skip to Main Content

মনোযতন I মেজাজের মাস্তানি

মুড সুইং। খুবই চেনা শব্দ, চেনা ঘটনা। অনেকে হেলায় উড়িয়ে দেন। অথচ তা ডেকে আনতে পারে ভয়ানক মনোরোগ। জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

শহরে তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন, রাস্তায় কেউ আছে কি না। না, কেউ নেই; নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। উদ্দেশ্য? সান্ধ্যভ্রমণ! মুখচোরা, শান্ত আর লাজুক স্বভাবের আপনি একা থাকলেও একাকিত্ব আপনাকে ছোঁয় না। এই একা থাকার মাঝেই শান্তি আর মুক্তি খুঁজে পান; খুঁজে পান পরম প্রকৃতিকে। কিন্তু আজ হুট করেই ভালো মন বিগড়ে গেল! বুঝতে পারছেন না, কেন খারাপ হলো মন। পার্কের বেঞ্চিতে বসে স্মৃতি হাতড়ে দেখলেন, আপনার কাছের মানুষটির মনও আজকাল হুটহাট বিগড়ে যায়। রেগেও যায় যার-তার ওপর। এই যে আপনার এবং প্রিয় মানুষটির মেজাজের এমন আচম্বিত পরিবর্তন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে মুড সুইং। একে কেউ কেউ বলেন ইমোশনের রোলার কোস্টার। বাস্তবতায় চোখ রাখলে আঁচ করতে পারবেন, সময় পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে সমাজ। সেই সঙ্গে আমরাও। কত কাজ, ব্যস্ততা এখন আমাদের। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, অফিস, পরিবার, সংসার, সামাজিক নানা দায়িত্ব। তাই কখনো কখনো হাঁপিয়ে উঠি। আফসোস করে বলি, ‘নিজের জন্য যদি একটু সময় পেতাম, একটুু একা থাকতে পারতাম!’ আসলে এই কর্মব্যস্ততাই মুড সুইংকে ডেকে আনে বাড়িতে। তবে পুরুষের তুলনায় নারী এই রোগকে আপন করে নেয় বেশি। তাই তো কেউ কেউ ফোড়ন কেটে বলেন, ‘আরে, তোমার তো মেয়েদের মতো মুড সুইং করে!’
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন বা মুড সুইং হয়, তাদের মস্তিষ্ক খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনকি তারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বা কোনো পরিকল্পনা করতে পারেন তাৎক্ষণিক। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এটা সবার ক্ষেত্রে মেলে না। বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে বারবার মেজাজ পরিবর্তন হওয়ার ফল খুব বিপজ্জনক! মনোবিদেরা মনে করেন, শুরুর দিকেই এ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে তা বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বৈত সত্তার মতো জটিল ও গভীর মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে।
পিরিয়ড ও মুড সুইং
পিরিয়ড শুরুর আগে অনেক মেয়ের মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়, যা খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট এই সময়ে অস্বস্তি, ক্রোধ, খিটখিটে মেজাজ থেকে শুরু করে মানসিকভাবে একদম ভেঙেও পড়েন অনেকে। এই লক্ষণগুলোকে বলে প্রি-মিনস্ট্রয়াল সিনড্রম, যা সংক্ষেপে পিএমএস নামে বেশি পরিচিত। এই পিএমএস বা মুড সুইংয়ের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মেয়েলি হরমোনকে দায়ী করেন। মেয়েদের শরীরে থাকা এই বিশেষ হরমোনের নিঃসরণ মাসের নানা সময় বিভিন্ন রকমে ঘটে থাকে। একটা পিরিয়ড শেষ হলে প্রধান ফিমেল হরমোন ইস্ট্রোজেনের ক্ষরণ অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে। ১৪-১৫ দিনের মাথায় তা পৌঁছে যায় সর্বোচ্চ মাত্রায়, যাকে বলে ওভল্যুশন। এরপর তরতরিয়ে কমতে থাকে ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ। আবার পরের পিরিয়ড শুরুর পর থেকে অল্প অল্প করে নিঃসরণ বাড়ে। ইস্ট্রোজেনের এই উত্থান-পতন মেয়েদের মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলে এবং পিএমএসজনিত সমস্যা ঘটায়।
কার্যকারণ
আমাদের মস্তিষ্কে থাকা নিউরোট্রান্সমিটার থেকে হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। এগুলোর মধ্যে সেরাটোনিন ও নরপাইনফ্রাইন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি ঘুমের ধরন, মানসিক অবস্থা ও আবেগের সঙ্গে জড়িত। অন্যটির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে স্মৃতিশক্তির। এমনকি দক্ষতা কিংবা শারীরিক চাহিদাও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে এই হরমোন। এর নিঃসরণের তারতম্যের কারণে মুড সুইং হতে পারে। আরও কারণের মধ্যে রয়েছে মানসিক চাপ; অ্যাংজাইটি; অবসাদ বা ডিপ্রেশন; মদ্যপান; ঘুমের অভাব; পুষ্টিহীনতা; লৌহ, ভিটামিন ও খনিজের অভাব; বাইপোলার ডিজঅর্ডার; প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রম প্রভৃতি। আরও খেয়াল রাখুন—
i কৈশোরে ছেলে-মেয়েদের শরীর ও মনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এই সময়ে দেহের হরমোনে পরিবর্তন ঘটার কারণে মুড সুইং হয়ে থাকে। তাই এই বয়সী ছেলে-মেয়েরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়।
i জীবনযাত্রা, কাজের চাপ, মানসিক চাপ, খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন কারণে হতে পারে মুড সুইং। তবে বিশেষত মুড সুইংয়ে অতিরিক্ত রাগ কিংবা নেতিবাচক অনুভূতিই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
আপনার কী অবস্থা
নারী-পুরুষ যে কারও হতে পারে মুড সুইং। গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েলিবিশেষ যেসব হরমোন ব্রেন কেমিক্যাল কমিয়ে মুডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেগুলো মধ্যে অন্যতম সেরেটোনিন। এর মাত্রা কমে গেলে হতাশা, বিষণœতা, অস্থিরতা তৈরি হয়। এ ছাড়া পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে স্বাভাবিকভাবেই একেকজনের একেক রকম শারীরিক কিংবা মানসিক লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকের ক্ষেত্রে পেটের পেশিতে টান পড়া, খেতে অনিচ্ছা, শরীরে অস্বস্তি কিংবা মাথা ধরা, হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যাওয়া, রাগ হওয়া, অকারণ কান্না পাওয়া, আবার চট করেই মনে উৎফুল্ল ভাব বা আনন্দ অনুভব করার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

সমাধানে
মুড সুইংকে ইতিবাচক ভাবা যেমন ভুল, তেমনি অনেকের ক্ষেত্রে এটা খুবই বিপজ্জনক। ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বহু গ্রন্থের রচয়িতা ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল বলেন, ‘মুড সুইং প্রায়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। অনেক সময় ভিকটিম নিজেই তার মুড সুইং সম্পর্কে জানেন না। তাই নারী-পুরুষ উভয়েরই মুড সুইং সম্পর্কে জানা উচিত। অনেকে এটিকে মেয়েদের ন্যাকামি কিংবা মানসিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেন, যা মোটেই ঠিক নয়; বরং আক্রান্তের প্রতি সদয় হয়ে তাকে এই সমস্যা থেকে বের করা আনার চেষ্টা করা জরুরি। কেননা, মুড সুইংয়ের কারণে অতিরিক্ত রাগ কিংবা নেতিবাচক অনুভূতি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে।’
ডা. কল্লোল আরও বলেন, ‘মুড সুইংয়ের কোনো স্থায়ী সমাধান না থাকলেও নানাভাবে এর লাগাম টানা যায়।’ চলুন, তার পরামর্শের সূত্র ধরে কিছু উপায় খোঁজা যাক—
i ব্যায়াম: সকালে অথবা বিকেলে হাঁটতে বের হতে পারেন। বাড়িতে কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করলে মুড সুইং থেকে খানিকটা হলেও রেহাই পাওয়া সম্ভব। এক্সারসাইজের সময় ব্রেইন থেকে এন্ডোরফিন নামের একটি কেমিক্যাল বের হয়, যেটি আমাদের মনে সুখানুভূতি তৈরি এবং পিএমএসের জন্য দায়ী ক্ষতিকর হরমোনগুলোকে প্রতিহত করে।
i সঠিক খাদ্যাভ্যাস: এ সময় একটি হেলদি ফুড চার্ট মেইনটেইন করলে সুফল পেতে পারেন। এ ছাড়া মুড সুইং হলে জাংক ফুড ও ক্যাফেইন জাতীয় খাবার কম খাওয়াই ভালো।
i স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: নিজের স্ট্রেসগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর যথাযথ সমাধান করতে পারলে মুড সুইংয়ের মাত্রা কমে আসতে পারে।
i পর্যাপ্ত ঘুম: নিয়ম করে ঘুমোতে হবে এবং তা যেন দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা হয়, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া চাই।
i ডিহাইড্রেশনের প্রভাব: অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি পান করবেন। দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি পান করা জরুরি। অন্যথায় ভুগতে পারেন ডিহাইড্রেশনে। এতে আপনার মানসিক ও শারীরিক চাপ বাড়ার শঙ্কা থাকবে।
i রাত জেগে চ্যাট ও মদ্যপানে মানা: অনেকেই রাত জেগে ফোনের স্ক্রিনে মগ্ন থাকেন। এই অতিরিক্ত স্ক্রিন আসক্তি এবং ধূমপান ও মদ্যপান থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন।
i ব্যথার ওষুধে মানা: হুটহাট ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে যখন-তখন মাথাব্যথার ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
প্রচণ্ড ব্যস্ততায় মুড সুইংয়ের ঘটনা বেশ স্বাভাবিক। হাসিখুশি আপনার হুট করে মন খারাপ হয়ে গেলেও এর কারণ হয়তো জানেন না। আবার জানলেও তা বলতে চান না। ভাবেন, কাছের মানুষেরা নিজ দায়িত্বেই বুঝুক। কিন্তু না; বোঝে না কেউ! দ্রুত মেজাজ বদলায় আপনার। যদিও আপনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে জানেন, তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান কিংবা পরিকল্পনাও করতে পারেন ভালো; তবু মুড সুইং নামের দন্তহীন দানবটাকে ইতিবাচক ভাবতে যাবেন না। অন্যথায় বিপদ! তাই এ সমস্যা বেশি বাড়তে না দিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top