skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I লাহাবাড়ির এক টুকরো গল্প

দুর্গাপূজার ঐতিহ্যে লাহাবাড়ির অবদান প্রশ্নাতীত। এখনো টিকে আছে, যদিও আগের ঐশ্বর্য নেই। লিখেছেন পাঞ্চালি দত্ত

সুবর্ণ বণিক সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তিই ছিল স্বর্ণবাণিজ্য। ব্রহ্মপুত্র তট সে যুগে বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। চীন, আরাকান, ব্রহ্মদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এখানে আসা-যাওয়া করতেন। এদের সংস্পর্শে এসে বণিকশ্রেণির যথেষ্ট অর্থাগম হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে সুবর্ণগ্রাম অল্প সময়েই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কালক্রমে বাণিজ্যপোতের গন্ডি আরও ছাড়িয়ে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল জাভা, সুমাত্রা, বালি, বাগদাদ, রোম পর্যন্ত। কিন্তু বল্লাল সেনের আমলে সুবর্ণ বণিক সমাজের এক বৃহদংশ সুবর্ণগ্রাম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
তাদের একটি দল বর্ধমানের কাছে কর্জনা নগরীতে আসে এবং দু-তিন শ বছরের মধ্যে এখানে বণিকসমাজ গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে সরস্বতী নদীতীরের সপ্তগ্রাম বিখ্যাত বন্দরে পরিণত হয়। গড়ে ওঠে ব্যবসা। বসতি গড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় এক-একটি বাজার বা গঞ্জ। সেখানে বাড়ে দোকানপাটের ভিড়, মহাজনদের আড়ত। বণিকদের নৌকার আনাগোনা অর্থাৎ সুবর্ণ বণিকে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে গ্রাম। ষোড়শ শতাব্দী অবধি এটাই ছিল ইউরোপীয় বাণিজ্যবন্দর; নাব্যতা ও প্রশস্ততার কারণে এ নদীতেই জাহাজ চলাচল করতো। কালক্রমে সরস্বতী নদী শীর্ণ হতে থাকায় পর্তুগিজরা হুগলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থানান্তর করে। কাশিমবাজারে চলে যায় ইংরেজরা আর কালিকাপুরে ওলন্দাজরা। পাশাপাশি সেতাখাঁর বাজারে আরমেনিয়ানরা ও ফরাসডাঙ্গায় ফরাসি কুঠি পত্তন করে। অবশ্য চুঁচুড়ায় ওলন্দাজ, শ্রীরামপুরে দিনেমার ও চন্দননগরে ফরাসিরা কলোনি গড়ে তোলে। বণিকেরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে নতুন বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে। অতঃপর ইউরোপীয় বণিকেরা সাগর থেকে সরস্বতী নদীতে প্রবেশের আগে সাঁকরাইল থেকে গঙ্গার বর্ধমান শাখা দিয়ে গঙ্গার এপার-ওপার হুগলি, চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, কলকাতা ইত্যাদিতে বাণিজ্য করতে শুরু করে। ইংরেজ আধিপত্যে কলকাতা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র। বিভিন্ন প্রবাহে ও বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীর আশীর্বাদে ‘লাহা’ সম্প্রদায় জন্ম নেয়। মহানন্দ লাহা হলেন এই পরিবারের আদি পুরুষ। বঙ্গে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এই জমিদার বাড়িগুলো। তখন বঙ্গের আয়তন ছিল আরও বড়। ঐশ্বর্যের ভারে, বনেদিয়ানায় সুজলা-সুফলা মাটিতে সোনা ছড়াতেও তারা কার্পণ্য করেননি। নানা রকম ধর্মীয় উৎসব লেগেই থাকতো। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল দুর্গাপূজা। নানা উপচারে, বনেদিয়ানার মেজাজে ধর্মীয় উৎসবগুলো নিয়মে পরিণত হয়েছিল। তাই এখনো আমরা বনেদিবাড়ির প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলেই দেখতে পাই শ্বেতপাথরে মোড়া ঠাকুরদালান। বিভিন্ন পূজায় নানা উপচারে ভরে উঠত ঠাকুরদালান। কালক্রমে ইংরেজদের সঙ্গে ওঠাবসার ফলে দুর্গাপূজা অনেকটাই হয়ে গিয়েছিল আত্মগরিমা, জাত্যভিমান, প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্য প্রদর্শনের প্রয়াস; পাশাপাশি বনেদিবাড়ির মধ্যে লেগেছিল প্রতিযোগিতা। কালের নিয়মে জল বয়ে গেছে অনেক; ক্ষীণ হয়ে এসেছে স্রোত, নদীতে পড়েছে চর- তবু বেশ কিছু নিয়মকানুন এখনো মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন লাহা পরিবারের সদস্যরা।
উত্তর কলকাতার বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে লাহাবাড়ি। প্রতিটি থাম, দরজা, ইট, খিলান, ঠাকুরদালান মনে করিয়ে দেয় ইতিহাস। হ্রেষাধ্বনি, ঠাকুর-চাকরদের সিঁড়িভাঙা, বড় বড় হাঁড়িতে রান্নার শব্দ, ঝুলবারান্দার কোণে পিঞ্জিরায় পাখিদের কিচিরমিচির কান পাতলে এখনো শোনা যায়।
লাহা পরিবারের দুর্গামূর্তির বিশেষত্ব হলো শিবের কোলে শান্তিরূপিণী গৌরীর আশীর্বাদ মুদ্রায় উপবেশন। আর শিব উপবিষ্ট বৃষপৃষ্ঠে। মা তার সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে একই চালচিত্রে রয়েছেন। এখানে শিব-দুর্গাকে সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ষষ্ঠীর দিনে দেবীকে সুসজ্জিত করা হয় নানা অলংকার ও বসনে। পুরোহিতদের দান করা হয় আতপ চাল, ঘি, চিনি, দুধ, ফল ইত্যাদি। মায়ের ভোগে থাকে নানা রকম ফল, চুরের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুগের নাড়ু, ছোলার নাড়ু, গুঁড়া চাল, গুড় ও নারকেল দিয়ে বানানো বুটের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া, বেলা পিঠা, জিবে গজা, পান গজা, ছোট গজা, চৌকো গজা, চিরকুট গজা, প্যারাকি, চিনির মুড়কি। এ ছাড়া থাকে লুচি, কঢ়ুরি, সেদ্ধ ছোলা, কুমড়োর ছোঁকা, বেগুনির ফুলুরি, বেগুনভাজা, আলুভাজা, পটোলভাজা ও ডাবের জল। উত্তর কলকাতার ঘটিদের নিয়ম হচ্ছে, ব্রাহ্মণ না হলে ঈশ্বরকে অন্ন পাক করে দেওয়া বারণ। এ জন্য স্তূপ করে মায়ের সামনে রাখা হয় কাঁচা চাল। সপ্তমীর দিন মাকে স্নান করানো হয় ঘি, দই, দুধ, মধু, নারকেলের জল, আখের রস, চিনি আলতা, ধূপ, সরিষা, জব, সুপারি ইত্যাদি দিয়ে। সেদিন ছাঁচি কুমড়া ঝাল দেওয়া হয়। তারপর নৈবেদ্য, ভোগ ও মিষ্টান্ন মাকে নিবেদন করা হয়। এভাবেই পূজার প্রতিদিন নানাবিধ উপচারে মাকে সাজিয়ে দেওয়া হয় খাবার।
দশমীর দিন বেলা সাড়ে ১১টার ভেতর সব পূজা সম্পন্ন করে ঠাকুরঘরে কুলদেবীকে শয়ন করানো হয়। এরপর গৃহবধূরা দেবীর হাতে জোড়া খিলি ও মুখে পান, নাড়ু দিয়ে, কপালে সিঁদুর, হলুদ ও দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে মাকে বরণ করেন। বিকেল চারটা নাগাদ প্রতিমা নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হয়। বাঁশে গড়ি বেঁধে দোলনা তৈরি করে তার ওপর প্রতিমা বসিয়ে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়। মূর্তিকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির সমস্ত দ্বার ও সদর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিমা বিসর্জনের পর দেবীঘট নিয়ে সদস্যরা বাড়ি ফিরে আসার পর বাড়ির কর্তা বন্ধ দ্বার থেকে প্রশ্ন করেন, ‘মা আছেন ঘরে?’ বাড়ির ভেতর থেকে কেউ বলেন, ‘মা আছেন ঘরে।’ তারপর বাড়িতে সবাই ঢোকেন। বিশ্বাস যে, মাকে বিসর্জন দিলেও তিনি সব সময়ই লাহাবাড়িতে অধিষ্ঠাত্রী। তাঁর আশীর্বাদে ভরিয়ে রাখেন বাড়ি। তারপর প্রণাম ও কোলাকুলি শেষে মিষ্টিমুখে বছরের পূজা শেষ হয়। এভাবেই পূজা চলছে যুগের পর যুগ ধরে। অবশিষ্ট যা কিছু রয়েছে, এখনো যত্নসহকারে টিকিয়ে রাখাই এই বাড়ির প্রয়াস আর সেটাই কলকাতার গর্ব। রিকশায় ঠং ঠং আওয়াজে বাড়ি পেরিয়ে যখন যাই, কলকাতার সাবেকি রূপ, ঐতিহ্য আর বাবু কালচার… মনে পড়িয়ে দেয় বারবার। দমকা হাওয়ায় পুরোনো কলকাতার গন্ধ মনকে আচ্ছন্ন করে দেয় কিছুক্ষণের জন্য।

লেখক: কলকাতার হ্যাংলা হেঁশেলের সাংবাদিক

কৃতজ্ঞতা: সুস্মেলি দত্ত, লাহাবাড়ির মেয়ে
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top