skip to Main Content

রসনাবিলাস I মৃত্যুঞ্জয়ী রসনাশিল্পীর প্রদর্শনীতে স্বাগত

শীত-বসন্তের এই সন্ধিক্ষণে, মাঘের বিদায় আর ফাগুনের আগমনী মৌসুমকে মনে রাখার মতো কোনো নৈশভোজ উদ্‌যাপন করতে চাইলে যেতে পারেন ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের ‘পানাশ’ রেস্টুরেন্টে। শহরজুড়ে প্রলোভনের জাল বিছিয়ে রাখা এত এত খাবারের ঠেক থাকতে কেন এই ঠিকানায়- উত্তর খুঁজেছেন সামীউর রহমান

ফুরিয়ে যাচ্ছে শীত, বাতাসে বসন্তের আগমনী। পশ্চিমে শীত মানেই তুষারবন্দি জীবনের বিভীষিকা হলেও বাংলাদেশে শীত হচ্ছে উৎসবের ঋতু। আবহাওয়ায় স্বস্তিদায়ক শীতলতার সঙ্গে রসনাবিলাসের একটা যোগসূত্র আছে। গরমে বেশি খেয়ে হাঁসফাঁস করতে কে চায়? শীত কাম্য সবার। আর এই শীত নিয়ে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতার অন্ত নেই। শীতের পিঠা খেতে গ্রামের বাড়িতে যাবার অভিজ্ঞতা কিংবা গ্রামে মাটির চুলায় মা-খালাদের বানানো গরম গরম পিঠা চুলার পাশে বসেই খাওয়া স্মৃতি যাদের আছে, এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে এই যান্ত্রিক নগরে। পিঠা বানানোর লোক কমছে; খাবারের লোকও। যাক সে কথা। সেই গ্রামীণ পিঠাভোজের স্মৃতিই উসকে দেবে ‘পানাশ’। গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে, ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের মূল ভবনটা বাঁয়ে রেখে গলিপথ ধরে একটু এগিয়ে গেলেই হাতের বাঁ দিকে চোখে পড়বে একই প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্সি ভবন। যেখানে আছে শুধু স্যুইট রুমগুলো আর রুফটপে ‘পানাশ’। তবে সেটা চালু থাকে বছরে মাত্র তিন মাস, শীতসন্ধ্যাগুলোয় আসর হয় গুলজার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তেপানিয়াকি ঘরানার খাবার। তেপানিয়াকি হচ্ছে উত্তপ্ত ধাতব চাটুতে চটজলদি সেঁকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ পরিবেশন করা খাবার। সেটা হতে পারে মাছ, মাংস কিংবা সবজি। মার্কিন মুলুকেও ষাটের দশক থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই রন্ধনপদ্ধতি এখন বিস্তৃত হচ্ছে বাংলাদেশেও। কাঠ-কয়লার আগুনে সেঁকা কাবাব আর গরম তাওয়ায় ভাজা মসলাদার চাপের বদলে স্রেফ নুন, গোলমরিচ দিয়ে মাখনে ভাজা মাছ, মাংসের স্বাদ নিতে চাইলে পা রাখুন ‘পানাশ’-এ। তাতে শুধু পেটপুজোও নয়, হবে দর্শনসুখ উপভোগের অন্য রকম এক অভিজ্ঞতাও।
মঞ্চের একদম সামনের সারিতে বসে নাটক দেখার মতো অভিজ্ঞতা চাইলে চলে যান একটু আগেভাগে। শেফের কুকিং কাউন্টারের উপরেই প্লেট সাজিয়ে বসার ব্যবস্থা করা আছে। চেয়ার টেনে বসে পড়ুন। দেখিয়ে দিন কী খেতে চান, কীভাবে খেতে চান জানিয়ে দিন থাইল্যান্ড থেকে মাত্র মাস তিনেকের জন্যই বাংলাদেশে আসা শেফ উইকানকে। পাশেই রাখা আছে গরুর মাংসের ফালি, থাইল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা সুস্বাদু ডোরি মাছ, নরওয়ে থেকে আনা স্যামন, বিশাল আকারের চিংড়িসহ নানান রকম সবজি মায় অনেক কিছু। একদম চোখের সামনেই দর্শনীয় কায়দায় সেটা তৈরি করে দেবেন উইকান। রান্না করতে করতেই কখনো সার্কাসের দক্ষ জাগলারের মতো দুহাতে ঘোরাবেন ছুরি, সসের বোতল আর নানা উপকরণের আধার বা সরঞ্জাম। উত্তপ্ত ধাতব পাতের গন্ধ, উঠে আসা ধোঁয়া, তাতে লেগে থাকা পোড়া মাংসের গন্ধ মিশ্র রসায়ন যখন আপনার নাসারন্ধ্রে ঝাপটা মারছে, তখন চোখের সামনে চলছে এক অদ্ভুত প্রদর্শনী! এই অভিজ্ঞতা ঢাকার বুকে আর কোথাও মিলবে না বলেই জোরালো দাবি ফোর পয়েন্টস কর্তৃপক্ষের। মাত্র ৩০০০ টাকা প্রতিজনে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করুন জাপানি স্বাদের এই রসনাবিলাস। বুফের মতো ঢালাও পরিবেশন করা হয় না ঠিকই, তবে কোনো বাঁধাধরা পরিমাণও নেই। নির্দিষ্ট অঙ্কের ভেতরই উপভোগ করুন যত খুশি! সঙ্গে সুশি, নানান ধরনের স্যালাড, ওরিয়েন্টাল গার্লিক রাইসসহ নানান পদ তো থাকছেই।
বিশাল এক লবস্টারের পিঠে ছুরি চালাতে চালাতে আলাপ হচ্ছিল শেফ উইকানের সঙ্গে। কোথায় কোথায় কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেসব জানাতে জানাতে হঠাৎ বললেন তাজ ওবেরয়, মুম্বাইয়ের কথা। শুনেই চমকে উঠলাম। সেখানেই না একে ৪৭ হাতে হামলা চালিয়েছিল আজমল কাসাভরা! সেই ২৬/১১, যার ভয়াবহতা এখনো ভোলার নয়। উইকান জানালেন, সেদিন তিনি ছিলেন সেই ভয়াল মৃত্যুপুরীতেই। বেঁচে গেছেন ভাগ্যগুণে, ‘আমি প্যানট্রিতে কাজ করছি। হঠাৎ শুনলাম ঠাস ঠাস করে অনেকগুলো কী যেন ফুটল। আমি ভেবেছি কোনো ফিল্মি পার্টি চলছে, সেখানে হয়তো পটকা ফোটানো হচ্ছে। একটু পর এক নেপালি সহকর্মী দৌড়ে এলো।

বলল, সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। সে নিজেও গুলি খেয়েছিল, রক্ত ঝরছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে আমার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। তিন দিন পর কমান্ডো বাহিনী গিয়ে উদ্ধার করে।’
উইকানের গল্পে গল্পে কখন যে বিশাল চিংড়িটা পেটের ভেতর ঠাঁই করে নিয়েছে, টেরও পাইনি। পাত খালি দেখে টাটকা ভাজা ডোরি ফিশের ফিলে তুলে দিয়ে উইকান ফের বলতে থাকেন, ‘ওখানে যাবার আগে আমি টেররিস্ট শব্দটার মানেই জানতাম না।’ জীবন থেমে থাকে না। গুলশানের যে হোটেলে তিনি এখন কাজ করছেন, তার অল্প কিছু দূরেই যে ২৬/১১-এর মতো নারকীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, সেসব নিয়ে কথা নাই-বা হলো বলা। জানতে চাইলাম বলিউড তারকাদের নিয়ে। স্মার্টফোনটা বের করে দেখিয়ে দিলেন আমির খানের সঙ্গে ছবি, ‘আমির খান, আমার বন্ধু। মুম্বাই থেকে আমাকে চেনে।

এরপর থাইল্যান্ডেও আমি যে হোটেলে কাজ করি সেখানে এসেছে। অনেক নিরাপত্তাকর্মী যখন তার আশপাশে কাউকে যেতে দেয় না, তখন সে দূর থেকে আমাকে ডেকে কাছে নিয়েছে।’ ছবি দেখালেন হালের ক্রেজ টাইগার শ্রফের সঙ্গেও। জ্যাকি শ্রফ তনয় তখনো ‘বাঘি’ হয়ে ওঠেননি, চেহারায় কৈশোরের লালিত্য। বলিউডি গল্পে ডোরি ফিশের ফিলেও উধাও প্লেট থেকে। এবারে বিফ তেপানিয়াকির পালা। স্রেফ নুন আর গোলমরিচের সঙ্গে রসুনকুচি দিয়ে ভাজা এই মাংসের ফালিগুলো আমাদের রসনায় একটু ভোঁতা ঠেকলেও স্বাদহীন নয় মোটেও।
জাপানি স্বাদের তেপানিয়াকি খেতে না চাইলেও চেখে দেখার মতো আরও অনেক কিছুই আছে এখানে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রসনারীতির অনেক চেনা পদের সমারোহে আছে সুস্বাদু বুফে। যেখানে জাপানি উদোন স্যুপ, ভিয়েতনামি স্প্রিং রোল, থাই বিফ স্যালাড, ইন্দোনেশিয়ার নাসি গোরেংসহ অনেক কিছুই মজুত। আছে লাইভ চারকোল গ্রিল স্টেশন। সেখান থেকে রুপচাঁদা মাছসহ অনেক কিছুই আপনার পাতে আসার অপেক্ষায়।
ছুটির দিনের সকালে বাচ্চাদের নিয়ে সাঁতার কাটার পর ভূরিভোজ কিংবা সন্ধ্যায় প্রিয়জনকে নিয়ে লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে নানান রসনার স্বাদ নেওয়ার জন্য পানাশ হতে পারে আদর্শ ঠিকানা। যেহেতু এই রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে বছরে মাত্র মাস তিনেক, তাই ঝাঁপ নামবার আগেই ঘুরে আসুন।
শুক্র ও শনিবারে সাঁতারপুলে জলকেলির পর পেট ভরাতে দুজনের (একজন শিশু ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক) খরচ পড়বে ২৭০০ টাকা। সেদিন আবার আর্ট ক্যাম্প, খেলার নানান সরঞ্জামসহ অনেক আয়োজনই থাকে। নৈশভোজে সব মিলিয়ে খরচ হবে জনপ্রতি ৩০০০ টাকা। নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে মূল্য পরিশোধ করলে একজন সঙ্গীর খাবারের দাম দিতে হবে না। অন্য যেকোনো কার্ডে বা নগদে মূল্য পরিশোধে দুজনের সঙ্গে একজনের খাবারের দাম লাগবে না।

লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে এবং দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: টি এম ওয়াহিদ তাওসিফ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top