skip to Main Content

সঙ্গানুষঙ্গ I মন্দিরমূর্ত

নৈবেদ্যর প্রথা থেকে সাধারণের গয়নায়। চেনা ধাতুতেও নজরকাড়া। স্থান পেয়েছে ইনস্টাফ্রেন্ডলি জেডজেনদের বক্সেও। বর্ণনায় জাহেরা শিরীন

গয়না নয়, যেন একেকটি আর্টপিস। টেম্পল জুয়েলারির আউটলুকটাই এমন। ঐতিহ্যবাহী তো বটেই। এথনিক স্টাইল জুয়েলারিগুলোর মধ্যে এর ইতিহাস সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। তাই হেরিটেজ জুয়েলারি হিসেবে কদর রয়েছে বহু যুগ ধরে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের আখ্যান থেকে অনুপ্রাণিত এ গয়নাগুলো। টেম্পল জুয়েলারির সূচনা এখান থেকেই। ঘটনার বিবরণ অনুসারে নবম থেকে ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রচলিত হয় টেম্পল জুয়েলারি। দক্ষিণ ভারতীয় চোলা, পান্ডেয়া আর কৃষ্ণ দেব রায়া রাজবংশের রাজত্বের সময়ে। দামি ধাতুতে তৈরি এসব গয়না সে অঞ্চলের মন্দিরের দেবদেবীদের ভেট দেওয়ার জন্য তৈরি হতো।

পরবর্তীকালে রাজবংশীয় অভিজাতদের মধ্যেও এর কদর বাড়ে। কিন্তু এ নিয়ে কিছু দ্বিমত পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাসবিদের ভাষ্য, রাজপরিবারের গয়নাগুলো সুরক্ষিত রাখতে এগুলো পরিয়ে দেওয়া হতো দেবদেবীর গায়ে। তবে শুরুটা যেভাবেই হোক না কেন, টেম্পল জুয়েলারি প্রথম থেকেই অনুষঙ্গ হিসেবে অনন্য। তাই দেবদেবী, রাজরাজড়া থেকে সাধারণের হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেয়নি এ ধরনের গয়না। পরবর্তীকালে মন্দিরের নৃত্যশিল্পী আর ভক্তরাও গায়ে জড়াতে শুরু করেন টেম্পল জুয়েলারি। তবে রেপ্লিকা ভার্সন, তুলনামূলক কম দামি ধাতুতে তৈরি। দেখতে দারুণ হওয়ায় ক্রমেই বাড়তে থাকে এর জনপ্রিয়তা। অন্যদিকে দেবদেবীকে অর্পণের প্রেরণায় গয়নাগুলোকে ঘিরে আলাদা একধরনের ধর্মীয় অনুভূতি গড়ে ওঠে। টেম্পল জুয়েলারির গুরুত্ব বাড়ে। শিশু জন্ম কিংবা বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে। সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবেও গণ্য হতে শুরু করে। যার প্রচলন রয়েছে আজ অব্দি।
টেম্পল জুয়েলারি মানেই মন্দিরপ্রাণিত। এই গয়নায় মূর্ত হয়ে থাকে দেবদেবী ও তাদের অঙ্গভঙ্গি। যেগুলোর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত, পদ্মের ওপর বসে থাকা দেবী লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি। এ ছাড়া দেবতা গণেশ আর শিবের দেখা মেলে টেম্পল জুয়েলারিতে। ট্র্যাডিশনাল মোটিফগুলোর মধ্যে তামারাপ্পু (পদ্ম ফুল), কক্কু (সারস পাখি) আর মাকারা (কুমির) টেম্পল জুয়েলারিতে আজ অব্দি জনপ্রিয়। এ ছাড়া রাজহাঁস, ময়ূর, পাতা, গাছ, ঘণ্টা, কয়েন মোটিফও অহরহ নজর কাড়ে বিশেষ ধরনের এ গয়নাগুলোতে। এ ছাড়া মন্দিরের চূড়া আর অভ্যন্তরের কারুকার্যও ফুটিয়ে তোলা হয় গয়নার গায়ে। সাধারণত সলিড সোনায় গড়ানো হয় টেম্পল জুয়েলারি। কোনো ধরনের হীরা, মাণিক্য-মুক্তা ব্যতিরেকে। কিন্তু তাতেও এই গয়নার সৌন্দর্যে ঘাটতি হয় না এতটুকু।

কারণ, টেম্পল জুয়েলারির আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে দক্ষ কারিগরি হাতের নিখুঁত মুনশিয়ানায়। হ্যান্ডক্রাফটেড প্রতিটি পিসের অনুপ্রেরণা সাউথ ইন্ডিয়ার বর্ষীয়ান সব মন্দিরের ভাস্কর্য, ইলাস্ট্রেশন আর নিখুঁত কার্ভিং টেকনিক। যার অনুকরণে তৈরি হয় টেম্পল জুয়েলারি। তৈরি হয় চাঙ্গি ডিজাইনের নেকপিস, ইয়াররিং, ওয়েস্টব্যান্ড, অ্যাঙ্কলেট, আর্মলেট, নোজ রিং, টো রিং আর মাথার গয়না।
ডাই এবং মোল্ড তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় গয়না গড়ার প্রক্রিয়া। মন্দিরের চূড়া, দেবদেবীর মূর্তিসহ বিভিন্ন মোটিফের আদলে বানানো হয় মোল্ডগুলো। আস্ত সোনা অথবা রুপার খন্ডকে পাতলা পাতে রূপান্তর করে নেওয়া হয়। এ থেকে স্ট্রিপ কেটে পছন্দসই আকারে তৈরি করা হয় মোল্ড। গোল্ড ফয়েল, পেটানো সোনার পাত আর গলানো সোনার সংমিশ্রণের সঙ্গে ডাই মিশিয়ে মোল্ডগুলো ভরাট করে নেওয়া হয়, গয়নার নকশা অনুসারে।

সোনা ছাড়াও রুপার বেজ দিয়েও তৈরি হয় টেম্পল জুয়েলারি। এর ওপর দিয়ে দেওয়া হয় গোল্ড ফয়েলের প্রলেপ। সেই পরত গয়নার গায়ে বসে যাওয়ার পর রং ঝালাইয়ের জন্য পাঠানো হয়। সবশেষে পলিশ করে নেওয়া হয় বাড়তি উজ্জ্বলতা যোগে। পুরো প্রক্রিয়াতে দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজন হয় দারুণ ধৈর্য আর মনোযোগ। কারণ, টেম্পল জুয়েলারি তৈরির কাজগুলো খুবই সূক্ষ্ম। ফলে একেকটি পিস তৈরিতে লেগে যায় সপ্তাহ, কখনো কখনো মাস অব্দি। মোল্ডিং, ফিলিং থেকে ফিনিশিং—প্রাচীন প্রক্রিয়ায় গয়না গড়ার পুরো কাজটাই হতো হাতে। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে প্রক্রিয়ার কোনো কোনো ধাপ এখন সেরে নেওয়া হয় যন্ত্রে। বিশেষ করে ফিনিশিং আর পলিশিং। ফলে টেম্পল জুয়েলারি তৈরির কাজটা তুলনামূলক স্বল্প সময়ে সারা সম্ভব হয় এখন।
শুধু যে প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে, তা কিন্তু নয়। কনটেম্পরারি ডিজাইনের টেম্পল জুয়েলারির নকশাতেও এসেছে বৈচিত্র্য। আগে শুধু সলিড সোনা বা রুপায় গড়ানো হলেও এখন যুক্ত হচ্ছে এমারেল্ড, পার্ল, রুবির মতো সেমি প্রেশাস জেমস্টোন। হীরার ঝলকানিও সনাতনী স্টাইলের গয়নাগুলোতে তৈরি করছে অনন্য আকর্ষণ। ফিলিগ্রি ওয়ার্কও যুক্ত হচ্ছে টেম্পল জুয়েলারির নকশায়। গয়নার ধাতুতেও যোগ হয়েছে তামা, পিতল ও কাঁসা। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী করে সাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া।

ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top