সোনা, ময়না, জান বাচ্চা থাকে। গুলশানের কোনো পার্টিতে হঠাৎই হয়তো কোনো সুন্দরী নারী জান বাচ্চাকে খোঁজার জন্য ডাক দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ৩-৪ জন পুরুষ ‘আসছি’ বলে একসঙ্গে ছুট লাগালেন! ভাবুন অবস্থাটা। তা হোক, তবু ভালোবাসা বেঁচে থাকুক। ঘৃণায় ভরা এই যুদ্ধবিগ্রহের পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। আমার একটা অযৌক্তিক বিশ্বাস হচ্ছে, ট্রাম্প আর খোমেনি যদি দুজন দুজনকে এ রকম ঠান্ডু, ডাব্বুর মতো কোনো নামে ডাকতে শুরু করে, দেখবেন ইরান-আমেরিকার মধ্যে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে। আসলে আমাদের সবার মধ্যেই তো সেই চিরকালীন নিষ্পাপ শিশু কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে, যার কাছে একমুঠো চকলেট, একমুঠো মোহরের চেয়ে বেশি ভালোবাসার। সে আসলে শান্তি চায়, উৎসব চায়, আনন্দে, ভালোবাসায় বাঁচতে চায়, ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার ব্যক্তিগত নামে ডেকে ভালোবাসার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ভালোবাসার তাজমহল বানাতে চায়। আর তাই তো আজও শেষ পর্যন্ত জয় ভালোবাসারই হয়। লাইলী-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট কিংবা মাদার তেরেসারা ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় স্মরণীয় হন; আর হিটলার, মুসোলিনীদের কথা একই অর্থে কেউ মনেও রাখে না।
শেষ করতে চাই একটা ব্যক্তিগত গল্প দিয়ে। আমি আমার স্ত্রী ফিমাকে আদর করে ফাইমক্সিল বলে ডাকি। এই অদ্ভুত নামে ডাকতে ডাকতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, বাইরে অনেক সময় মনের অজান্তেই ওই নামে ডেকে ফেলি। অনেকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘এ আবার কেমন নাম? এটা তো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নাম!’ আমার ভাই সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘আমার মতো মানুষের জীবনে ভাগ্যে পাওয়া এমন স্ত্রী তো অ্যান্টিবায়োটিকের কাজটাই করে, নাকি?’

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গ্রে ঢাকা

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top