skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I হাতের মুঠোয় বিশ্বরসনা

বিচিত্র স্বাদের খাবার এক আঙিনায়। ঢাকার ফুড কালচারে এ এক নতুন অধ্যায়। লিখেছেন সামীউর রহমান

শার্টের কাট থেকে প্যান্টের ফিটে যেমন বদল চায় ফ্যাশনবিলাসীরা, তেমনি স্বাদের বদল খোঁজে ভোক্তার রসনাইন্দ্রিয়। গত কয়েক বছরে ঢাকার রেস্তোরাঁ সংস্কৃতিতেও এসেছে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। একটা নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টের বদলে ফুড কোর্টগুলোতেই এখন তারুণ্যের ভিড়। খাওয়া, আড্ডা, গানবাজনায় জমজমাট সব ফুডকোর্টই রাজধানীর নতুন হ্যাপেনিং প্লেস; ফুড ট্রেন্ডের ঠিকানা। যেখানে এক আঙিনায় মিলছে রকমারি রসনার পসরা। নানা দেশের, নানা সংস্কৃতি আর স্বাদের পদ চেখে দেখার সুযোগ। সেই সঙ্গে বাড়ছে অনলাইনে খাবার অর্ডারেরও প্রবণতা।
আদালতের ইংরেজি কোর্ট শব্দের সঙ্গে পরিচয়টা হয়ে যায় অজান্তেই। শীত মৌসুমে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কেটে খেলার অভ্যাসটা এখনো টিকে আছে ক্রমেই কংক্রিটে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই শহরের কোনো কোনো জায়গায়। যানজটে স্থবির হয়ে পড়া এই শহরে, দুদন্ড স্বস্তির প্রলেপ নিয়ে আসে বাইরে কোথাও খেতে যাওয়ার সুযোগ। সেটা হোক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে। কাচঘেরা অফিস ঘরে হাঁপিয়ে ওঠা মন অনেক সময় রেস্তোরাঁর আবদ্ধ পরিবেশেও ছটফট করে। তাই তো শহরের নানান প্রান্তে তৈরি হওয়া ফুড কোর্টগুলোতে অনেকেই ছুটির দিনের বিকেল বা সন্ধ্যায় ছুটে আসেন খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার আকুলতা নিয়ে। বেড়ানো, খানিকটা খাওয়া, একটু আড্ডা—এসবই তো পরের সপ্তাহের টনিক!
বসুন্ধরা শপিং মলের বিশাল ফুড কোর্টে ছুটির দিনে জায়গা মেলাই কঠিন। শর্মা হাউজ, ঢাকাইয়া, বিএফসির মতো বড় বড় ফাস্ট ফুড শপ এখানে সাজিয়েছে পসরা। যমুনা ফিউচার পার্কের ফুড কোর্টেও হাজির সব বড় বড় নাম। সিনেমা দেখা, শপিং শেষে বাড়ি ফিরে রান্নার ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকেই উদর পূর্তি করে যান এসব ফুড কোর্ট থেকেই। তবে তারুণ্যের আড্ডা জমে শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে। মিরপুর ডিওএইচএসের ঠিক বাইরে আছে বেলা শেষে ফুড কোর্ট, কালশী নতুন রাস্তার ধারে আছে কাজী অ্যাসপারাগাস ফুড আইল্যান্ড। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ঠিক বাইরে, অ্যাপোলো হসপিটালের দিকে আসার রাস্তায় আছে মেট্রো কিচেনস, গ্রামীণফোন অফিসের পেছনে রাজবাড়ী ফুড কোর্ট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ঢোকার আগে আছে আরবান ভয়েড, মোহাম্মদপুর-বছিলা রোডের নতুন সেতুর কাছে মধু সিটি ফুড কোর্ট, ধানমন্ডি লেকের ধারের ডায়নামিক ফুড কোর্ট, কাজী অ্যাসপারাগাস ফুড আইল্যান্ড উত্তরা; এমন অনেক জায়গায় আজকালের তারুণ্যের একেকটা ‘কফি হাউজ’। কোথাও খাবারের সঙ্গে আছে গানবাজনা আর বড় পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থা। কোথাও-বা বাচ্চাদের জন্য খেলার জায়গা।
পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফিট রাস্তার যেদিকটায় বসুন্ধরা কনভেনশন সিটি, সেদিকটাতেই একসময় ছিল পাশাপাশি দুটি ফুড কোর্ট। কাজী ফুড আইল্যান্ড আর অ্যাসপ্যারাগাস। বসুন্ধরা এলাকায় বেশ কয়েকটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস; ক্লাসের পর তাদেরই আড্ডা জমতো এই দুটো জায়গায়। খোলা উঠোনের তিন দিকে খাবারের দোকান, একেক দোকানে একেক রকম খাবারের পসরা। কোথাও সাব, স্যান্ডউইচ আর পটেটো ওয়েজেসের মজা তো অন্য জায়গার চিকেন তন্দুরি আর পরাটা। রাস্তা বড় করার জন্য দুটি ফুড কোর্টই তুলে দিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীরা মিলে একসঙ্গে করেছেন কাজী অ্যাসপারাগাস ফুড আইল্যান্ড। একটা কালশী নতুন রাস্তায়, অন্যটা উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সীমানাদেয়ালের ঠিক বাইরে, অ্যাপোলো হসপিটালের দিকের রাস্তাটায় একটা গলি ধরে একটু এগোলেই মেট্রো কিচেনস। মেজবানি মাংস ও চুইঝালের মাংসের খোঁজে যারা চিটাগং এক্সপ্রেস আর চুইঝালে ঢুঁ মেরেছেন, তাদের জায়গাটা চিনতে পারার কথা। সেখানেই অনেকগুলো কার্গো কনটেইনারে একেকটা খাবারের দোকান নিয়ে মেট্রো কিচেন। মাঝে খোলা উঠোনে চেয়ার টেবিল পাতা। ঘিরে আছে ছোট ছোট সব খাবারের দোকান। কোথাও চাপ লুচি, কোথাও মোমো, চাউমিন তো কোথাও আবার বার্গার পিৎজা।
ফুড কোর্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে উন্মুক্ত পরিবেশে আড্ডার উপযুক্ত পরিবেশ! রেস্টুরেন্টের দেয়ালঘেরা পরিবেশে যেটা অনেকটাই বেমানান। ওয়েটারদের উৎপাত নেই, কারণ বেশির ভাগ দোকানই চলে সেলফ সার্ভিস পদ্ধতিতে। কিংবা বসবার জায়গাটা দেখিয়ে দিলে দোকানিই পৌঁছে দেন। বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতে বসলেও অনেক সময় দেখা যায়, কোন খাবারটা নেওয়া হবে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণাই করতে হয়! ফুড কোর্টগুলো এদিক থেকে বেশ সুবিধাজনক। কারণ, হরেক রকমের দোকান তো আছে হাতের নাগালেই। পিৎজা না বার্গার, টিক্কা না চাপ; এই প্রশ্নের সমাধান মজুত। অনেক দোকান একই জায়গায় হওয়ায় খাবার পাওয়া যায় প্রতিযোগিতামূলক দামে, যেটা পকেটের জন্যও সাশ্রয়ী।
বন্ধুদের আড্ডায় মুখ চালাতে পটেটো ওয়েজেস বা মাসালা ওয়েজেসটাই নাকি চলে বেশি! সঙ্গে গরমে কোল্ড কফি কিংবা জুসের দারুণ কদর। শীতে আবার গরম গরম ধোঁয়া ওঠা মোমোর চাহিদা বেশ বাড়ে। সাব-স্যান্ডউইচ, চাওমিন, চিকেন উইংসও কখনো হয়ে ওঠে আড্ডার সঙ্গী। রাইস বোল, শর্মা, গ্রিল ফিশ, স্টেকসহ আরও অনেক খাবারই মেলে এই ফুড কোর্টগুলোতে।
আশির দশকের শেষটায় ঢাকা শহর দেখেছিল ‘চৈনিক আগ্রাসন’। ভিনদেশি খাবার বলতেই তখন চায়নিজ রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারির খেলা। নব্বইয়ের মাঝামাঝি ইতালিয়ান পিৎজার কদর বাড়লো। পাড়ার মোড়ের বেকারি বা কনফেকশনারিতেও কাচের র‌্যাকে ঠাঁই পেল বনরুটির উপর ভাজা পেঁয়াজের মসলা মাখানো ‘পিৎজা’! শর্মা হাউজ, নিউমার্কেটের কস্তুরির কল্যাণে লেবানিজ শর্মাও জায়গা করে নিল বাঙালি রসনায়। এই বিদেশি আগ্রাসনকে হঠাৎ করেই পেছনে ঠেলে দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠল দেশীয় রসনা। শহরের এমাথা-ওমাথায় গজিয়ে উঠতে লাগলো মেজবানি স্বাদ আর বিয়েবাড়ির খাবারের রেস্তোরাঁ। সুলতানস ডাইন, ট্র্যাডিশন বিডির মতো রেস্টুরেন্টগুলোতে বিয়েবাড়ির কাচ্চি আর রোস্ট খেতে অনেকেই হন্যে হয়ে ছুটেছেন। মেজবানি কালাভুনায় মন মজাতে দৌড়েছেন নবাব চাঁটগা ও চিটাগং বুলসে। এখন আবার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কফিশপ আর ফুড কোর্ট।
নানান স্বাদের, বিভিন্ন ভোক্তাশ্রেণির কথা মাথায় রেখে রেস্তোরাঁ বাড়ছে ঢাকায়। এখন খোদ রাজধানীতে বসে আরবি খানা থেকে শুরু করে জাপানি রসনা— সবকিছুরই স্বাদ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। শুধু দিন দিন কঠিন হচ্ছে ঘর থেকে বেরিয়ে দু পা ফেলা! বাড়ছে যানজট। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পছন্দের রেস্তোরাঁয় খাবারটা খেয়ে বাড়ি ফেরা— সব মিলিয়ে যে ঘণ্টা তিনেকের ঝক্কি! এর চেয়ে রেস্তোরাঁর খাবার বাড়ি আনিয়ে নিলেই তো হয়। ক্রমেই কসমোপলিটান হয়ে ওঠা ঢাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফুডপান্ডা বা হাংরিনাকির ডেলিভারি মোটরবাইক কিংবা সাইকেল এখন চোখে পড়বে হররোজই। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও, উবার শুরু করেছে তাদের ফুড ডেলিভারি সেবা, পাঠাও ফুডস এবং উবার ইটস নামে। রেস্তোরাঁ তাই চলে এসেছে হাতের মুঠোয়!
সামান্য চার্জের বিনিময়ে এখন রেস্তোরাঁর খাবার বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু তা-ই নয়, ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়াতে নিয়মিতই ছাড় কিংবা বিনা পয়সায় ডেলিভারির মতো সুবিধাও দিচ্ছে তারা। তাই যানজট এড়িয়ে ঘরে বসে পছন্দের সিরিয়াল দেখতে দেখতেই হাজির হয়ে যাচ্ছে মনমতো খাবার। সামনের দিনগুলোতে এই চাহিদা আরও বাড়বে বলেই মত বিশ্লেষকদের। শুধু রেস্তোরাঁর খাবারই নয়, বাড়িতে তৈরি খাবারও বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে, পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার দোরগোড়ায়। ‘কুক আপস’ফেসবুক পেজে অনেক গৃহিণী, শখের রাঁধুনি হাজির হচ্ছেন তাদের সিগনেচার ডিশ নিয়ে। কেউবা বিক্রি করছেন ঘরে বানানো আচার, হিমায়িত খাদ্যপণ্যসহ অনেক কিছু। বাসায় রান্না করতে ইচ্ছে করছে না আবার রেস্টুরেন্টের খাবারও মুখে রুচছে না, এমন পরিস্থিতির চটজলদি সমাধান হয়ে উঠেছে এই ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন ফুডশপগুলো। জন্মদিনে অফিসে সহকর্মীদের আপ্যায়ন থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে ফেরা বন্ধুর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার অবসর খুঁজে নিতে রান্নার ভারটা অনেকেই নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিচ্ছেন এসব বাড়িতে তৈরি খাবার সরবরাহের প্রতিষ্ঠানের ওপর। বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ব্যবসাটা শুরু করেছেন ফেসবুকে; সাড়াও পাচ্ছেন ভালোই।
একসময় পেপসির একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল; এই মন চায় যে মোর! ফুডকোর্টগুলো যেন সেই বিজ্ঞাপনেরই প্রতিফলন। এখন ক্রেতারা শুধু এক পদে খুশি নয়, তাই বাহারি আয়োজনে সবকিছুকেই এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। আরও ছোট তা হয়ে ঢুকে গেছে মুঠোফোনের পর্দা আর অ্যাপসে!

লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top