skip to Main Content

স্মরণ I পদ্মাপারের বাঙালি রাজপুত্র

কারও পরিচিতি যদি বাঙালি ইহুদি হয়, তবে তা প্রবল আশ্চর্যের। কিন্তু মর্ডিকাই হাইন কোহেন আদ্যোপান্ত বাঙালি। কারণ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিই তাঁর পরিচয়। বাংলাদেশে টেলিভিশনের সূচনাটাও তাঁকে দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কলকাতা থেকে সক্রিয় ছিলেন তিনি। নিজের সত্তায় পদ্মাপারের রাজশাহীকে আমৃত্যু লালন করেছেন। তাঁকে নিয়ে লিখছেন অতনু সিংহ

মর্ডিকাই হাইন কোহেন

‘বাঙালি’ নামটা আসলে একটি নদীর নাম। বঙ্গ, বাঙালি, বাংলা- এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নদী। বাঙালির জীবনের গল্প এক নদীতে শুরু হয়ে আরেক নদীর ঘাটে শেষ হয়। বাংলাদেশের ছেলে মর্ডির জীবনও এমনটাই। ধর্মে ইহুদি, ভাষা ও সংস্কৃতিতে বাঙালি। যাঁর জন্ম গঙ্গা বা ভাগীরথীর পূর্ব পারে কলকাতায়, কিন্তু শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সূচনা পদ্মাপারের বরেন্দ্রভূমিতে। একসময় কলকাতায় ফিরে যাওয়া। তারপর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গেই। এক নদী থেকে জীবনের গল্প শুরু হয়ে অন্য নদীর ঘাটে যে গল্পের বিস্তার, তার সমাপনও নদীমাতৃক শহরে। কিন্তু বহমান এই জীবনের সবচেয়ে বর্ণময় দিনগুলো কেটেছে পদ্মাকে কেন্দ্র করে। পদ্মাপারে মোটরবাইকে করে ঘুরে বেড়াতেন মর্ডি। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা। নাটকে অভিনয়, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। তারুণ্যে ভরপুর এক যুবক, অনেকের চোখেই রাজশাহীর হিরো। মেয়েরা পাগল ছিল তাঁর জন্য।
রাজশাহী থেকে নদীঘেরা আরও এক শহর ঢাকায় চলে এসেছিলেন মর্ডিকাই। তখনো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাশাপাশি ঢাকা টেলিভিশনে ঘোষক হয়ে উঠলেন মর্ডি। তাঁর দৃপ্ত বাংলা ও ইংরেজি উচ্চারণে পূর্ব বাংলার ঘর আলো করে শুরু হতো টেলিভিশনের অনুষ্ঠান। পূর্ববাংলার সমাজ-রাজনীতির খবর টিভির মাধ্যমে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন তিনি। এমনকি রুপালি পর্দায় অভিনয় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা থেকে নানা রকম সহযোগিতায় ছিলেন অকৃপণ। কলকাতায় যে কয়টি বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হয়ে উঠেছিল, সেগুলোর মধ্যে বাঙালি ইহুদি কোহেনদের বাড়ি একটি। তাঁর নাড়ি, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি তাঁর বাড়ি ছিল রাজশাহীতে। ঢাকা তাঁর স্মৃতির শহর। আজীবন তিনি বাংলা ও বাংলাদেশকে লালন করেছেন, নিজেকে পরিচয় দিতেন বারেন্দ্র ইহুদি বলে।

মর্ডির সমাধিতে বাংলায় লেখা সমাধিলিপি

মর্ডির বাংলাপ্রেম ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর বাবা-মাও তাঁকে রাজশাহীর বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়েছেন। তাঁর স্ত্রী জো কোহেন লক্ষেèৗর ইহুদি কন্যা। বর্তমানে কলকাতার পার্ক লেনের বাসিন্দা জো বলছিলেন, ‘আমি ইংরেজি, হিন্দি আর উর্দু ভালো বলতে পারি। বাংলার মেয়ে নই তাই বাংলা ভাষা জানবো না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মর্ডি আমায় বাংলা বলতে শিখিয়েছিলেন। বাংলাতেই কথা বলতেন আমার সঙ্গে। খুব কম সময়ে ইংরেজি। ওঁর মুখে কখনো সেভাবে হিন্দি শুনিনি।’ শুধু তা-ই নয়, মিসেস কোহেনের মুখ থেকে শোনা গেল, মর্ডি পছন্দ করতেন সাধু ভাষায় লিখতে। যে বাংলা ভাষায় ফুটে ওঠে সাবেকিয়ানা, সেই বাংলায় লিখতে পছন্দ করতেন। জো বলছিলেন, সারা জীবন ঢাকা আর রাজশাহীর স্মৃতিকে নিয়েই বেঁচে ছিলেন মর্ডি। রাজশাহী আর ঢাকার বন্ধুদের কোনো দিন ভুলতে পারেননি। ভুলতে পারেননি নিজের দেশকে। কলকাতায় চলে আসার পরে নাকি তাঁর বন্ধুবৃত্ত ছোট হয়ে যায়। ঢাকায় থাকাকালীন খান আতাউর রহমানের ছবি সিরাজউদ্দৌলায় সিরাজের ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। কলকাতায় আসার পর পরিচয় হয় পরিচালক তপন সিংহর সঙ্গে। তাঁর ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবিতেও ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।

কলকাতায় ইহুদি কবরস্থান

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও লেখক মুহাম্মদ লুৎফুল হক খুব কাছ থেকে দেখেছেন মর্ডিকাই কোহেনকে। তিনি বলছিলেন, ‘খুব ছোটবেলায় ওঁকে দেখেছি। আমরা দেখতাম শহরের মধ্যে অত্যন্ত সুদর্শন একজন তরুণ। নায়কোচিত চরিত্র। যেন পদ্মাপারের রাজপুত্র। রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্রে ওঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। ১৬৩-৬৪ বছর আগে ওনারা রাজশাহীতে এসেছিলেন। অত্যন্ত সাংস্কৃতিক পরিবার। সবার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। ওঁদের সঙ্গে রাজশাহীর স্থানীয় মানুষদের ধর্মীয় কারণে কোনো রকম দূরত্ব ছিল না। আমাদের অঞ্চলে ওঁদের পরিবার ছিল খুবই গ্রহণযোগ্য আর জনপ্রিয়।’ জানা যায়, ১৭৯৮ সাল নাগাদ বাগদাদ থেকে বাংলায় আসেন ইহুদি ব্যবসায়ী শালোম কোহেন। মর্ডিকাই কোহেনের পিতৃপুরুষেরা বসবাস শুরু করেন রাজশাহীতে।
লুৎফুল হকের কথায়, ‘১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা টেলিভিশন শুরু হলে এর প্রথম ঘোষক ও সংবাদ পাঠক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মর্ডিকাই কোহেন। রাজশাহীতে থাকা অবস্থাতেই ঢাকার সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। যেহেতু তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন, বাংলা ও ইংরেজিতে দক্ষ; তাই তাঁকেই টেলিভিশনের ঘোষক ও সংবাদ পাঠকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ওনার বাবা রাজশাহীতেই থাকতেন। যুদ্ধের কারণে সামান্য টেনশন তৈরি হয়। ওদের রাজশাহীর বাড়িতে ঢিল ছোড়ার মতো ছোটখাটো উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেই সময় ওদের পরিবার রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে আসে। সম্ভবত সেই সময়েই ওঁরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

মর্ডির সমাধি

১৯৬৯ সালে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে যান। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা থেকেই নানাভাবে ওঁরা সহযোগিতা করেছেন। রাজশাহী আর ঢাকা মিলিয়ে মর্ডিকাই কোহেনের বন্ধুবলয় অত্যন্ত বড় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওঁদের কলকাতার বাড়িতে অনেকেরই আশ্রয় হয়েছে। ওঁদের বাড়ি ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওঁরা বাংলাদেশ ছেড়েছেন ১৯৬৮-৬৯ সালে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ ছিল। ১৯৭১-এর পর থেকে উনি হয়তো সব মিলিয়ে ৫-৬ বার বাংলাদেশে এসেছেন, কিন্তু যোগাযোগটা ছিল। রাজশাহী বা ঢাকা থেকে কোনো বন্ধু কলকাতায় গেলে ওনার বাসায় যেতেন। এমন যদি কোনো সুযোগ থাকতো এ দেশে ফিরে আসার, উনি আসতেন। ওনার স্মৃতিতে রাজশাহী ছিল চির উজ্জ্বল। একবার বিমানের সিঁড়িতে কোনো কারণে ব্যথা পেয়েছিলেন বলে ওনার চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। ২০১৪ সালে শেষবার বাংলাদেশে আসেন। টের পেয়েছিলেন বাংলাদেশ তাঁকে ভুলে যায়নি। উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল মর্ডি ভাইকে।’
কোহেন পরিবার ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। মুসলিম পরিবারের সঙ্গে তাদের বিয়ের ট্র্যাডিশনও রয়েছে। মর্ডিকাইয়ের সন্তানেরা এ মুহূর্তে ইসরায়েলে থাকেন। মৃত্যুর আগে মর্ডি সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, তা আর হয়ে ওঠেনি।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে উনি মারা যান ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আবেগ ধরা আছে কলকাতার ফুলবাগানে, সমাধিস্থলে। তাঁর ইচ্ছামতোই সমাধিফলকে পরিচিতি লেখা রয়েছে বাংলা ভাষায়। কলকাতার ইহুদি কবরস্থানে যা ব্যতিক্রম। শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাঙালি।

ছবি: লেখক ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top