skip to Main Content

স্মরণ I স্রষ্টার পারবদল

হলি গোলাইটলিকে মনে পড়ে? সেই যে ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ’ ছায়াছবিতে। ১৯৬১ সালে। এরই মধ্যে কত বছর কেটে গেল। ৫৭ বছর। ভাবা যায়। অথচ আজও সেই কালো ড্রেসে হলি রয়ে গেলেন সমান আকর্ষক। হার্টথ্রব। সিনিয়র সিটিজেনরা এটা পড়ে হয়তো একটু নস্টালজিক হবেন। আর হবেন নাই-বা কেন, এই পোশাকখানা যার শরীরে শোভিত হয়েছে, তিনি তো আর কেউ নন, ওই সময়ের হৃদয়ে দোলা লাগানো ধ্রুপদসুন্দরী অড্রে হেপবার্ন। সেই টিফানির সকালের নাশতার টেবিলে অড্রেকে দেখে তো চোখ ফেরানো দায়। আর যে কালো পোশাকখানার কথা বলা হচ্ছে, তার স্রষ্টাকে স্মরণ না করলেই নয়। আরেক রূপকথার নায়ক হিউবার্ট ডি জিভঁশি। ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ এক অভিজাত চিরতরুণ ফরাসি।
অড্রে সেই কবে, ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারি ছেড়েছেন পৃথিবীর মায়া। আর এই সেদিন ১২ মার্চ জীবনের রানওয়ে ছেড়ে চলে গেলেন অন্য পারের ব্যাকস্টেজে। অভিজাত পরিবারের সন্তান। কিন্তু ছকে বাঁধা জীবনে অভ্যস্ত হতে চাননি, বরং সৃষ্টির নেশায় মেতেছেন। ১০ বছর বয়সে আইডল ক্রিস্টোবাল ব্যালাসিঁয়াগাকে নিজের সৃজনকর্ম দেখানোর জন্য বাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে সফল হননি। তবে অভিভাবকদের অনেক করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফ্যাশন নিয়ে পড়ার অনুমতি আদায় করেন। কারণ, আইনজীবী হওয়ার খায়েশ তাঁর একরত্তিও ছিল না। ১৯৪৫ সালে, ১৭ বছর বয়সে, তাই ভর্তি হলেন ইকোল দেস বখ-আর্তস-এ। দুই বছর পর, পড়াশোনা তখনো শেষ হয়নি, এলসা শিয়াপারেল্লি তাঁকে ডেকে নেন বুটিক পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার জন্য। কিন্তু তাঁর মন তো পড়ে আছে ব্যালাসিঁয়াগায়। সেই তাঁর ঈশ্বর, সেই তাঁর ধর্ম। যাঁকে অনুসরণ করে নিজের প্রথম কালেকশন করেন ১৯৫২ সালে। পরের বছরের শেষ দিকে ঈশ্বরদর্শন হয় চর্মচক্ষে। সেই ১৯৫৩ সালের গোড়ার দিকে তরুণ ডিজাইনার জিভঁশির সঙ্গে আলাপ হয় অড্রের। তখন চলছে তাঁর সাবরিনা ছবির কাজ। জিভঁশির কাছ থেকে ধার নেন বেশ কিছু পোশাক। সেই শুরু বন্ধুত্বের। অমলিন ছিল টানা ৪০ বছর, অড্রের চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
অড্রের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম। ওই যে ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ-এ দুটো লিটল ব্ল্যাক ড্রেস করেছিলেন। এর আগে অবশ্য প্রাদার লিটল ব্ল্যাক ড্রেস বিশেষ খ্যাতি পায়। কিন্তু সব তর্কের ঊর্ধ্বে জিভঁশিরটাই সবিশেষ জনপ্রিয়। দুটো ড্রেসের একটা ছিল স্লিট দেয়া। হাঁটার সুবিধার জন্য। ওই পোশাকের পেছনের অংশটা বড়ই সুন্দর। পাশে অর্ধচন্দ্রাকার। এই লিটল ব্ল্যাক ড্রেসের পেছনের অংশটা বড়ই দৃষ্টিনন্দন। দু’পাশে দুটো অর্ধচন্দ্রাকার কাটওয়ে কাঁধ ও ঊর্ধ্ববাহুকে কেবল দৃষ্টিগোচর করেছে তা-ই নয়, বরং বাড়িয়েছে আকর্ষণ ও আবেদন।
যা হোক, দুটো অরিজিনাল ড্রেসের একটা আবার জিভঁশি দিয়েছিলেন ফরাসি লেখক দোমিনিক লাপিয়েরকে। কলকাতাকে নিয়ে লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘সিটি অব জয়’-এর লেখক। আনন্দনগরীতে তিনি একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। ওই পোশাক নিলাম করে সেই অর্থ লাপিয়ের ব্যয় করেছিলেন মানবকল্যাণে, কলকাতার চ্যারিটিতে। আর অন্যটি নিলামে তোলা হয় ২০০৬ সালে। দাম ওঠে ৪ লাখ ৬৭ হাজার পাউন্ড।
ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ-এর একটি পার্টির দৃশ্যে অড্রেকেই শাড়ির মতো ড্রেপ করে পরানো হয়েছিল একটি ড্রেস। সেটা যদিও শাড়ি ছিল না। ছিল বেডশিট। কিন্তু প্রেরণা শাড়ি। তাই বলা হয়ে থাকে, তিনিই প্রথম শাড়িকে হলিউডে নিয়ে যান। এরপর শাড়ির প্রেরণায় অনেক পোশাক করেছেন জিভঁশি। ১৯৮৬ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে পরা অড্রের পোশাকটিও সৃষ্টি হয়েছিল শাড়ির প্রেরণায়। তাঁরই একটা শাড়িপ্রাণিত পোশাক দেখে জ্যাকি কেনেডি রীতিমতো উদ্বেল। আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার ওলেগ ক্যাসিনিকে দিয়ে অমন একটা পোশাক বানিয়ে নিয়েছিলেন। যেটা তিনি পরেন ভারতের রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের সম্মানে দেয়া নৈশভোজাসরে।
অড্রে! অড্রে!! অড্রে!!! আর কি কেউ নেই? গ্রেস কেলি, লিজ টেলর, জ্যাকি কেনেডি, প্রিন্সেস গ্রেস অব মোনাকো, প্রিন্সেস অব উইন্সডর মায় ভুবনবিখ্যাত সুন্দরীদের তালিকা তো নেহাত ছোট নয়। সবাই তো ছুটেছেন এই জিভঁশির দরবারে। তাঁর পোশাক পরে ধন্য হতে। এই পুরুষের সৃষ্টি শরীরে শোভিত করে বর্তে যেতে। হয়েছেও তাই। কিন্তু বন্ধুত্বের গাঁটছড়াটা থেকে গেছে ওই অড্রের সঙ্গেই। তাঁর প্রেরণাতেই জিভঁশি প্রথম সৌরভ বাজারে আনেন: লা’ইন্তারদিত। তাঁর জীবনে অসংখ্য নায়িকা বা ডাকসাইটে সুন্দরীরা এলেও অড্রে ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম্!
তাই তো বন্ধুকে নিয়ে অড্রের অনায়াস কথন: জিভঁশির পোশাকে আমি নিজেকে ফিরে পাই। ও তো আসলে ফ্যাশন ডিজাইনার নয়, ব্যক্তিত্বের স্রষ্টা।
১৯২৭ সালে উত্তর প্যারিসের বভিয়াতে এক অভিজাত প্রটেস্টান্ট পরিবারে জন্ম তাঁর। পিতৃহারা মাত্র দুই বছর বয়সে। তবে দাদুর পোশাকের অনবদ্য সংগ্রহ বালক জিভঁশিকে মুগ্ধ করেছে। এ যেন বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে আনা মণিকাঞ্চন। আসলেও তাই। ছোট্ট জিভঁশি সেসব দেখার, ছুঁয়ে দেখার অনুমতি পেতেন কেবল স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলেই। এভাবেই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে পোশাকের প্রতি আকর্ষণ। পেয়ে বসে পোশাক নকশা ও সৃজনের নেশা। বাকিটা ইতিহাস। একসময় নিজের নামেই ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। যেটা তিনি বিক্রি করে দেন এলভিএমএইচ লাক্সারি গ্রুপের কাছে। ১৯৮৮ সালে। আর অবসরে চলে যান ১৯৯৫ সালে। তবে শেষবার রানওয়েতে জিভঁশি সর্বশেষ মডেলের হাত ধরে অভিবাদন নিয়েছেন ২০১৬ সালে। তারপর ক্রমেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। অন্তরালে থেকেছেন। অবসরের পর তিনি বলেছিলেন: আমি ফ্রক তৈরি হয়তো থামিয়ে দিয়েছি, তা বলে আবিষ্কারকে তো নয়। এক্সট্রিম এলিগ্যান্সের নায়ক হয়েও নিজেকে ভেবেছেন চিরকালের শিক্ষানবিশ। তাই তো আমৃত্যু ছিল উদ্ভাবনের অভিলাষ। দীর্ঘকায়, সুদর্শন জিভঁশির জীবনবোধ ছিল অসাধারণ। জীবনকে তাই বইয়ের সঙ্গে তুলনা করে একবার বলেছিলেন: জানতে হয় কখন পাতাটা ওল্টাতে হবে। ফ্যাশন বিশ্বের এই রাজপুত্র বিলক্ষণ সেটা জানতেন বলেই সঠিক সময়ে মুড়ে দিয়েছেন বইয়ের পাতা। আগামী প্রজন্মের জন্য তুলে রেখে তিনি হয়ে গেছেন অন্তরালের অতিথি।

 শেখ সাইফুর রহমান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top