skip to Main Content

স্মরণ I নিগ্রো ভাই আমার

নিপীড়িত কালো মানুষের মুক্তিসংগ্রামের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষের সূচনা হয়েছে গত ১৮ জুলাই। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রাম, দীর্ঘ কারাবাস এবং কারামুক্তির পর নোবেল পুরস্কার অর্জন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের মতো বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন নিয়ে ম্যান্ডেলা কিংবদন্তি হয়ে আছেন। মানবতাবাদ, বৈষম্যহীন সমাজ ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে তাঁর অবদান প্রাতঃস্মরণীয়।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফিকায় বর্ণবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সব বহুত্ববাদী গণতন্ত্র প্রচলন করেন ম্যান্ডেলা, সে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের ওপর শ্বেতাঙ্গদের ভয়াবহ অত্যাচার, সন্ত্রাসের বিরোধিতায় ম্যান্ডেলা এবং তার অনুসারীদের ওপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। জীবনের সুদীর্ঘ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল কারাগারে। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর পুত্রের মৃত্যু এবং এর এক বছর পর মায়ের মৃত্যুতে একবারের জন্য জেল থেকে প্যারোলেও ছাড়া পাননি তিনি। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর থেকে প্রেরণা পান ম্যান্ডেলা, কিন্তু হিংস্র বর্ণবাদী ব্যবস্থার অবসানে অহিংসার কৌশল যে কার্যকর নয়, তা অনুভব করে সশস্ত্র রাজনৈতিক গেরিলা সংগঠনের নেতৃত্বও গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
এখন থেকে ঠিক এক শ বছর আগে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই থেম্বো রাজপরিবারের ক্যাডেট শাখায় নেলসন ম্যান্ডেলা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজপরিবারের কাউন্সিলর ছিলেন। নিজ গোত্রের মধ্যে ম্যান্ডেলা ‘মাদিবা’ নামে পরিচিত। শৈশব কাটে নানাবাড়িতে। তাঁর পরিবারের তিনিই প্রথম স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর নামের সঙ্গে ‘নেলসন’ শব্দটি যুক্ত হয়। হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টসে ভর্তি হন ম্যান্ডেলা। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় অলিভার টাম্বোর সঙ্গে। নেলসন ম্যান্ডেলার সারা জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন টাম্বো। তাঁর আরও একজন খুব কাছের বন্ধু ছিলেন ট্রান্সকেইয়ের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কাইজার (কে ডি) মাটানজিমা। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরেই বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন ম্যান্ডেলা। জোহানেসবার্গের একটি খনিতে প্রহরী হিসেবে কাজ নেওয়ার অল্প ক’দিনেরই মধ্যেই সেখান থেকে তাঁকে ছাঁটাই করা হয়। পরে আরও কিছুদিন আইনি প্রতিষ্ঠানে কেরানির কাজে তিনি যুক্ত হন। ওই সময়েই ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ম্যান্ডেলা। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ফোর্ট হেয়ার আর ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। জোহানেসবার্গে বেশ কিছুদিন আইনজীবী হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় দক্ষিণপন্থী বর্ণবাদী দল ন্যাশনাল পার্টি। এরপর দেশটিতে বর্ণবাদের প্রবল উত্থান ঘটে। বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু এই আন্দোলনে বেশি দিন আস্থা রাখতে পারেননি তিনি। একসময় মার্ক্সবাদের প্রতিও আকৃষ্ট হন। ১৯৫৬ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টিতে গোপনে যোগ দেন। কারণ, ওই দল সেই সময় নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলা চলে ৫ বছর। কিন্তু শেষমেশ ধৃত প্রত্যেক আসামিই নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মিলিটারি উইং ‘উই সিযওয়ের (এম কে) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই সংগঠন বর্ণবাদী সরকার ও রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার আত্মঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। কিন্তু সরকারের মনোভাবের এতেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই গেরিলাযুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করেন ম্যান্ডেলা। নিজের সংগঠনের জন্য বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ আর সামরিক প্রশিক্ষণের কাজও শুরু করেন। প্রায় ১৭ মাস ফেরারি থাকেন তিনি। কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সহায়তায় তাঁকে গ্রেফতার করে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। বেআইনিভাবে দেশের বাইরে যাওয়া শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৬২ সালের ২৫ অক্টোবর ৫ বছরের কারাদন্ড হয় ম্যান্ডেলার। এএনসির গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৬৪ সালের ১১ জুন যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা ঘোষণা করা হয়। রবেন দ্বীপে শুরু হয় কারাবাস। ২৭ বছরের মধ্যে সেখানেই তিনি কাটিয়েছেন টানা ১৮ বছর। কারাগারে থাকাকালে বিশ্বব্যাপী তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। কারাগারের অন্তরাল থেকেই ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা শুরু করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৮১ সালে তাকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে তিনি প্রিন্সেস অ্যানের কাছে পরাজিত হন। গোটা বিশ্বের চাপের মুখে পড়ে ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। মুক্তিকামী জনতার নেতা ম্যান্ডেলার কারামুক্তির কথাও ঘোষণা করা হয়। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্ত হন তিনি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন এএনসির। এরপর বর্ণবাদের অবসান ঘটানোর জন্য সরকারের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসেন। সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ক্লার্ক ও নেলসন ম্যান্ডেলাকে ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা। ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ম্যান্ডেলা। বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যান্ডেলার হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি এসেছিলেন ঢাকায়।

 অতনু সিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top