skip to Main Content

মনোযতন I ভয়-ভয়!

প্যানিক ডিসঅর্ডার। মারাত্মক মনোরোগ। কী এর কারণ? কীভাবে সমাধান? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

কত হতে পারে আপনার বয়স? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। এই ধরুন, চল্লিশের আশপাশে ঘুরছেন হয়তো। কিংবা কম-বেশিও হতে পারে। বয়স যা-ই হোক, নিজের কাজে বড্ড মনোযোগী এবং হাসিখুশি থাকতেই পছন্দ করেন। শারীরিকভাবে আপনি সুস্থ ঠিকই, কিন্তু মনের আকাশে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। এই মেঘ থেকে হুটহাট বৃষ্টি নামে। আর অমনি হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। শরীর থেকে বেরিয়ে আসে ঘাম। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন। ধড়ফড় করে বুক। মনে হয়, মৃত্যুটা বুঝি আয়-আয় ডাকছে। আর কেউ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না পৃথিবীতে। এখনই ডাক আসছে ওপারের!
এই যে আপনি এমন একটি সমস্যা নিয়ে অফিস করছেন। পরিবারকেও সময় দিচ্ছেন ঠিকঠাক। পাত্তা দিচ্ছেন না কালো মেঘদের। এতে দিন দিন কালো মেঘের দানবীয় হানা যেন বাড়তেই থাকে। টিকতে না পেরে একসময় ঠিকই দরজায় কড়া নাড়লেন ডাক্তারের। দেখে শুনে ডাক্তার বললেন, ‘ঠিকই তো আছে সব!’ তবে সমস্যা কোথায়? কোনো কূল-কিনারা করতে না পেরে আপনি বন্ধ করে দিলেন অফিসে যাওয়া। ভাবেন, জীবন না থাকলে অফিসে গিয়ে কীই-বা হবে! একাকী বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দিলেন। একান্ত প্রয়োজনে চার-পাঁচজন সঙ্গী না হলে বাইরের আলো গায়ে মাখেন না। এড়িয়ে চলেন ভিড়ভাট্টা। গণপরিবহনের কথা মাথায় এলেই ভেতরটা কেমন করে ওঠে। বাথরুমে গেলেও দরজাটা আটকাতে চান না।
এই যখন অবস্থা, ধরা যাক তখন একান্ত প্রিয় মানুষটি আপনার হাত ধরে নিয়ে গেলেন মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে। তিন-চার বৈঠকের পরে বুঝতে পারলেন, আপনি বিশেষ এক মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, যার নাম প্যানিক ডিসঅর্ডার। এটি এমন এক মানসিক ব্যাধি, যা আজকাল অনেক শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনা নামক অতিমারি মানুষের মধ্যে নানা অনিশ্চয়তা ও ভীতির জš§ দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ফলে নিজের ওপর আস্থা ও মানসিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেকেই ওষুধের ওপর আস্থা রাখার ভুল চেষ্টা করে যাচ্ছে; যা জীবনের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি!
কারণ ও প্রাথমিক আচরণ
প্যানিক ডিসঅর্ডারের পেছনে বেশ কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করলেও মূলত মস্তিষ্কে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এর জন্য দায়ী। পাশাপাশি বিভিন্ন পারিপাশ্বিক প্রভাব, যেমন বৈবাহিক কিংবা দাম্পত্য জীবনে জটিলতা, কোনো বিষাদময় ঘটনা, আর্থিক সমস্যা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কিংবা গর্ভপাত, নেশাদ্রব্যের ক্রিয়া, ওষুধের পার্শ্বপপপ্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন প্রকার ফোবিয়া থেকে এই ব্যাধির সূচনা ঘটতে পারে। পরিবারে কারও এ রোগ থাকলে আপনার তাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় ৪ থেকে ৮ গুণ বেশি। তা ছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোগ্লাইসিমিয়া, মাইট্রাল ভালভ প্রলাপস প্রভৃতি রোগের পাশর্^প্রতিক্রিয়ায় প্যানিক ডিসঅর্ডার হতে পারে। আর এসবের ফলে প্রথমে যে নেতিবাচক চিন্তা আপনার মাথায় আসে, তা হলো শরীরে অস্বস্তি অনুভব করা, হাঁটতে ইচ্ছে না করা, বসে থাকতেও ইচ্ছে না করা, শোবার পর ঘুম আসে না, মনের ভেতর প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা আসে ও মৃত্যুভয় কাজ করে। মনে হয়, ‘আমার মারাত্মক অসুখ হয়েছে, অথচ ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেন না!’ ভাবেন, ‘আমি আর সুস্থ হব না।’ আবার মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে। কিন্তু মাপলে দেখা যায় প্রেশার ঠিকই আছে। এ ছাড়া মনে হতে থাকে বুকে ব্যথা, হয়তো হার্ট ফেল করবেন। কিন্তু কেউই আপনার কষ্ট বুঝতে পারছে না। পৃথিবীটা অশান্তিময় মনে হয়। এমন পরিস্থিতির ফলে স্বাভাবিক চলাফেরাও বন্ধ হয়ে যায় আপনার।
ইতিহাসের পাঠ ও ঝুঁকির পাল্লা
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, জ্যাকব মেনডিস ডা কস্টা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর সৈন্যদের মাঝে একধরনের বুকের সমস্যা দেখতে পান, যেটাকে Irritable Heart Syndrome বলে অভিহিত করেন তিনি। এটাই Da Costa Syndrome হিসেবে পরিচিত হয়। পরবর্তী সময়ে একে ‘প্যানিক ডিসঅর্ডার’ নামকরণ করা হয়। এ এমন এক মানসিক ব্যাধি, যাতে ব্যক্তি প্রচণ্ড আতঙ্কের শিকার হন। প্রতিটি প্যানিক অ্যাটাকের স্থায়িত্বকাল দশ থেকে পনেরো মিনিট হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আধঘণ্টারও অধিক হতে পারে। সাধারণত পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ ব্যাধি বিস্তারের হার বেশি। যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে এই রোগ। তবে টিনএজে থাকে সর্বাধিক ঝুঁকি।
সাধারণ লক্ষণ
কীভাবে বুঝবেন আপনি কিংবা আপনার কাছের মানুষটি প্যানিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত? চলুন, জেনে নিই:
1 হঠাৎ বুক ধড়ফড় ও মাথা ঝিমঝিম করা;
1 দম বন্ধ হয়ে আসা কিংবা হাঁপানি রোগীর মতো বড় বড় করে শ্বাস নেওয়া;
1 হাত-পা অবশ হয়ে আসা এবং শরীরে কাঁপুনি হওয়া;
1 বুকের মধ্যে চাপ লাগা এবং ব্যথা অনুভব করা;
1 বমি বমি ভাব, পেটে অস্বস্তি বোধ ও গলা শুকিয়ে আসা;
1 পেটের গ্যাস এসে বুকে চাপ দেওয়া;
1 অতিরিক্ত মৃত্যুভয় দেখা দেওয়া, মনে হয় যেন এখনই মরে যাবেন যন্ত্র­ণায়;
1 নিজের ওপর নিয়ন্ত্র­ণ হারিয়ে ফেলা;
1 বারবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, ইসিজি করানো এবং হার্ট অ্যাটাকের ভয় কাজ করা;
1 দূরে কোথাও গেলে স্বজনদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেন মাঝখানে অসুস্থ হলে তারা ধরতে পারে;
1 যেকোনো অনুষ্ঠানে এক পাশে থাকা, যেন অসুস্থ হলে তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায়;
1 রোগের লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই শুরু হয়ে ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে কমে যাওয়া;
1 সেফটি বিহেভিয়ার; যেমন অ্যাটাকের সময় বসে পড়া, কোনো কিছু হাত দিয়ে ধরে সাপোর্ট নেওয়া ইত্যাদি লক্ষণও রোগীর মাঝে দেখা দেয়, যা কিনা হৃদরোগীদের মাঝে লক্ষণীয় নয়।
সমাধানের সন্ধান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘মনের খবর’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্ল­ব বলেন, ‘নতুন একটি শব্দ এসেছে, যাকে আমরা বলি সাইকো এডুকেশন। এখানে অনেক বড় একটি বিষয় থাকে, এটি এমন একটি রোগ, রোগীকে সেটা বোঝাতে হবে। পাশাপাশি রোগীর যারা পরিবারের লোকজন থাকেন, অফিসের লোকজনকেও যদি সম্ভব হয়, এই বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। যেমন এই রোগের ফলে মৃত্যুর তেমন আশঙ্কা নেই। যদি আমরা চুপ করে থাকতে পারি এবং অবস্থা আওতায় থাকে, তাহলে আধা ঘণ্টার মধ্যে এটি নিয়ন্ত্র­ণে চলে আসে। এ বিষয়ে বেশ কিছু শিথিলকরণ প্রশিক্ষণ আছে। শিথিলকরণ ব্যায়াম শিখিয়ে দিতে হবে বা মেডিকেশনের একটি বিষয় রয়েছে। রোগটি বারবার হওয়ার বিষয়টিকে কমিয়ে দেয় মেডিকেশন। এটার মারাত্মক বিষয়টিকেও কমিয়ে দেয়।’
‘পাশাপাশি সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং যেটা, সেটাও করানো যেতে পারে। অসুস্থ হওয়ার কারণে তার দৈনন্দিন কার্যক্রম যেন বন্ধ না হয়। আসলে সম্পূর্ণ বিষয়টি যদি ভালোভাবে চিকিৎসা করানো যায়, এই রোগীরা খুব ভালো থাকেন। তবে মজার বিষয় এবং ভয়েরও বিষয় আছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে শুনি, প্যানিক ডিসঅর্ডারের ফলে মৃত্যুভয়ে অনেকে তার সম্পদ আত্মীয়স্বজনকে একদম ভাগ করে দেন। আমি একজন সার্জনকে জানি, যিনি ভয়ের কারণে ওনার সম্পদ সবকিছু ভাগ করে দিয়েছিলেন, শুধু সেই সময় উনি চিকিৎসা নেননি বলে। তবে যখন চিকিৎসা করালেন, তারপর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন,’ যোগ করেন ডা. বিপ্লব।
তিনি আরও বলেন, ‘একাডেমিক জায়গা থেকে বলা হয়, লক্ষণমুক্ত হওয়ার পরও অন্তত দুই বছর এ রোগের প্রভাব থাকে। তবে অনেক সময় লক্ষণ একটু কমে গেলে অনেকে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। বিশেষ করে অনেকে পরামর্শ দেন, ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তখন হয়তো রোগী ওষুধ ছেড়ে দেন। তাতে দেখা যায়, ওষুধ ছাড়ার কিছুদিন পরই রোগটি আবার ফিরে আসে। এখন কথা হচ্ছে, সঠিক চিকিৎসা নিলেও কি আবার রোগ ফিরে আসতে পারে না? তা পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা নিলে অন্তত ওই সময়টা ভালো থাকা যাবে এবং পরবর্তীকালে কীভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবেন, সেটি বুঝতে পারবেন।’
ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘সাধারণত প্যানিক ডিজঅর্ডার পারিবারিক একটি বিষয়ের কারণে হয়। যাদের পরিবারে উদ্বেগ বেশি থাকে, তাদের এই সমস্যা হওয়ার শঙ্কা বেশি। একবার সেরে গেলে রোগটি আবার পাঁচ-দশ বছর পর ফিরে আসতে পারে। তবে বিষয়টি যদি তিনি ভালোভাবে নিয়ন্ত্র­ণ করতে পারেন, তাহলে খুব দ্রুত সমাধান পাওয়া সম্ভব।’
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, সঠিক সময়ে সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে চিকিৎসা করালে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা সম্ভব। তাই এ বিষয়ে নিজে সতর্ক থাকুন এবং পরিবারের ও কাছের মানুষটিরও সতর্কতার সঙ্গে যত্ন নিন।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top