skip to Main Content

ফিচার I ক্যারেক্টার কারাগার

হরদম অভিনয়ে মেতে থাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কখনো কখনো তাদের অভিনীত চরিত্র থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেশ ভোগান্তিতে পড়ে যান

রূপান্তর। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে। নিজেকে সবাই যেভাবে চেনে, ঠিক তার বিপরীত অথবা চেনা মানুষের ছায়ায় হয়ে যেতে হয় অন্য কেউ। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয়শিল্পীদের এই কাজই করতে হয় প্রতিনিয়ত। জেনে নিতে হয় অভিনীত চরিত্রের শ্রেণি, ধর্ম-বর্ণ, স্বভাব, চলাফেরা, সমাজ-সংসারে ওঠা-বসা থেকে শুরু করে তার ভাবনাজগতের সবকিছু।

আরিফিন শুভ

এভাবে বললে বিষয়টা একটু জটিল মনে হতে পারে। সহজ কথায়, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য এক ‘আমি’কে তুলে ধরা এবং তা দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারাই অভিনয়। কাজটা চ্যালেঞ্জিং। আর চ্যালেঞ্জিং বলে নানা চরিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয় জগতে ভ্রমণ রোমাঞ্চকর। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে অনেকে চলে যান ঘোরের ভেতর। অভিনীত চরিত্র শরীরে-আত্মায় এমনভাবে মিশে যায়, সেখান থেকে মাঝে মাঝে বের আসাও কঠিন হয়ে পড়ে। তেমনই কয়েকটি চরিত্র নিয়ে কথা হলো কয়েকজন আলোচিত তারকার সঙ্গে। জানতে চাওয়া হলো, দীর্ঘদিন একটি চরিত্রের মাঝে নিজেকে ধরে রাখার পর সেখান থেকে তারা কীভাবে বেরিয়ে আসেন।

পরীমনি

আলাপ শুরু হয় মিসির আলি চরিত্র নিয়ে। ‘দেবী’ ছবিতে এই চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী। মিসির আলি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক কালজয়ী সৃষ্টি। পাঠকমাত্রই এই চরিত্র নানা অবয়বে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছেন। ‘দেবী’ ছবির আগে চরিত্রটির উপস্থিতি একটি নাটক ছাড়া আর কোথাও সেভাবে চোখে পড়েনি। তাই এই চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া, অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা ছিল কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। সে কথা স্বীকার করেই চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘মেকআপ দিয়ে চেহারা বদলানো খুব একটা কঠিন না। আমার বয়স ষাট না হলেও ওই বয়সী একজন মানুষে নিজেকে রূপান্তর করার সব রকম চেষ্টা ছিল। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের কালজয়ী চরিত্র মিসির আলি পাঠকের কল্পনার চোখে একেকভাবে ধরা দিয়েছে। তাই দর্শকের কাছে মিসির আলি রূপে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। সবার আগে নিজেকে বোঝাতে হয়েছে, আমিই মিসির আলি। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ভুলে যেতে হয়েছে আমার আমিকে। বিষয়টা এমন যে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করা, এটাই মিসির আলি তো, নাকি অন্য কেউ?’
‘এই যে নিজের কাছে চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা, “দেবী”র আগে ও পরে বহুবার করতে হয়েছে আমাকে। “আয়নাবাজি” সিনেমার আয়নাসহ একাধিক নাটক, টেলিছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের সময়ও নিজেকে বহুবার ভাঙতে হয়েছে। কিন্তু মিসির আলির ক্ষেত্রে সেটা আরও কঠিন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে যখন “দেবী” উপন্যাসটি পড়েছি, তখন আমার কল্পচোখেও মিসির আলি আলাদা চেহারায় ধরা দিয়েছিল। তাই পর্দার মিসির আলির চেহারা বা অবয়বটা কেমন হবে, তা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয়েছে। আবার এ-ও ভাবতে হয়েছে, ভক্তরা মিসির আলিকে যেভাবে দেখেন, কীভাবে সেটাই তুলে ধরা যায়। অভিনয় দিয়েই দর্শকের সঙ্গে এই সংযোগ তৈরি করতে হয়েছে,’ যোগ করেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা।

চঞ্চল চৌধুরী আরও বলেন, ‘যখন অভিনয় করি, চেষ্টা করি চরিত্রের সঙ্গে পুরোপুুরি মিশে যেতে। আর এটা করতে গিয়ে কখনো কখনো ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। সেই ঘোর থেকে বাস্তব জীবনে ফিরে আসার অভিজ্ঞতাও ছিল অন্য রকম। ঘুম থেকে উঠে নিজেকে নতুন একজন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করার মতোই ছিল বিষয়টা।’
আরিফিন শুভও একই রকম ঘোরের মধ্যে ছিলেন ‘মুজিব’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে। যদিও শুরুতে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এই বায়োপিকের নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু’; পরে ‘মুজিব’ রাখা হয়। যাহোক, এই ছবির অভিজ্ঞতা নিয়ে আরিফিন শুভ বলেন, ‘প্রায় এক বছর ধরে এই ছবির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকে শুরু করে অসংখ্য বইয়ের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হয়েছে আমাকে। কোনো কোনো লেখা পড়ে ভিজে উঠেছে চোখের পাতা। কখনো আবার একেবারে থমকে গেছি। যেমন একটা জায়গায়, শেখ রাসেল বলেছিল, “আব্বার বাড়ি যাব।” এই বাড়ি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ি নয়, এটা হচ্ছে জেল। বঙ্গবন্ধুকে এতবার জেলে যেতে হয়েছে যে, জেলকেই রাসেল তার বাড়ি বলে ধরে নিয়েছিল। বাবা জেলে থাকার কারণে যে ছেলে স্নেহবঞ্চিত হয়েছে, সেই ছোট ছেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মায়া-মমতা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করা সহজ নয়।’
শুভ আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা একজন মানুষ। কোনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট দিয়ে ওনাকে বানানো হয়নি। তিনি ছিলেন আপনার-আমার মতো রক্তমাংসের মানুষ। যে বিষয়গুলো আমাদের কষ্ট দেয়, যা কিছু করে আমরা খুশি হই, তার বেলায় এর ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। এরপরও এমন অনেক বিষয় আছে, যা শুধু বঙ্গবন্ধুর মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন অসহায় মানুষের সহায়। জনগণের কষ্ট তাকে ভীষণভাবে স্পর্শ করত। অন্যদিকে সত্যের পক্ষে লড়াই করতে প্রচণ্ড সাহসী ছিলেন। যে কারণেই মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়ার জন্য বীর বাঙালিকে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু ছিলেন একের মধ্যে অনেক। এমন একজন মানুষের অবয়বে পর্দায় নিজেকে তুলে ধরা আমার জন্য একদিকে যেমন সৌভাগ্যের, তেমনি চ্যালেঞ্জের। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল আমাকে বন্ধুর মতো সহযোগিতা করেছেন বলেই সেই চ্যালেঞ্জ আমি নিতে পেরেছি।’

চঞ্চল চৌধুরী

‘এই বায়োপিকে অভিনয় করতে গিয়ে দীর্ঘ একটা সময় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের মধ্যে আমি মিশে ছিলাম। সে সময়ে খেয়াল করেছি, আমাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের বদলে গেছে। আমি তো সেই আমিই ছিলাম, তারপরও কেন যেন অন্যদের চোখে আলাদাভাবে ধরা দিয়েছি। যেখানেই গেছি, আমার চরিত্র নিয়েই কথা হয়েছে। এ যেন অন্য মানুষে রূপান্তর। তাই অন্য সব চরিত্রে নতুন করে আত্মস্থ হওয়াও কিছুটা কঠিন মনে হয়েছে আমার জন্য। অভিনয়ের কারণে হলেও একজন মানুষ যখন একটি চরিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যায়, তখন সেই চরিত্র ছেড়ে বেরিয়ে আসা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। “মুজিব” ছবিতে কাজ করতে গিয়েই এই সত্যিটা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হয়েছে,’ বলেন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বশীল এই অভিনেতা।
শুধু চঞ্চল চৌধুরী কিংবা আরিফিন শুভই নন, অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। বরেণ্য অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, ‘“লাল সালু” ছবির মজিদ চরিত্রটি আমার জন্য ছিল পুরো বিপরীতধর্মী। তারপরও এই চরিত্রের প্রতি ভালো লাগা আছে এ কারণে যে, এর মাধ্যমে নিজেকে নতুনভাবে পর্দায় তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘“পদ্মা নদীর মাঝি” ছবিতে যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দেখানো হয়েছে, তাদের জীবন সম্পর্কে ধারণা নিতে পারলেও, চরিত্রে মিশে যাওয়া সহজ ছিল না। কুবের ও অন্য চরিত্রগুলো যাপিত জীবনের বাইরে অন্য এক জীবনের আস্বাদ এনে দিয়েছে আমাকে। তাই সিনেমার কাজ শেষ করার পরও কল্পনায় কুবের ও মজিদের চরিত্রে নিজেকে নিমজ্জিত রাখার বাসনা কাজ করেছে।’
এ সময়ের আলোচিত অভিনেত্রী পরীমনি তার প্রীতিলতা চরিত্রে অভিনয় নিয়ে ভালো লাগার কথা প্রকাশ করেছেন। এই চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ আন্দোলনের নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার হয়ে ওঠা সহজ ছিল না। বারবার মনে রাখতে হয়েছে, এ কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। তাই চাইলেই নিজের মতো করে চরিত্র উপস্থাপন করা যাবে না। কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভুলে থাকতে হবে, আমি কে? আর এটা করতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে ভাঙতে হয়েছে। আবার কাজ শেষে নিজ ভুবনে এই আমি যেমন, সেভাবে ফিরে আসাও ছিল ঘোর ভেঙে জেগে ওঠার মতো। এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রীতিলতা বলেই ভ্রম হয়।’
অভিনয়শিল্পীদের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট হয়, অভিনয়ের সূত্র ধরে নিজেকে বদলে পর্দায় তুলে ধরলেও তাদের ব্যক্তিজীবনে কিছু চরিত্রের আঁচ থেকেই যায়। কখনো কখনো তা অশরীরীর মতো চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। মনে করিয়ে দেয় নিজের রূপান্তরের কথা।

 ইলমা আজাদ
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top