গল্প I দৈদূনি
আমার আব্বু বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার। করোনার জন্য লকডাউন শুরু হওয়া মাত্র তিনি চলে গেলেন গেস্টরুমে। আগে আম্মুর ঘরে ছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের বাসায় নিয়ম বাড়তে থাকে, সঙ্গে কিছু নিয়ম উঠেও যায়। এই নিয়মের হিসাব রাখা কঠিন। তবে সুবিধা হলো, আব্বু সারাক্ষণই নিয়ম বলে দেওয়ার জন্য রেডি থাকেন। করোনার শুরুতেই আমাদের বাসার সোফা চেয়ারের মাঝে দূরত্ব বাড়ানো হলো, এদের চারদিকে দাগ দেওয়া হয়েছে। এই দাগের ভেতরে সবাইকে থাকতে হবে। এরপর শুরু হলো টাইমিং, নিজের ঘর থেকে কে কখন বের হতে পারবে, কখন বের হতে পারবে না। সাত ফুট লম্বা ডাইনিং টেবিলে দুজন দুই মাথায় বসে খাওয়া হচ্ছে। সেখানেও চার্ট আছে, কে কোন বেলা কার সঙ্গে খাবে। আব্বু, আম্মু, ভাইয়া, আর আমি- এই চারজনের যেকোনো দুজন পরপর দুবেলা একসঙ্গে খেতে পারবে না। রহিমা রান্নাঘরেই খাচ্ছে। ওকে নিয়ে সমস্যা নেই। টেবিলে দুজন খাওয়ার পর অন্তত আধঘণ্টা পর বাকি দুজন খেতে পারবে। রান্নাঘরের নিয়ম আরও মজার, রহিমা থাকলে আম্মু যেতে পারবে না, আম্মু গেলে…
শুরুতে ভালো ছিলাম। সমস্যা শুরু হলো মাঝামাঝিতে গিয়ে। কোনো ঘরে কেউ হাঁচি-কাশি দিলেই সেই রুম পরবর্তী আধা ঘণ্টার জন্য লকডাউন। তারপর স্প্রে করে আরও এক ঘণ্টা লকডাউন। এ জন্যই আব্বু দুটো বারান্দাকে কাশির জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা দিলেন। কিন্তু হাঁচির জন্য আগের লকডাউন নিয়ম। নানান বিধিনিষেধের ভেতর দিয়ে সবাইকে চলতে হচ্ছে। নিয়ম মানতে ভুলও হচ্ছে, একজন আরেকজনের বেশি কাছাকাছি চলে আসছি। কিন্তু আব্বু সঙ্গে সঙ্গে হাজির, তিনি নির্দিষ্ট একটি দৈহিক দূরত্বে (সামাজিক দূরত্ব শব্দটা কিছুতেই তিনি মানতে পারছেন না, তার কথায়Ñ আমরা সবাই সমাজেই আছি, তাহলে সামাজিক দূরত্ব হলো কী করে, এটা হলো একটা দেহের সঙ্গে অন্য একটা দেহের দূরত্ব) দাঁড়িয়ে তার জারি করা প্রতিটি নিয়ম বলে যাবেন এবং এর পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করবেন। সুবিধা হলো এগুলো করতে গিয়ে তিনি কখনোই মাথা গরম করেন না। আমার সবকিছুই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমাদের বাসায় সিনেমার শুটিং হচ্ছে, আব্বু ডিরেক্টর, আম্মু…
এর মধ্যেই বাসায় কঠিন অবস্থা শুরু হয়ে গেল। সকাল-বিকেল আব্বুর করোনা হতে শুরু করেছে। তিনি সারাক্ষণই করোনার কী কী নতুন উপসর্গ এসেছে ইন্টারনেটে দেখেন। একটা হাঁচি, একটা কাশি, কিংবা বুকে সামান্য কিছু হলেই তিনি মনে করছেন, তার করোনা হয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। কিন্তু করোনার টেস্ট করানোর বেলায় করবেন না, তার সহজ কথা, এর কোনো চিকিৎসা নেই, সুতরাং করোনা হয়েছে বা না হয়েছে, এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, দরকার শুধু সাবধানতা। কিছুদিন ভয়ে থাকলেও পরে আমরা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। যে রোগ সকাল-বিকেল একটা মানুষকে ধরছে, সেখানে চিন্তা করার সময় কোথায়! কিন্তু শেষে যখন আম্মুকে করোনা ধরল, তখন বাসায় পড়ে গেল কান্নার ধুম। আম্মু ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। ভেতরে কান্না, তিনি আর বাঁচবেন না। আব্বু আমাদের কাউকে সে ঘরে ঢুকতে দেবেন না। সব হচ্ছে মেসেঞ্জারে। কিন্তু সেই কঠিন সময়ও দুদিনের বেশি টিকল না। আম্মুর করোনার শুরু হয়েছিল গলায় ব্যথা দিয়ে, সেরে গেল পায়ে ব্যথা দিয়ে। মাঝখানে বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, হাঁটুতে…আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আব্বু লকডাউন কিছুটা শিথিল করলেন, সবার ঘরের দরজা খোলা থাকতে হবে। সমস্যায় পড়লেন ভাইয়া, রুমা আপার সঙ্গে তার প্রেম। রুমা আপা তার অফিসের কলিগ। ছয় মাস হলো আমাদের বিল্ডিংয়ে এসে উঠেছেন। আমার ধারণা, রুমা আপা ভাইয়ার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়। আম্মুর ধারণা আরও মারাত্মক। তার মতে রুমা আপার অন্য কোথাও বড় একটা ঝামেলা চলছে, ব্যাকআপ হিসেবে ভাইয়ার সঙ্গে চালিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু শেষে গিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে তার কিছুই হবে না, তখন ভাইয়া বুঝবে আসল অবস্থা। আগে ভাইয়া আর রুমা আপু ছাদে গিয়ে প্রেম করত। এখন প্রেম করে শুধু ফোনে, আমাদের ছাদও লকডাউনের আওতায় চলে গেছে।
ঈদের আগে আব্বু নিজেই বললেন, লকডাউন শিথিল করবেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি আমাদের জন্য স্পেশাল গিফট অর্ডার দিয়েছেন। আমরা শুনে খুব খুশি। নতুন একটা কিছু পাব। এত দিন সবাই ঘরে আটকে থেকে মানসিক অবস্থা ভালো নায়। ঈদে অনেক আনন্দ করতে হবে। তবে দৈহিক দূরত্ব অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আব্বুর ঘোষণার দুদিন পর আমাদের সবার জন্য এল হুলাহুপ দিয়ে বানানো দৈদূনি (দৈহিক দূরত্ব নির্ধারক), যেখানে আছে তিনটা করে শক্ত প্লাস্টিকের হুলাহুপ, একেকটির ব্যাস চার ফুট। পেটের সঙ্গে আটকানোর ব্যবস্থা আছে। পেটের চারদিকে ছড়িয়ে থাকবে, মোটামুটি বুক থেকে কোমর কভার করে, অনেকটাই চারা গাছের চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়ার মতো। আমরা পেয়ে খুব খুশি। ঈদের জন্য নতুন ড্রেস পেলাম না, পেলাম একটি দৈদূনি। ভালো লাগল, সবার জন্য একই রকমের দৈদূনি। কয়েকটা বেশি বানানো হয়েছে গেস্টের জন্য। এটা পরা থাকলে কোনোমতেই কেউ কারও চার ফুটের কাছাকাছি যেতে পারব না।
আব্বুর ধারণা, করোনার বিশ্বে এটা একটা বড় মার্কেট পেতে পারে। নিজের চারদিকে বেশ শক্তপোক্ত একটা ফ্রেম। চাইলে বাইরেও নিয়ে চলাফেরা করা যাবে, তখন কারোর গায়ের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগবে না, সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি দৈহিক দূরত্ব! আব্বু বলল, বাঁশ দিয়ে বানালে আরও ভালো হবে!
ঈদের আগেই দৈদূনি পরে আমাদের প্র্যাকটিস চলছে। আগের সব নিয়ম উঠে গেলেও দৈদূনির কারণে দৈহিক নিরাপদ দূরত্ব ঠিকঠাক মানা হচ্ছে। তবে কয়েকবার দরজায় আটকে গেলাম। একটু এদিক-ওদিক করে ছাড়াও পেলাম। কিন্তু রান্নাঘরের দরজা একটু চাপা বলে রহিমা আটকে গেল শক্ত করে। বেশ কষ্টকর একটা ব্যাপার হলো, তিন ফুটের মধ্যে না গিয়ে ওকে দরজা মুক্ত করতে আব্বু আর ভাইয়া দুজনেই গলদঘর্ম। সোফার কুশন দিয়ে নানানভাবে ঠেলা ধাক্কা করে ওকে মুক্ত করা গেল।
ঈদের দুই দিন আগে ঘরে বড় এক টুকরা বাঁশ এলো। আব্বু ব্যবস্থা করলেন। এই বাঁশ আব্বুর খুব প্রিয়। তিনি মনে করেন, এই বাঁশ দিয়েই দেশকে খাড়া করা সম্ভব, দেশ মানে দেশের অর্থনীতি। শুধু বাঁশ দিয়ে দশতলা বিল্ডিং বানানোর তার নিজেরই নাকি ডিজাইন আছে। সোফা, চেয়ার, টেবিল, খাট… সবই নাকি বাঁশ দিয়ে খুব সহজে এবং টেকসইভাবে বানানো যায়। যাহোক, দৈদূনিসহ রহিমা দরজায় আটকে গেলে সেই বাঁশ দিয়ে খুব সহজেই ওকে ছাড়ানো যাচ্ছে, আমার আব্বুর মাথায় সত্যি অনেক বুদ্ধি, তিনি বাঁশ নিয়ে হয়তো ঠিকই বলেছেন, শুধু বাঁশ দিয়েই দেশটা খাড়া…
ঈদের দিনে সত্যিকারের লকডাউন তুলে দেওয়া হলো। আমাদের বাইরের দরজা খোলা হলো। সকালে উঠেই আমরা রেডি হয়ে দৈদূনি পরে ঘরের মধ্যে হাঁটাচলা করছি। নাশতা খেলাম ওভাবেই। তারপর অপেক্ষা করছি আমাদের বাসায় কে আসে।
একটু পরেই এলেন রুমা আপু। আমি তাই আশা করছিলাম, ভাইয়া আর রুমা আপু এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। আব্বু আগেই গেস্টদের জন্য দরজায় দৈদূনি রেখেছেন, একজন গেস্ট আসবেন, দৈদূনি পরবেন, আমাদের সঙ্গে খাবেন, যাওয়ার পথে দৈদূনি খুলে চলে যাবেন। তারপর সেই দৈদূনি জীবাণুমুক্ত করা হবে…সব পরিকল্পনাই আব্বু ঠিক করে রেখেছেন। রুমা আপু দরজায় আসতেই আব্বু তাকে সালাম দিয়ে থামতে বললেন, তারপর নিজে পরে রুমা আপুকে দেখালেন কীভাবে দৈদূনি পরতে হয়। নিয়ম মেনে রুমা আপা দৈদূনি পরলেন, তার বয়স হলেও দৈদূনিতে তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। এবার আব্বু তাকে ভেতরে আসতে বললেন। এক পা বাড়াতেই রুমা আপু ধপাস করে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। দরজার হাতলে তার দৈদূনি আটকে গেছে। শব্দ শুনে ভাইয়া চলে এসেছে, ওদিকে আম্মুও চলে এসেছে। এর মধ্যেই আব্বুর হাতে বাঁশ চলে এসেছে। তিনি বাঁশটা দিয়ে ঠেলা দিয়ে রুমা আপুকে সোজা করার চেষ্টা করছেন। বেশ হট্টগোল চলছে। রান্নাঘর থেকে রহিমা বের হতে গিয়ে আবার দরজায় আটকে গেছে। কয়েকবার ডাকাডাকি করেই নিজেই জোরে ঠেলা দিয়ে বের হয়ে এল। শেষে সামলাতে না পেরে এসে পড়ল ভাইয়ার ওপর। ভাইয়ে উল্টে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল রুমা আপার দিকে। আব্বু তাড়াতাড়ি রুমা আপুর দিকে থেকে বাঁশটা টেনে বের করে ভাইয়াকে থামাল, তা না হলে ভাইয়া রুমা আপুর খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারত। সবকিছু ঠিকঠাক সামাল দেওয়া হলো বলে পেছনে তাকালাম। আর তখনি আম্মু পড়ে গেলেন ধপাস করে। মনে হয় এত কিছু দেখে তার মাথা ঘুরে গেছে! তিনি পড়েছেন চিত হয়ে! এই দেখে রহিমার চিৎকারÑ মায়ে গো মায়ে, বেবাগেই খালি পড়তাছে ক্যান, আইজকা না ঈদবার! ওদিকে আব্বুর হাতে একটাই বাঁশ, ঠেলা দিয়ে আটকে রেখেছেন ভাইয়াকে, আমার হাতে কিছু নেই, আম্মুর দিকে হাত না বাড়িয়ে ভাবছি, বাসায় আরও কয়েকটা বাঁশ থাকলে ভালো হতো, হয়তো আমিও ঠেলা দিয়ে আম্মুকে খাড়া…
❙ বিলেকাসা
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু