skip to Main Content

রসনাবিলাস I পাহাড়ি স্বাদের আস্থানা

নববর্ষে প্রাণের স্ফূর্তি পাহাড়ি খাবারেও। এখন ঢাকায় বসেও তা উপভোগ করা যায়। এমনই তিনটি রেস্তোরাঁর হদিস দিয়েছেন সামীউর রহমান

এবারের পয়লা বৈশাখটা পড়েছে রোববার। শুক্র-শনির সাপ্তাহিক বন্ধের সঙ্গে মিলে যাকে বলে লং উইকএন্ড! এই সুযোগে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ দুই-ই আছে। খারাপ খবর হলো, উৎসবকালীন তিন দিনের বন্ধ মানেই ট্রেনে বাসে টিকিটের হাহাকার, হোটেলগুলোতে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রব আর ঘোরাঘুরির জায়গাগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। সেই সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট তো থাকছেই। তা ছাড়া বাংলা নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে রমনার বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নিদেনপক্ষে রবীন্দ্রসরোবরে না গেলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে! যদি বর্ষবরণের সকালবেলাটা বাঙালি কেতায় আর বিকেলটা পাহাড়ি কায়দায় কাটিয়ে দেওয়া যায়! খোদ ঢাকা শহরের এমন রেস্তোরাঁয়, যেখানে পরিবেশন করা হচ্ছে একদম আদি ও অকৃত্রিম পাহাড়ি স্বাদের আহার। শুধু তা-ই নয়, রেস্তোরাঁগুলোর অন্দরসজ্জা, পরিবেশনরীতি—সবকিছুতেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে মনেই হবে না আপনি পড়ে আছেন ইটপাথরের এই শহরে। বরং মনে হবে, বসে আছেন দূর পাহাড়ের গায়ে কোনো বাঁশের মাচায়। শুনতে পাচ্ছেন আদিবাসীদের গান।
মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকায় বসবাস করেন চাকমা সম্প্রদায়ের অনেকেই। সম্প্রতি এখানে চালু হয়েছে দুটো রেস্তোঁরা; পুরোদস্তুর চাকমা খাবার নিয়ে। একটির নাম হেবাং, যার অবস্থান কাজীপাড়ার স্বপ্ন সুপারস্টোরের পাশেই। হেবাং আসলে একটা স্বপ্ন, যেটা দেখেছিলেন খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় পড়তে আসা প্রিয়াঙ্কা চাকমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ার সময় তিনি সহপাঠীদের প্রায়ই রেঁধে খাওয়াতেন চাকমা খাবার। স্নাতকোত্তরের পাট চুকিয়ে পড়তে গেলেন ইতালি। সেখান থেকে আসার পরই স্বপ্নটা আরও ডালপালা মেলল। শুরুতে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে শুরু হেবাংয়ের পথচলা। দ্রুতই ভোজনরসিকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হেবাংয়ের ভিন্ন স্বাদের খাবার। তারপর গুছিয়ে নিয়ে ঢাকায় রেস্তোরাঁ দাঁড় করাতে করাতে লেগে গেছে আরও বছরখানেক।
দেয়ালে পাহাড়ি যাপনচিত্র। ছাদ থেকে ঝুলছে বাঁশের ল্যাম্পশেড আর টেবিলে মাটির জলপাত্র। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাহাড়ি মাচাং ঘরের আবহ। মৃদু লয়ে বাজছে পাহাড়ি গান। হেবাংয়ের দরজা খুলে ঢুকলে মনে হবে, ঢাকা থেকে এক লাফে চলে এসেছেন দূর পাহাড়ের ধারে।
কী পাওয়া যায় এখানে? বিজু উৎসবের প্রধান খাবার হচ্ছে পাজন। বানানো হয় অনেক রকম সবজির সঙ্গে চিংড়ি বা শুঁটকি মিশিয়ে। প্রথমত মৌসুমি সবজির সঙ্গে নানা রকম পাহাড়ি লতাগুল্মও মেশে পাজনে। তারা, সাবারাং, ফুজি, বাঁশকোড়ল, কচি কাঁঠাল (মানে এঁচোড়)সহ অনেক কিছু দিয়েই রান্না করা হয় পাজন। চাকমা সংস্কৃতিতে মনে করা হয়, বিজুর পরবে ৭ বাড়ির পাজন খেলে নাকি সারা বছর নীরোগ থাকা যায়! এ ছাড়া হেবাংয়ের নিয়মিত আয়োজনের তালিকায় আছে শামুক ভুনা, কাঁকড়া ভুনা, ঢেঁকি শাক, পাহাড়ি মরিচের ভর্তা, ফ্রেঞ্চ বিনের ডাল, বাঁশচিংড়িসহ অনেক মজাদার খাবার। কর্মসূত্রে প্রিয়াঙ্কা এখন কক্সবাজারে, হেঁশেল সামলাচ্ছেন তাঁর বোন সুচিন্তা চাকমা ও বিপ্লি চাকমা। কিছুদিন আগেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা এসে চেখে গেছেন হেবাংয়ের খাবার। রেস্তোরাঁটি ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদেরও আপ্যায়ন করেছে। ফেসবুক পাতায় তাদের প্রশংসার ফুলঝুরি। তাই স্বাদবদলের সঙ্গে পাহাড়ি অন্দরসজ্জায় ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলে চলে যেতে পারেন হেবাংয়ে। তবে যা-ই চেখে দেখুন না কেন, রোজেলা চায়ে চুমুক দিতে ভুলবেন না।
কাজীপাড়াতেই, স্বপ্ন সুপারশপের পাশের গলিটা দিয়ে ঢুকে মিনিট দুই হাঁটলেই বাঁ দিকে চোখে পড়বে সিএইচটি এক্সপ্রেস। নজর কাড়বে দেয়ালে আঁকা ‘চান্দের গাড়ি’র ছবি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা বেড়াতে গিয়েছেন, তারা ভালো করেই জানেন এই চান্দের গাড়ির কথা। সেই স্মৃতি উসকে দিয়ে খাদ্যরসিকদের আমন্ত্রণ জানান সিএইচটি এক্সপ্রেসের কর্ণধার অর্পণ চাকমা। তরুণ এই রসনাশিল্পী কলকাতার সুভাষ বোস ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে পড়াশোনা করে ফিরে এসেছেন শিকড়ের কাছে। রাঙামাটির রঙে রাঙাতে চেয়েছেন ঢাকার খাদ্যরসিকদের মন। ছোট্ট ছিমছাম রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জাতেও পাহাড়ি সংস্কৃতির ছাপ নজর কাড়বে। দৃষ্টি আকর্ষণ করবে পরিবেশনরীতি। মাটির পাত্র, কাঠের ট্রে, বাঁশের ঝুড়ি, কলাপাতা— এমন সব প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে বানানো তৈজসপত্রেই পরিবেশিত হয় এখানকার পাহাড়ি স্বাদের আহার।
অর্পণ জানালেন, দূরপ্রাচ্যের অর্থাৎ থাই, চায়নিজ, জাপানি, কোরিয়ান খাবারের সঙ্গে চাকমা খাবারের দারুণ মিল। এই ঘরানায় গরমমসলা অর্থাৎ দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ ও গুঁড়া মসলার ব্যবহার একদমই নেই। বরং সবই নানান রকম ভেষজ লতাগুল্ম আর কন্দের খেলা! আদার ফুল, হলুদের ফুল, পাহাড়ি ধনেপাতা সাবারাং, পাহাড়ের ঢালে জন্মানো পার্সলেসহ নানান রকম প্রাকৃতিক ঔষধি গুণসমৃদ্ধ লতাপাতার ব্যবহারই চাকমা খাবারকে করেছে স্বাস্থ্যসম্মত। তেলের ব্যবহার সামান্যই। বেশির ভাগ খাবারই ভাপে সেদ্ধ, হয় পাতায় মুড়িয়ে না হয় বাঁশের চোঙায় ভরে। সিএইচটি এক্সপ্রেসেও মিলবে হরেক সবজির পাজন, বাঁশের ভেতর রান্না করা ব্যাম্বো চিকেন। এই রান্নায় যে মুরগির মাংস ব্যবহার করা হয়, সেসবও আসে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। কৃত্রিম খাদ্য খাইয়ে মোটাতাজা করা নয় বরং পাহাড়ি গাঁয়ের উঠোনে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা মুরগির মাংস দিয়েই রান্না করা হয় সুস্বাদু এই পদ। পাহাড়ি স্বাদের নানান ধরনের খাবার তো এখানে মিলবেই; সঙ্গে পাবেন প্যান এশিয়ান ঘরানার অনেক আইটেমও। থাই তোম ইয়াম স্যুপ, জাপানি সুশি, নেপালি মোমো—সবই আছে মেনুতে। সব কটিতেই অর্পণ চেষ্টা করেছেন খানিকটা নিজস্ব ছোঁয়া দিতে। থাই স্যুপে যে লেমনগ্রাসটা তিনি দিচ্ছেন, সেটা জন্মেছে রাঙামাটির পাহাড়ে! মোমোর পুরে মিশিয়েছেন সাবারাং আর পাহাড়ি পুদিনা! সিএইচটি এক্সপ্রেসে এসে যত কিছুই খান না কেন, শুরুতে এক গ্লাস রোজেলা জুস আর শেষে কলাপাতায় মোড়া বিন্নি চালের পিঠা না খেয়ে যাওয়াটা হবে বড় ভুল। সমতলের বাসিন্দারা রোজেলাকে কোথাও বলেন চুকাই, কোথাও টশফল; সিলেট অঞ্চলে বলে শইলফা। অনেকটা স্ট্রবেরির মতো দেখতে লাল রঙের ছোট এই ফল দিয়ে টক তরকারি রেঁধে খাওয়ার প্রচলন আছে সিলেটে। জেলিও বানানো হয়। কিন্তু এই ফল দিয়ে যে এত মজার জুস হতে পারে, সে অভিজ্ঞতা সিএইচটি এক্সপ্রেসে না ঢুকলে হবে না। স্বাদটা চমৎকার এবং চুমুকেই ক্লান্তি দূর করে। কলাপাতায় মোড়া বিন্নি চাল-গুড়-নারকেল আর পাকা কলা দিয়ে বানানো পিঠাটা শেষপাতে না খেলে যে অপূর্ণ থাকবে সিএইচটি এক্সপ্রেসের স্বাদযাত্রা!
বান্দরবানের খাবার নিয়ে রাজধানীর বুকে হাজির হয়েছেন তরুণ আইনজীবী মংহ্লায়ী মারমা। মিরপুর ডিওএইচএসের প্রবেশ ফটকের ঠিক বাইরে, পার্কভিউ ফুডকোর্টে ছোট্ট পরিসরে তিনি শুরু করেছেন ‘চিংস কিচেন’। হাসতে হাসতেই জানালেন, তার শাশুড়ির নামের শেষে আছে চিং, তাই এই নাম দিয়েছেন! ফুডকোর্টটা নতুন, এর অন্দরসজ্জার অনেকটাই বাকি। তাই হেঁশেল চালু করলেও বসার ব্যবস্থা এখনো বারোয়ারি, তবে দ্রুতই নিজেদের জন্য আলাদা একটা অংশ সাজিয়ে নেওয়ার কথা জানালেন মং। পাহাড়ি খাবারের আয়োজন নিয়ে হাজির হবার কারণ হিসেবে বললেন, ‘চিংস বালাচাও (কুঁচো চিংড়ি ভাজা থাই রসনায় জনপ্রিয়) নামে আমার আরেকটা ব্যবসা আছে। আমি বান্দরবানের ফ্লেভারের বালাচাও বানাই। এটা করতে করতেই মনে হলো, বান্দরবানের খাবারের একটা দোকানও তো দিতে পারি!’শুরুটা করেছেন ফেব্রুয়ারিতে। অল্পদিনের পথচলায় সাড়া পাচ্ছেন বেশ। পিৎজা-বার্গারের নিয়মিত খদ্দেররা অবশ্য আসছেন না তার কাছে। তবে যারা খাবারের ব্যাপারে একটু উৎসাহী আর পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার স্থানীয় রসনার স্বাদ নিয়েছেন, তারাই আসছেন চিংস কিচেনে।
ফুডকোর্টটা জমে বিকেল-সন্ধের আড্ডায়। তাই পেট ভর্তি করার খাবারের বদলে হালকা মুখরোচক খাবারই চিংস কিচেনের খাদ্যতালিকায় বেশি। এখানে খাওয়া যায় মারমা ঘরানার স্যুপ মুংদি, দেখতে অনেকটাই জাপানি রামেনের মতো। হাতে বানানো নুডলস, সেদ্ধ ডিম আর নানান রকম পাহাড়ি লতাগুল্মের নির্যাস মিশেছে এক পাত্রে। সঙ্গে নিতে হবে চিকেন আকাং বা মুরগির কাঠি কাবাব। বাঁশে গাঁথা একেক টুকরো মুরগি স্যুপে মিশিয়ে খাওয়াটাই দস্তুর। সঙ্গে একটু একটু করে নানান ধরনের স্যালাড। স্কুইড, চিকেন অথবা চিংড়ি—যেকোনো স্যালাডই খেতে পারেন। সেদ্ধ মুরগি, চিংড়ি অথবা স্কুইডের সঙ্গে মাখানো হয়েছে নানান রকম পাহাড়ি ভেষজ, কুচানো আদা, পেঁয়াজ আর জুমের মরিচের কুঁচি। গরম স্যুপ আর ঝাল স্যালাড খেয়ে জিভে আগুন জ্বলে উঠলে নেভানোর জন্য আছে মিন্ট লেমনেড। টাটকা পুদিনা আর লেবুর এই পানীয় মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেবে সব ক্লান্তি। মং জানালেন, নিজেদের বাড়ির ছাদে টবেই চাষ করছেন বিভিন্ন পাহাড়ি লতাগুল্ম, তাই সরবরাহটা সব সময়ই টাটকা।
প্রিয়াঙ্কা, অর্পণ ও মং—তিনজনই বয়সে তরুণ। তিনজনেরই সুযোগ ছিল অন্য যেকোনো উদ্যোগ বেছে নেওয়ার। কিন্তু এগিয়ে এসেছেন নিজেদের সংস্কৃতিকে মেলে ধরার প্রত্যয় নিয়ে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান—এই তিন জেলা মিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম। হেবাং, সিএইচটি এক্সপ্রেস আর চিংস কিচেন—এই তিন রেস্তোরাঁর তিন উদ্যোক্তাও এসেছেন এই তিন জায়গা থেকেই! উৎসবের দিনে তিন বেলা তাই এই তিন রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারলেই যে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেরে নেওয়া যাবে খাদ্যভ্রমণ, তাতে সন্দেহ কী!

লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে এবং দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: অংকুর রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top