skip to Main Content

যাপনচিত্র I শাড়ি সান্নিধ্যে

মেহরুবা রেজা। করপোরেট ব্যক্তিত্ব। ব্র্যাক ব্যাংকের উইমেন ব্যাংকিং সেগমেন্ট তারা এবং আগামী স্টুডেন্ট ব্যাংকিং সার্ভিসের প্রধান কর্মকর্তা। নারী দিবস ঘিরে জানা যাক এই সফল ব্যাংকারের জীবনযাপনের গল্প

‘ওঠো, উদ্যমের সঙ্গে দিন শুরু করো। আর প্রতিদিন আগত সুযোগ ঠিকমতো কাজে লাগাতে শেখো’—এই মন্ত্রে দিন শুরু করেন মেহরুবা রেজা। সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট সারেন। খাবারের মেনুতে থাকে রুটি, ডিম, সবজি ভাজি প্রভৃতি। সেই সঙ্গে মুড়ি দিয়ে চা পান করতে ভালোবাসেন। তবে ছুটির দিনে স্বামীর সঙ্গে বাইরে করেন ব্রেকফাস্ট। পারিবারিক জীবনে দুই কন্যার জননী। সকালে সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি ভাগ করে নেন স্বামী ফজল মাহমুদ রনির সঙ্গে। একদম সকালে ছোট মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে জিমে চলে যান। এ সময়ে বিভিন্ন ধরনের কার্ডিও করার পাশাপাশি জুম্বা করতে ভালোবাসেন। শারীরিক কসরত শেষ করে যান অফিসে।
কোভিড হানা দেওয়ার আগে নিয়মিতই ইয়োগা করতেন মেহরুবা। ইয়োগিনী হিসেবে আছে মুনশিয়ানা। ইয়োগার প্রতি অনুরাগ এতই বেশি, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অংশ নিয়েছেন থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী এক ইয়োগা ফেস্টিভ্যালে। নিকট ভবিষ্যতে স্পেনে অনুষ্ঠেয় ইয়োগা ফেস্টে যাওয়ার ইচ্ছে রাখেন।
দুপুরে কলিগদের সঙ্গে অফিসে কিংবা বাইরে সারেন মধ্যাহ্নভোজ। স্বভাবতই লাঞ্চে খাবারের কিছুটা আধিক্য থাকে। সাপ্তাহিক ছুটিতে বেশির ভাগ সময় দুপুর ও রাতে দাওয়াত থাকায় বাইরে খাওয়া হয়। মাসে একবার হলেও চেষ্টা করেন ঢাকার বাইরে যাওয়ার। প্রসঙ্গক্রমে বলি, ভ্রমণ ভালোবাসেন মেহরুবা। এখন পর্যন্ত ১৬টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। ‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে, তারপর বাধ্য করবে গল্প বলতে’—ইবনে বতুতার এই উক্তি অনেকাংশে সত্য এই ব্যাংকারের জীবনে। ঘুরে আসা দেশগুলোর মধ্যে তাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, পাতিসেরি, মন্টমার্ত্রে। আমেরিকা ও জাপানের ডিজনি ওয়ার্ল্ড দেখেও তার কাছে সেরা মনে হয়েছে ফ্রান্সেরটি। বিমোহিত হয়েছেন থাইল্যান্ড, ইতালির ভেনিসে ওয়াটার সিটি, পিসা, ইন্দোনেশিয়ার লম্বক, গিলি আইল্যান্ডের গিলি তারাওয়ার সৌন্দর্যেও।
১৪ বছরের সংসারজীবন তার। বিয়ের আগে স্বামীর সঙ্গে অনেকটা অলিখিত চুক্তি করে নিয়েছিলেন ভ্রমণের ব্যাপারে। নতুন জায়গা ও খাবার অন্বেষণে তাদের মিউচুয়াল ইন্টারেস্ট। ভ্রমণের এই শখ পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। যেখানেই যান, পরখ করেন স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কুজিন। বাসায় সময় পেলে নানা ধরনের ফুড ব্লগিং দেখে ধারণা নেন নিত্যনতুন খাবার সম্পর্কে। সময় পেলে রান্না করতে ভালোবাসেন।
ছোটবেলা থেকে খেলাধুলায় আগ্রহ ও পারদর্শিতা ছিল মেহরুবা রেজার। ছিলেন স্কুলের বাস্কেটবল দলের সদস্য। ইউনিভার্সিটি লাইফের প্রথম দিকে চালিয়ে গিয়েছিলেন খেলাধুলা। বর্তমানে ফুটবল খেলা দেখতে বসেন পর্যাপ্ত রিসার্চ করেই, বিশেষ করে বিশ্বকাপ। মজার ছলে জানালেন, বাসার সবাই আর্জেন্টিনার পক্ষপাতী হলেও তিনি একাই ব্রাজিল-সমর্থক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়ালেখার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন পেশাগত কাজে; কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়ও। বলা বাহুল্য, স্টুডেন্ট লাইফে নানা কাজ করায় মেহরুবার টাইম ম্যানেজমেন্ট দারুণ। তা ছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি উপার্জন করাটা তাকে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করেছে। শিক্ষার্থীকালে যুক্ত ছিলেন ড্রামা ও ফটোগ্রাফি ক্লাবের সঙ্গেও।
গান শুনতে ভীষণ পছন্দ করেন মেহরুবা। বিশেষ করে কিং অব পপ মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার, ডেঞ্জারাসের মতো আলবাম কিংবা বিলি জিন, স্মুথ ক্রিমিনাল, বিট ইট, থ্রিলারের মতো কালজয়ী গানে এতটাই মুগ্ধ, নিজের শাড়িতে ফুটিয়ে রেখেছেন প্রিয় গায়কের আর্টওয়ার্ক। বনি এম, আবিদা পারভীনের পাশাপাশি পছন্দ করেন চিরকুট, আর্টসেল, নেমেসিস, শূন্য, আরবোভাইরাস, শিরোনামহীন, সোমলতা, মৌসুমি ভৌমিক, অর্ণবের গান। মেহরুবা রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক করেছেন সংগীত ভবন থেকে। বাসায় এসে তাকে গানের দীক্ষা দিতেন তিমির নন্দী। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হতে পারাকে সৌভাগ্য হিসেবেই দেখেন। তাই বাবা-মায়ের কাছে তার আজীবনের কৃতজ্ঞতা।
ইংরেজি মাধ্যমের এই সাবেক শিক্ষার্থী নিজ সংস্কৃতির টান সব সময় অনুভব করেন। অফিসে কিংবা দাওয়াতে—যেখানেই যান, শাড়ি পরতে ভালোবাসেন; বিশেষ করে জামদানি। মেহরুবা বলেন, ‘শাড়ির যে শুধু সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে তা নয়; এটি এমন পোশাক, যাতে আমি মায়ের গন্ধ পাই।’ সেই সঙ্গে কুর্তি, সালোয়ার-কামিজেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পছন্দের রং ল্যাভেন্ডার।
দেশীয় কাগজে তৈরি ডায়েরি সংগ্রহের নেশা আছে তার। ঘড়ি পরতে পছন্দ করেন। প্রিয় ব্র্যান্ড সোয়াচ, মাইকেল কর্স, ক্রকোডাইল ও টাইটান। মেহরুবার হোম ইন্টেরিয়রেও রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া। বাসা ছিমছাম ও পরিপাটি রাখতে ভালোবাসেন। ফটোফ্রেম, নানা ধরনের নকশিকাঁথা, মাটির জিনিসপত্র, ল্যাম্প শেডে সাজিয়েছেন ঘর।
মেহরুবা ব্যক্তি হিসেবে আড্ডাবাজ। তবে তার স্কুলজীবনের বেশির ভাগ বন্ধুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন দেশের বাইরে। বর্তমানে তার আড্ডার সার্কেলে করপোরেট ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি বেশি। আড্ডার টপিক ঘুরেফিরে ব্যাংকিং সেক্টর। অন্যদিকে, পারিবারিক আড্ডায় মামা, খালা থেকে শুরু করে কাজিন, শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে জম্পেশ মেতে উঠতে ভালোবাসেন। প্রিয় ব্যক্তিত্ব বাবা।
স্টাইল সম্পর্কে মেহরুবার আছে নিজস্ব অভিমত। বলেন, ‘আমি মনে করি স্টাইলে একজন মানুষের অ্যাটিচ্যুড ও পারসোনালিটি প্রতিফলিত হয়। স্টাইলে নিজের ব্যক্তিত্ব বহন করতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ মেকআপ খুব সীমিত পরিসরে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। হালকা মেকআপ, কাজল, লিপস্টিক, টিপের সমন্বয়ে। অফিস কিংবা দাওয়াতের সাজগোজে থাকে সাদৃশ্য। অধিকাংশ সময়ই শাড়ি পরেন; হাতে থাকে চুড়ি। দাওয়াতের বেলায় পারলারে গিয়ে চুল ঠিকঠাক করে নেন। সবকিছুর পর পারফিউম ব্যবহার করা চাই। পছন্দের পারফিউম জোডো।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তিনি। তবে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো মাধ্যমগুলো নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফোকাস করতে অজ্ঞাতসারেই প্রতিবন্ধকতা ঘটায় বলে মনে করেন। তাই এসব ব্যবহারে কিছুটা সীমিত থাকা উচিত বলে অভিমত তার। অবসরে পছন্দ করেন নেটফ্লিক্স ও আমাজন প্রাইমে নানা ধরনের টিভি সিরিজ ও সিনেমা দেখতে। পছন্দের টিভি সিরিজ ক্যালিডোস্কোপ, ফৌদা, মডার্ন লাভ মুম্বাই। হিন্দি রোমান্টিক সিনেমা দেখা হয় বেশি। সালমান খানের দারুণ ভক্ত। পছন্দের সিনেমা চাঁদনী, মেইনে পেয়ার কিয়া।
বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ হলে চেষ্টা করেন সরাসরি বাসায় ফেরার। তারপর সম্ভব হলে সন্তানদের পড়াশোনা দেখভাল করেন। হেলদি লাইফস্টাইল বজায় রাখতে নিজ আবাসস্থল ধানমন্ডি এলাকায় স্বামীর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন মাঝেমধ্যে। চেষ্টা করেন ন্যূনতম ৪০ মিনিট হাঁটার। বাসায় ফিরে রাতের খাবার সারেন। মেনুতে থাকে রুটি, সবজি, মাছ ও মাংস। তবে বৃহস্পতিবার রাতে স্বামীর সঙ্গে লং ড্রাইভে যেতে ভালোবাসেন, সেটা ঢাকা থেকে সামান্য দূরে কোথাও। সে রাতে বাসায় ফেরেন দুইটা-তিনটায়।
মেহরুবা রেজার জীবনদর্শন খুব স্পষ্ট। তার মতে, জীবনে সফল হতে সর্বক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী, অধ্যবসায়ী ও আত্মবিশ্বাসী হওয়া চাই। কাজে কোনো আকাঙ্ক্ষা না থাকলে সফল হওয়া কষ্টকর। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। সফল হতে হলে প্রতিটি কাজে বিকল্প উপায় মাথায় রেখে আগানোর পরামর্শ তার, যেন প্রয়োজনে প্ল্যান বি প্রয়োগ করা যায়। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বুঝে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ ফেলা গুরুত্বপূর্ণ, জানালেন তিনি।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: রনি বাউল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top