skip to Main Content

রসনাবিলাস I সমুদ্ররসনার স্বপ্নরসুই

উভয়ে অসম বয়সী। বন্ধুত্বের সূত্রপাত রান্না শেখার পাঠশালায়। এরপর সস্তায় সুস্বাদু সামুদ্রিক খাবার উপভোগ করানোর যৌথ স্বপ্ন থেকে জন্ম নিয়েছে ওহানা ডাইনার। লিখেছেন সামীউর রহমান

সমুদ্র হচ্ছে জীবনের উৎস। বিশ্ব পরিবারের পরম পিতা। হাওয়াইয়ের লোকজ বিশ্বাস এমনটাই। পারিবারিক প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত এই দ্বীপরাজ্যের বাসিন্দা হয়েছিলেন আয়েশা হোসাইন শাহনীলা। পেশায় শিক্ষিকা, ঢাকার নামী একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বহুদিন ধরে। পড়ালেখার বাইরে তাঁর শখ রান্না করা। তবে সেটা আটপৌরে কিছু নয়। সে জন্য রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ রকমই একটি কালিনারি স্কুলে শাহনীলার সঙ্গে পরিচয় হয় চট্টগ্রামের ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের। দুজনের বয়সের ফারাকটা বেশ হলেও চিন্তাধারা একই রকম। তাই বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনি। দুজনে মিলে বেশ কিছু ক্যাটারিং অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজও করলেন, স্কুলের ক্যানটিনও চালালেন। কিন্তু স্বপ্ন আরও বড়, নিজেদের মতো করে কিছু করার। সেই স্বপ্নেরই প্রথম সংস্করণ ‘ওহানা ডাইনার’। হাওয়াইয়ান ভাষায় ওহানা অর্থ পরিবার। পরিবারের সবাইকে অনিঃশেষ মমতায় রেঁধে খাওয়ানো। ‘ওহানা ডাইনার’-এর অবস্থান লালমাটিয়ায়; সানরাইজ প্লাজা বিপণিবিতানের পাশের গলি দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই পেয়ে যাবেন ওহানা ডাইনারের খোঁজ। বলে রাখা ভালো, মাত্র মাস ছয়েক আগেই যাত্রা শুরু করা এই খাবার ঘরের পরিসরটা বেশ ছোট। তাই খুঁজে পেতে চোখটাকে একটু সজাগ রাখতেই হবে।
কথায় বলে, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই ভালোবাসা হোক বড়’। ওহানা ডাইনার আয়তনে আপাতত ছোট হলেও উদ্যোক্তারা সাজিয়েছেন বড় যত্ন করে। একদিকের দেয়ালজুড়ে সমুদ্র এঁকে দিয়েছেন শাহনীলার স্কুলের ছবি আঁকার শিক্ষক। সেই নীল দেয়ালে আবার কক্সবাজার সৈকত থেকে কুড়ানো শামুক-ঝিনুক সেঁটেছেন শাহনীলা নিজেই। মাছ ধরার জাল, শামুক, ঝিনুক— সবকিছু দিয়ে সাজানো রেস্তোরাঁয় ঢুকলেই মনে হবে যান্ত্রিক নগর ছেড়ে যেন আগমন ঘটলো সমুদ্রের ধারে। দেয়ালের একটা পাশ আবার হাওয়াইয়ের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। হাওয়াই-বাসের নানান স্যুভেনির এমনকি সেখানে তাদের গাড়ির নম্বরপ্লেটটাও শাহনীলা যত্ন করে বসিয়েছেন দেয়ালে।
বসার জায়গার সামনেই কাচঘেরা রান্নাঘর। মেন্যু দেখে অর্ডার দিয়ে দেখতে পাবেন, কী করে আস্ত অক্টোপাস সেদ্ধ হচ্ছে লেবুর রস দেওয়া গরম জলে। আগুনের লকলকিয়ে ওঠা শিখায় ঝলসে যাচ্ছে রুপচাঁদা। বেশির ভাগ উপকরণই দৃশ্যমান। তার ওপর শাহনীলা ও গিয়াস দুজনের আতিথেয়তায় খাবার নিয়ে গল্প করতে করতেই টেবিলে চলে আসবে গরম গরম খাবার। ঢাকায় সি ফুড পরিবেশনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে নিয়মিত সামুদ্রিক মাছের জোগান। চট্টগ্রামের হালিশহরের ছেলে গিয়াস সেই চ্যালেঞ্জটা জয় করার উপায় বের করেছেন। শহরের ফিশারিঘাটে নিজে গিয়েছেন সাতসকালে। বেছে বেছে কিনে এনেছেন সেরা চিংড়ি, রুপচাঁদা আর অক্টোপাস। স্যামন কিংবা ডোরি ফিশের জন্য অবশ্য আমদানিই ভরসা। এ ছাড়া নানান রকম সস ও অন্য উপাদানগুলো নিজের হাতেই কেনেন গিয়াস। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শেফ তিনিও, তাই প্রায়ই হাত লাগান রান্নাঘরে। শাহনীলা হাসতে হাসতেই বলছিলেন, ‘আমরা কেউ উদ্যোক্তা নই, ব্যবসায়ীও নই। আমরা রাঁধুনি, খাইয়েই আমাদের সুখ।’ ছোট করে শুরু করলেও তাদের স্বপ্নটা বড়। অনেকেই আসছেন সামুদ্রিক খাবারের স্বাদ নিতে। ছোট জায়গা দেখে অনেকে আসার কষ্টটা না করে অনলাইনে অর্ডার করছেন। সপ্তাহের মাঝামাঝি দিনের সন্ধ্যাতেও চোখে পড়ল জনাদশেক খাদ্যরসিক ঢুঁ মেরেছেন ‘ওহানা’য়। প্রায় সমানসংখ্যক অনলাইন অর্ডারও ডেলিভারি করলেন সেই সময়টায়। শাহনীলাই বললেন, ‘শুরুতে সবাই একটু দ্বিধায় থাকে। তবে যারা একবার খেয়েছেন, তারা কিন্তু আবার এসেছেন।’ কথা বলতে বলতেই খাবার হাজির। মুখে দিয়েই মনে হলো, দাবিটা একদমই অযৌক্তিক নয় তার!
সামুদ্রিক মাছের ভেতর আমাদের কাছে রুপচাঁদাই সবচেয়ে চেনা কিংবা পছন্দের। এ মাছের ফ্রাই, ঝোল, গ্রিল…কতভাবেই না খাওয়া হয়েছে কক্সবাজারে। তবে ওহানার রুপচাঁদা মাছের স্বাদই আলাদা। ম্যারিনেশনটা অন্য রকম, মাছের ভেতরের রসাল স্বাদটা ধরে রেখে গ্রিল করায় স্বাদের খোলতাই হয়েছে বেশ। সঙ্গে পোড়া রসুন, টমেটো আর ক্যাপসিকামের স্পেশাল স্যালাড। তবে ওহানার সিন্দুকে আছে আরও অনেক মণিরত্ন। আটপেয়ে দৈত্য বা অক্টোপাসের আক্রমণে সিন্দাবাদের জাহাজডুবির গল্প বোধ হয় পড়া আছে আরব্য রজনীতে। সেই দৈত্য যখন আপনার সামনে প্লেটে আট পা ছড়িয়ে হাজির, তখন কী করবেন? তরোয়ালের বদলে ছুরি কাঁটা চালিয়ে সেটাকেই খাবেন! সেদ্ধ করে সস মাখিয়ে ভাজা অক্টোপাস খেতে একদম খোসা ছাড়ানো চিংড়ির মতোই। বিশাল অক্টোপাস খেতে ভয় পেলে চেখে দেখতে পারেন পনির, ব্ল্যাক অলিভ, মাশরুম লেটুস আর অক্টোপাসের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে বানানো সি ফুড স্যালাড।
আপনি কি ইংল্যান্ড ফুটবল দলের ভক্ত? তাহলে ইংরেজদের প্রিয় খাবার ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’ চেখে দেখতে পারেন। কাঁটা ছাড়ানো মাছের ফিলের মচমচে ভাজার সঙ্গে আলুভাজা খেতে খেতে চুমুক দিতে পারেন কফিতে। ইতালির সমর্থক হলে অর্ডার করতে পারেন সি ফুড পাস্তা বা স্প্যাগেটি। জাপানের অনুরাগী হলে এখানকার সুশির স্বাদ আপনাকে মোহিত করবে। বাচ্চাদের জন্য আছে চিকেন ললিপপ আর সময় কাটাতে দেওয়া হয় ড্রইং বুক।
ওহানা ডাইনারের ট্যাগলাইন, ‘হিয়ার হ্যাপিনেস ম্যাটারস’। শাহনীলা আর গিয়াস আপাতত লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষছেন না; বরং তাদের অভিলাষ পূরণ করছেন মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে সামুদ্রিক খাবারের স্বাদ উপহার দিয়ে। গিয়াস নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছিলেন, আমাদের কক্সবাজারে ভালো সি-ফুড খেতে অনেক খরচ পড়ে যায়। আমি চেয়েছিলাম, কম খরচে কী করে ভালো খাবারটা দেওয়া যায়। সে জন্য মেনু নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, নিজে বাজার করেছি। সবকিছুর ফসল হচ্ছে ওহানা ডাইনারে খেতে আসা মানুষের প্রশংসা। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের দিকে জায়গা খুঁজছে ওহানা ডাইনার। পেয়ে গেলে আরও বড় পরিসরে সমুদ্রস্বাদের বিচিত্র পসরা নিয়ে হাজির হবেন গিয়াস ও শাহনীলা। তার আগ পর্যন্ত লালমাটিয়াতেই থাকছে তাদের সমুদ্ররসনার স্বপ্নরসুই।

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার এবং রসনালিখিয়ে
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top