skip to Main Content

রসনাবিলাস I লাতিন রসনার জাদুবাস্তবতায়

গোটা শহরকে পায়ের নিচে রেখে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে যদি চোখ রাখা যায় দিগন্তরেখায়, সেটা তো রোমাঞ্চকরই! ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের ‘দ্য বিস্ট’ সেই জাদুকরি অভিজ্ঞতাই উপহার দেয়। সেই গল্পই শুনিয়েছেন সামীউর রহমান

করপোরেটদের চলতে হয় স্টাইলের মাথায়, ঘড়ির কাঁটায়। দিনভর কত যে মিটিং আর ই-মেইল! কর্মব্যস্ত দিনের শেষে ক্লান্তি দূর করার ঠিকানা হতে পারে ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের স্কাইডেক। ২৬ তলার ওপর থেকে ঢাকা শহরের এমাথা-ওমাথায় চোখ বুলিয়ে নেওয়ার দুর্লভ সুযোগ পাওয়া যাবে এখানেই। অফিস শেষে সূর্যাস্তের আগে চলে আসুন এখানে, কোনো একটা পানীয় হাতে নিয়ে উপভোগ করুন দিনের শেষ আর রাতের শুরুর সৌন্দর্য। জ্বলে উঠতে দেখুন নগরের বাতিগুলোকে।
পাঠককুলের কাছে ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন নামটি অচেনা নয়। নানান স্বাদের পসরা মেলে নগরের সুখাদ্যপিয়াসীদের মন জয় করে নিয়েছে এই স্থান। পাঁচ তারকা এই পান্থশালার সবচেয়ে অভিজাত অংশটি হচ্ছে লাতিন আমেরিকান স্টেক লাউঞ্জ ‘দ্য বিস্ট’। একদম উপরের তলায় গুলশানের সবচেয়ে উঁচু রেস্তোরাঁটি স্বাদে আর মানেও উঁচু! এমনটাই জানালেন ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ঢাকার বিপণন ব্যবস্থাপক সৈয়দ মেহরান হোসাইন। স্কাইডেকে বসে মোহিতোতে চুমুক দিতে দিতে তার কাছেই শোনা গেল, ‘দ্য বিস্ট হচ্ছে প্রিমিয়াম লাতিন আমেরিকান স্টেক লাউঞ্জ। এখানকার রান্নাঘরের সব সরঞ্জাম আনা হয়েছে দেশের বাইরে থেকে। সবকিছু একদম আন্তর্জাতিক মানের। বিশ্বের বড় বড় শহরে, স্টেকহাউসগুলোতে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয়, সবই এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ শুধু সরঞ্জামই নয়, হেঁশেলের সর্বেসর্বা অর্থাৎ এক্সিকিউটিভ শেফও এসেছেন সুদূর ব্রাজিল থেকে। ফুটবল, কফি আর সাম্বার এই দেশ কিন্তু স্টেকের জন্যও বিখ্যাত! ব্রাজিলিয়ান ঘরানায় মাংস ঝলসে রান্নার কায়দার নাম চুরাস্কো। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়েসহ লাতিন অঞ্চলে মাছ বা মাংস ঝলসে খাওয়ার নামই হচ্ছে চুরাস্কো। যেমনটা ভারতীয় উপমহাদেশে, শিকে গেঁথে মাটি বা তামার বদ্ধ চুলায় মাংস ঝলসানোর কায়দাটার নাম হচ্ছে তন্দুরি, অর্থাৎ তন্দুরে তৈরি। তেমনি চুরাস্কো হচ্ছে উš§ুক্ত চুল্লিতে মাংস ঝলসানোর কায়দা।
সাও পাওলোর ছেলে কাইকি চেরিকোনে সামলাচ্ছেন দ্য বিস্টের হেঁসেল। একেবারেই খোলা এই রান্নাঘর, অতিথিরা দেখতে পারবেন কী করে মাংসের ফালিগুলো পরিণত হচ্ছে সুস্বাদু সব পদে। অতিথিরা চলে আসার আগে তার সঙ্গে খানিকটা আলাপের ফুরসত মিলল। কাইকির কাছ থেকেই শোনা গেল, ‘লাতিন আমেরিকায় যেভাবে স্টেক খাওয়া হয়, ঠিক সেভাবেই তা পরিবেশন করা হয় এখানে। কোনো রকম অদলবদল নেই। মাংসও আসে লাতিন আমেরিকা থেকে। সপ্তাহে তিনবার মাংসের চালান আসে।’ এই প্রসঙ্গে আলাদা করে বলে নিতেই হয়, স্টেকের স্বাদ অনেকটাই নির্ভর করে মাংসটা কোথাকার, তার ওপর। কোথাও স্টেকের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মাংসই ব্যবহৃত হয়, কোথাও পরিবেশন করা হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা মাংস। লাতিন আমেরিকান ঘরানার স্টেকের জন্য ‘দ্য বিস্ট’ রেস্তোরাঁয় যে মাংস ব্যবহৃত হয়, সেটাও আসে কিন্তু লাতিন আমেরিকা থেকে। তবে সেসব হালাল সনদপ্রাপ্ত।
বাঙালি সংস্কৃতিতে পিঠার যেমন হরেক নাম ও নকশা, লাতিন সংস্কৃতিতে স্টেকও প্রায় তেমনই। কোন অংশের মাংস কীভাবে কাটা হয়েছে এবং কতখানি রান্না করা হয়েছে, মূলত এসব বৈশিষ্ট্যের ওপরই নির্ভর করে স্টেকের নাম। কাইকি বললেন, এসব বোঝাতে গেলে সপ্তাহ লেগে যাবে! তবে মোটাদাগে বলা যায় টি-বোন, রিব-আই, টেন্ডারলয়েনসহ বেশ কয়েক রকমের স্টেকের স্বাদ নেওয়া যাবে এই রেস্তোরাঁয়। প্রতিটির সঙ্গে আছে পছন্দসই সাইড ডিশ এবং সসের সমাহার।
কর্মব্যস্ত দিনের শেষে কিংবা সপ্তাহ শেষের ক্লান্তি জুড়াতে, যখনই আসবেন, হাতে যেন খানিকটা সময় থাকে। তাহলেই উপভোগ করতে পারবেন ‘দ্য বিস্ট’-এর জাদুবাস্তব পদগুলো। স্কাইডেকে চলে আসুন সন্ধে নামার আগেই। গলা ভেজান পছন্দসই পানীয়ে। উপভোগ করুন গোধূলির সৌন্দর্য। স্টেক অর্ডারের আগে হালকা মুখ চালাতে অর্ডার করতে পারেন মেনুর ‘স্মল বাইটস’ অংশ থেকে। এখানে পাবেন মিক্সড সি ফুড, চিকেন আর নানান ধরনের পনিরের মুচমুচে ভাজার সঙ্গে বিভিন্ন লাতিন ভেষজের নির্যাস মেশানো সসের মুখরোচক খাবার। কিংবা নিতে পারেন ক্রিম অব মাশরুম স্যুপের স্বাদও। পরিবেশনাটা নজর কাড়বে। কোনো আলাদা পাত্রে নয়, বিশাল এক রুটির ভেতর গর্ত খুঁড়ে তাতেই পরিবেশন করা হয় এই স্যুপ। ঝাল ঝাল স্বাদের রুটিটাও স্যুপ খেতে খেতে চেখে দেখতে মন্দ লাগবে না। এসব খেতে শুরু করার আগেই দিন স্টেকের অর্ডারটা। কারণ, বানাতে একটু সময় লাগবে। আর স্যুপ বা স্টার্টার চেখে দেখার পর স্টেকের জন্যও খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।
কাইকির ভাঁড়ারে আছে বেশ কয়েক রকমের স্টেক। ব্রাজিলিয়ান পিকানহা স্টেক পরিবেশন করা হয় মাশরুম রাইসের সঙ্গে। কাইকির গোপন মসলায় ম্যারিনেট করা টি-বোন স্টেক পরিবেশন করা হয় মিষ্টিকুমড়ার পিউরির সঙ্গে। আছে রিব-আই স্টেক, যেটা হাজির করা হয় মসলা মাখানো ভুট্টার দানার সঙ্গে। পাঁজরের নরম মাংসের ঝলসানো খন্ডগুলো, অর্থাৎ বারবিকিউ রিবস পরিবেশন করা হয় ব্রাজিলিয়ান কায়দায় রান্না করা শস্যদানার সঙ্গে। লাতিন আমেরিকান রসনাবিলাসের বাইরে ধ্রুপদি স্টেকের স্বাদও নিতে পারেন এখানে। টেন্ডারলয়েন স্টেকের সঙ্গে থাকবে ম্যাশড পটেটো আর সারলয়েন স্টেকের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। এ ছাড়া সসের সঙ্গে চিমিচুরি সস, অনিয়ন গ্রেভি—এসব তো থাকছেই।
পাখির চোখে শহরটা দেখা হলো, সন্ধের হাওয়া গায়ে মাখাও হলো। চেখে দেখা হলো সুস্বাদু সব রান্না, যার ঘ্রাণে মন হলো মাতোয়ারা। শুধু কি এই? শ্রুতিসুখের জন্য দ্য বিস্টে আছে লাইভ মিউজিকের বন্দোবস্তও। স্প্যানিশ গিটারে সুরের ঝংকার তুলে অতিথিদের মন ভরিয়ে দেবার আয়োজনও আছে এখানে।
ঘড়ির কাঁটা মেপে চলা জীবন থেকে একটু বিরতি নিতে তাই আসতেই পারেন মেঘের কাছাকাছি এই রেস্তোরাঁয়। দামটা খানিকটা চড়া, করপোরেট যান্ত্রিকতা থেকে দম ফেলবার ফুরসত হিসেবে এটুকু খরচ তো করাই যায়!
লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে
ছবি: ওমর ফারুক টিটু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top