skip to Main Content

স্বাদশেকড় I জুয়ার আসর থেকে

এক ব্রিটিশ জমিদারের চটজলদি খাওয়ার দৃশ্যই বন্ধুদের ব্যাকুল করে তুলেছিল। তাতেই খাবারটির ইতিহাস শুরু হলো। বিশ্বজুড়েই আজ এর রমরমা

স্যান্ডউইচ। দুই পিস পাউরুটির মাঝে এক ফালি পনির, টুনা মাছ, মাংস অথবা ডিম। সঙ্গে হয়তো এক চাকা টমেটো, একটি কি দুটি লেটুস পাতা। রুটির পিঠে মাখন, মেয়োনেজ কিংবা মাস্টার্ড সস মাখানো। ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির কল্যাণে স্যান্ডউইচ পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের প্রায় সব শহরেই। বাচ্চার স্কুলের টিফিন, অফিসে কাজের ফাঁকে চটজলদি লাঞ্চ, হঠাৎ অতিথি আপ্যায়ন কিংবা যাত্রাপথের ছোট খিদে—সবকিছুরই সহজ সমাধান এটি। বানাতে সময়ও লাগে কম, তেলমসলার বালাই নেই, বহন করা সহজ আর খেতে গেলে হাতও মাখামাখি হলো না। ঝটপট খেয়ে ফেলা যায়, এই সুবিধাই স্যান্ডউইচ নামের খাবারটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
সময়টা আঠারো শতকের ইংল্যান্ড। বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে বসে জুয়া খেলছিলেন জন মন্টেজু, কেন্টের স্যান্ডউইচ অঞ্চলের জমিদার। ক্রিবেজ নামের একধরনের তাসের জুয়ার টেবিল ছেড়ে উঠতে অনীহা, ওদিকে খিদেতেও পেট চোঁ চোঁ। জমিদারি ভোজ বলে কথা, ছুরি কাঁটাচামচ—কত কিছুই তো লাগে খেতে। কিন্তু জুয়াড়ির ভাগ্যে বিশ্বাস, উঠে গেলে যদি ভাগ্যদেবীও সটকে পড়েন! তাই খানসামাকে ইশারা করলেন রুটির ভেতরেই মাংস ভরে দিয়ে যেতে। যেন কাঁটাচামচ ছাড়াই খেয়ে নেওয়া যায়। সেভাবেই দিয়ে গেল খানসামা। অন্য বন্ধুরা তো এই অভিনব কায়দার খাওয়া দেখে অবাক। তারাও হাঁক পেড়ে বলল, ‘স্যান্ডউইচ যেভাবে খাচ্ছে, আমাদের জন্যও সেভাবে বানিয়ে নিয়ে এসো।’ সেই থেকে দুই ফালি রুটির মাঝে পনির বা মাংস গুঁজে দেওয়া খাবারটার নাম হয়ে গেল স্যান্ডউইচ। বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবনসের লেখা থেকে জানা যায় স্যান্ডউইচের উৎপত্তির গল্পটা। তবে আরও অনেক লেখাতেও পাওয়া যায়, এভাবে রুটির মাঝে মাংস ভরে খেত ইহুদি তীর্থযাত্রীরা, অনেক পানশালায় শেষবেলার বেঁচে যাওয়া রুটির মাঝে উচ্ছিষ্ট মাংস দিয়ে বিক্রি করা হতো দরিদ্রদের কাছেও। তবে ‘স্যান্ডউইচ’ নামটা স্থায়ী হয়ে যায় চতুর্থ আর্ল অব স্যান্ডউইচের এই আলসেমির কারণেই, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল যেটাকে বলছে খাদ্য ও রসনার জগতে ব্রিটেনের সেরা অবদান! পাশ্চাত্যে পিকনিকে, অফিসের লাঞ্চে কিংবা যাত্রাপথে প্যাকেট লাঞ্চ হিসেবে খুবই জনপ্রিয় এই খাবার এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলোরও মাথাব্যথা কমিয়েছে। আকাশপথে ভ্রমণে সংক্ষিপ্ত যাত্রায় সংক্ষিপ্ততম স্যান্ডউইচ পরিবেশন করে আতিথেয়তা রক্ষা করে চলেছে অনেক এয়ারলাইনস! ৩ নভেম্বরকে জাতীয় স্যান্ডউইচ দিবস হিসেবে পালন করে আমেরিকানরা।
মূলনীতিটা ঠিক রেখে স্যান্ডউইচ হতে পারে অনেক রকম। কারও পছন্দ টোস্টেড, কেউবা পছন্দ করেন দুই ফালি নরম রুটির ভেতর মেয়োনেজ, পনির আর মাংসের ফালির স্বাদ। সাধারণ আকৃতিতে স্যান্ডউইচ জ্যামিতি বইয়ের ত্রিভুজের আদর্শ উদাহরণ, তবে অন্যান্য আকারেরও স্যান্ডউইচ হয়। ডুবোজাহাজের মতো আকার, তাই নাম সাবমেরিন স্যান্ডউইচ, সংক্ষেপে ‘সাব’। ক্লাবহাউস স্যান্ডউইচ বা ক্লাব স্যান্ডউইচে থাকে একাধিক স্তর। স্যান্ডউইচের ইতালিয়ান সংস্করণটির নাম ‘পানিনি’, মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘পিটা ব্রেড’-এর ভেতর মালমসলা ঢুকিয়ে বানানো খাবারটির নাম হয়ে গেছে পকেট স্যান্ডউইচ। ঠান্ডা কিংবা গরম, মুচমুচে কিংবা নরম, আমিষভোজী অথবা নিরামিষভোজী—এটি সবার জন্য, সব রকম।
সাব-স্যান্ডউইচের জন্ম মার্কিন মুলুকে, ইতালিয়ান অভিবাসী শ্রমিকদের হেঁসেলে। ধারণা করা হয় পোর্টল্যান্ড শহরে জন্ম লম্বাটে আকৃতির এই স্যান্ডউইচের। লম্বাটে ইতালিয়ান ব্রেড মাঝ বরাবর কেটে তার ভেতর ঠান্ডা মাংসের ফালি, লেটুস, টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজ, জলপাই তেল, ইতালি থেকে আনা নানান রকম মসলা—সবকিছু দিয়ে সঙ্গে পনিরের স্লাইস দিয়ে পরিবেশন করতেন ডোমিনিক কন্তি নামের ইতালি থেকে আসা একজন অভিবাসী। তার বয়ান থেকে জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ডুবে যাওয়া একটা ডুবোজাহাজকে আবার সমুদ্র থেকে তুলতে দেখেছিলেন কন্তি, ‘ফেনিয়ান র‌্যাম’ নামের সেই ডুবোজাহাজের সঙ্গে তার বানানো স্যান্ডউইচের আকৃতির মিল দেখেই নাম দেন সাবমেরিন স্যান্ডউইচ। ‘সাব-ওয়ে’ হচ্ছে সাব-স্যান্ডউইচ বিক্রির সবচেয়ে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি, বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে ৪২ হাজারের মতো দোকানে তারা বিক্রি করছে এই স্যান্ডউইচ!
আঠারো শতকে স্যান্ডউইচের জমিদারকে খেতে দেখে বন্ধুদের আকাক্সক্ষা থেকে যে খাবারের জš§, কয়েক বছরের মধ্যেই লন্ডনের রাস্তায় ৭০ জনকে দেখতে পাওয়া যায় সেই খাবারটা বিক্রি করতে। আর এখন স্যান্ডউইচকে ঘিরে চলছে ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য! লোকে তা দোকানে খাচ্ছে, বাসায় বানিয়ে খাচ্ছে। খাবারটি বানাবার জন্য স্যান্ডউইচ মেকার তৈরি করছে বিশ্বের বিখ্যাত ইলেকট্রনিক ব্র্যান্ডগুলো।
ঢাকায় পাড়ার কনফেকশনারির দোকানে বাটার পেপার মোড়ানো স্যান্ডউইচ থেকে ইলেকট্রিক স্যান্ডউইচ মেকারে তৈরি গ্রিলড স্যান্ডউইচ, একটা সময় ফাস্ট ফুডের দোকানে দেদার বিকিয়েছে। সসলেই’জ-এর হান্টার বিফ স্যান্ডউইচ, চিকেন স্যালাড স্যান্ডউইচ একটা সময় মন জয় করেছিল ভোজনরসিকদের। কলকাতার কফি হাউসেরও আছে নিজস্ব ঘরানার স্যান্ডউইচ। নিউইয়র্কের ইউনিয়ন ক্লাবের রেস্তোরাঁয় সদস্যদের জন্য পরিবেশন করা খাবারটিই পরিচিতি পায় ক্লাব স্যান্ডউইচ নামে। মুম্বাইয়ের রাস্তায় ধনেপাতার চাটনি, পেঁয়াজকুচি, টমেটোর ফালি, ক্যাপসিকামের ফালির সঙ্গে পনির দিয়ে গনগনে চুলায় ধাতব বাক্সে ভরে বানানো মুম্বাই স্ট্রিট স্যান্ডউইচ—বৈচিত্র্যের শেষ নেই।

 সামীউর রহমান
লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top