skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I হে নগর, ধীরে

দুনিয়াজুড়ে এখন বইছে পরিবেশ রক্ষার হাওয়া। যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত, বিশুদ্ধ আর প্রাকৃতিক শহর গড়ে তোলার প্রয়াস। লিখেছেন ড. দিলরুবা নাসরিন

সারা দিন কতশত শব্দ শুনি, অল্প কিছু হৃদয়ের গহিনে নাড়া দেয়। ‘চিটাস্লো’ শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম মিডেন-ডেলফল্যান্ডের নগরপিতা (মেয়র) মি. আরনউড রডেনবারগের কাছে। হেগের ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স কন্টাক্টের এক মিটিংয়ে নিজের এলাকা নিয়ে তিনি তার স্বপ্নের কথা বলছিলেন। ‘চিটাস্লো’ শব্দটা শুনেই আমার কেমন ঘোরের মতো হলো। হলভর্তি মানুষের মাঝখানে বসেও আমি যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি! মনের ভেতর শব্দটার রূপান্তর পষ্ট টের পাচ্ছি! মিটিংয়ের বাকি সব আবছা হয়ে গেল, আমি মনে মনে আওড়ে যাচ্ছি- ‘চিটাস্লো’, ‘চিত্তস্লো’, ‘ধীরে চলো মন’- ‘নাইয়া, ধীরে চালাও তরণী’!
সমুদ্রজয়ী একটি দেশের নাম নেদারল্যান্ডস। অর্ধেকের বেশি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে থাকা একটি দেশ। ডাচ জাতির কঠোর পরিশ্রমের ফলে আজকের উন্নত ভূখন্ড। সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করে তাতে বাঁধ দিয়ে ডাচরা দেশটিকে শুধু উন্নতই করেনি, বন্যামুক্ত রেখেছে কয়েক শ বছর। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি, সবুজ-শ্যামল একটি দেশ। চোখ বোলালেই বোঝা যায়, নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নে সরকার সদা সচেষ্ট। প্রকৃতি এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গাড়ির চেয়ে সাইকেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সব জায়গায় সাইকেলের আলাদা রাস্তা পথিকের নজর কাড়ে। রাস্তার পাশে সারি সারি উইন্ডমিল, যা দিয়ে বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এপ্রিল-মে মাসে পুরো দেশটি হয়ে যায় টিউলিপের বাগান। এত সুন্দর, সুপরিচিত দেশটির নাম নিয়ে কিন্তু একটি বিভ্রান্তি আছে। দেশটির নাম নেদারল্যান্ডস নাকি হল্যান্ড? নেদারল্যান্ডস নামের এই দেশটিতে মোট বারোটি প্রদেশ। শুধু দুটি প্রদেশের নামের অংশবিশেষ হল্যান্ড- একটি উত্তর হল্যান্ড, অন্যটি দক্ষিণ হল্যান্ড। বাকি দশটি প্রদেশের নামের আগে বা পিছে হল্যান্ড নেই। তবে কেন সেসব প্রদেশ বাদ দিয়ে শুধু হল্যান্ড নিয়ে এই বিভ্রান্তি! ধারণা করা হয়, এই বিভ্রান্তির জন্ম ডাচ স্বর্ণযুগ থেকেই। সে সময় ওলন্দাজ নাবিকেরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিত, তাদের বড় একটি অংশ ছিল দক্ষিণ বা উত্তর হল্যান্ডের অধিবাসী। যেহেতু সে সময় নেদারল্যান্ডস এখনকার মতো ঐক্যবদ্ধ রাজ্য ছিল না, নাবিকদের পরিচিতি ছিল নিজ নিজ এলাকার নামে। এভাবেই হল্যান্ড একটি দেশের নাম হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়। উত্তর হল্যান্ড ও দক্ষিণ হল্যান্ড আয়তনে অনেক বড় হওয়ায় পুরো দেশটির মানচিত্রের অনেকটুকুজুড়ে থাকে হল্যান্ড- হয়তোবা এটিও একটি কারণ। দেশটির সঠিক নাম নেদারল্যান্ডস!
ফিরে আসি মিডেন-ডেলফল্যান্ডে। এটি দক্ষিণ হল্যান্ডের ছিমছাম একটি শহর। এই শহরের নগরপিতা আরনউড রডেনবারগ যখন এলাকা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলছিলেন, দর্শকসারিতে বসে সবাই যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। একেই কি বলে স্বপ্নদ্রষ্টা! এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা তাঁর স্বপ্ন। প্রতিটি মানুষ নির্ভেজাল খাবার খাবে, বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেবে। একদিকে নাগরিক উপভোগ করবে উন্নত ও সুস্থ জীবন, সঙ্গে রক্ষা হবে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। নগরপিতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে চিটাস্লো আন্দোলন। মিডেন-ডেলফল্যান্ড নেদারল্যান্ডসের প্রথম চিটাস্লো শহর। ইতালিয়ান ভাষায় ‘চিটা’ যার মানে হচ্ছে সিটি (নগর), আর তার সঙ্গে ইংলিশ শব্দ ‘স্লো’ যোগ হয়ে আমাদের চিরপরিচিত নগরজীবনকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। এ যেন পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরা- ‘ধীরে ধীরে চল ঘোড়া’। চিটা স্লো একটি আন্দোলন, নাগরিক জীবনের মানোন্নয়ন যার মর্মবাণী। ইতালির অরভিয়েতো শহরে এর প্রথম যাত্রা শুরু ১৯৯৯ সালে। মাত্র ষোলো বছরে সারা পৃথিবীতে এর সদস্য সংখ্যা এখন দুই শর কাছাকাছি। উন্নত দেশগুলো চেষ্টা চালাচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাগরিক জীবনের মান উন্নয়ন করার। পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি উদ্ভিদ এবং জীব পরিচর্যা করে নাগরিকদের মানবিক গুণ উন্নত করাও এর একটি দিক। এই না হলে নগরপিতা!
আমাদের নগরজীবন যখন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে চলেছে উন্নয়ন নামের মরীচিকার পেছনে, তখন হঠাৎ কানের কাছে যেন গুনগুনিয়ে গেল এক সুমধুর হাওয়া ‘ধীরে, বন্ধু, ধীরে’! মিডেন-ডেলফল্যান্ড মিউনিসিপালটি আমার বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভিং পথ- শহর তো নয় যেন স্নিগ্ধ সুশীতল একটা গ্রাম।
ইদানীং আমি বারবার অতীতে ফিরে যাই, বিশেষ করে শৈশব-কৈশোরে। বয়স বাড়ার লক্ষণ কী! গতকাল এক ডাচ বন্ধু জিজ্ঞেস করল, তুমি তো মিউজিক পছন্দ করো, কোন বাদ্যযন্ত্র তোমার বেশি প্রিয়? অজান্তেই আমার মুখে এলো ‘কলা বাঁশি’! বলেই আমি অপ্রস্তুত। কবেকার সেই কলা বাঁশি, কোথায় লুকিয়ে ছিল সে! আমার মায়ের শখ ছিল তাঁর মেয়েরা গান শিখবে। মায়ের ছেলেবেলায় মুসলিম পরিবারে গান শেখা সহজ ছিল না, নিজের অতৃপ্তি মেটানোর সব চেষ্টা আমাদের ওপর। তালিমের ব্যবস্থা পাকা, বাসায় গানের ওস্তাদ আসেন নিয়মিত। হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে বসি ঠিকই, কিন্তু ভৈরবীর মধুর বানদীশ তখন আমাকে যত না টানে, বেশি টানে কলাপাতা রঙের সেই কলা বাঁশি। কী যে মধুর এর সুর! কেন যে এর নাম হলো বাঁশি, আসলে তো ওটি একটি মাউথ অরগান! তাতে কী, আধুনিক শত বাদ্যযন্ত্রের মাঝেও আমার মনে কেন এখনো সেই ভুল নামের কলা বাঁশির সুর বাজে!
পূজা-পার্বণে আমি বারবার ফিরে যাই আমার অতীতে, অসাধারণ একটা ছেলেবেলা ছিল আমার। বাবার চাকরির সুবাদে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে কানুনগোপাড়া নামের এক মফস্বলে। শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে গড়া, হিন্দু-অধ্যুষিত এই এলাকা আজ অবধি আমার দেখা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ একটি জায়গা। প্রতিটি গেরস্থ বাড়ি যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাড়ির সামনের ফুলের বাগান বেলী, গন্ধরাজ, জবা, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন। পেছনে খোলা উঠোন, তার পাশে সবজিখেত আর বাড়ির এধারে-ওধারে মৌসুমি ফলের গাছ। চাষের আনন্দ এবং তাজা সবজি ফল খাওয়ার আনন্দের সঙ্গে উপরি ছিল নির্ভেজাল পুষ্টি। বেশির ভাগ গেরস্থ বাড়িতে লাগোয়া পুকুরে মাছ চাষ হতো, আবার সেই পুকুরেই চলত ভরদুপুরে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা। শিশুদের পুষ্টির চাহিদা মেটাত বাড়িতে সযত্নে পালা গরুর দুধে। রাস্তার দুপাশে সবুজ ধানের খেত- সেই ধানখেতের আইলে আইলে লুকোচুরি খেলা। তারই মাঝে লুকিয়ে আমার ছেলেবেলা। আমার কৈশোরের খেলার সাথীদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা বেশি। ওই সময়ে আমাদের বন্ধুত্ব বা সামাজিকতায় ধর্ম কোনো বাধার দেয়াল তোলেনি। সকালে যে আজানের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙত, তার সঙ্গে আমার পাশের বাড়িতে আহ্নিক পূজার ঘণ্টিতে কোনো বিরোধ বাধতে দেখিনি। ঈদের দিনে সব বন্ধু, কাকু-কাকিমারা যেমন আমাদের বাসায় অবশ্যম্ভাবী ছিলেন, তেমনি তাঁদের প্রতিটি পূজা-পার্বণে আমাদের অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। বন্ধুদের বাড়িতে আমাদের যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। আমাদের এলাকায় বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। মহালয়া থেকে শুরু হয়ে যেত বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিমা বানানো দেখা। প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত দশ দিনব্যাপী মাইকে বেজেই যেত পুরোনো সব বাংলা গান। সেই সব কখন যেন কান পেরিয়ে মনে জায়গা করে নিল। কানুনগোপাড়ার একটা বিশেষত্ব ছিল মাসজুড়ে চলা বসন্ত উৎসব। গান-বাজনার পাশাপাশি প্রতি সন্ধ্যায় পরিবেশিত হতো বাড়ির সবাই মিলে উপভোগ করার মতো মানসম্পন্ন নাটক, যাত্রা, সার্কাস। রকমারি পসরা নিয়ে বসত বার্ষিক মেলা, কী মিষ্টি নাম তার, ‘সূর্যখোলা’। কী অধীর আগ্রহেই না অপেক্ষা করতাম সেই মেলার জন্য। মধুর সেই দিনগুলো! আজ যখন গ্রামে যাই, আমার সেই পরিচিত সবুজ-শ্যামল গ্রামকে যেন খুঁজে পাই না। নগরজীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামেও চলছে উন্নতির প্রতিযোগিতা! সেই প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাচ্ছে গেরস্থের বাগান, ধানখেত, ডুবসাঁতার, মাঠে শিশুদের কলকাকলি! বাগানের জায়গায় উঠছে নতুন বিল্ডিং। মাইলের পর মাইল সবুজ ধানের খেত এখন বন্ধ্যা। চাষে লাভ হয় না, তাই অনেকে বেশি লাভের আশায় বানাচ্ছে কলকারখানা, ইটের ভাটার কালো ধোঁয়ায় সবুজ মাঠ এখন ধূসর। পুকুরগুলো ব্যবহারের যোগ্যতা হারাচ্ছে। শিশুরা এখন আর পুকুরে সাঁতার কাটে না, চাপা কলের পানিতে গোসল করে। মাঠে খেলার সময়টা শিশুদের এখন কাটে হয় টেলিভিশনের সামনে, নতুবা মুঠোফোন বা কম্পিউটারে গেম খেলে। সভ্যতা, নাগরিক জীবনের প্রতিযোগিতা আমাদের সব নির্ভেজাল আনন্দকে চিরদিনের জন্য নির্বাসিত করছে। সত্যি কি এগোচ্ছি আমরা? তাই যদি হবে- কেন এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ! আমার সন্তান কোথায় কী করছে- কেন এত দুশ্চিন্তা!
মিটিং শেষে ফিরে এসেছি ঠিকই, মাথায় বেজে চলেছে চিটাস্লো বাজনা।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top