skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I কিডনি কেয়ার

কিডনি বা বৃক্ক। শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। একটু গোলমাল করলে কিংবা বিকল হলেই সর্বনাশ। কেমন হওয়া চাই কিডনি রোগে আক্রান্তদের খাদ্যাভ্যাস? জানাচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

শারীরিক জটিলতাগুলোর মধ্যে আজকাল কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে এই সমস্যা বাড়ে বলে মনে করা হয়। আধুনিক এই সময়ে বিভিন্ন দেশের খাবার সহজলভ্য হওয়ায় অনেকে দেশীয় খাবারের ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে কাজের ধরনও; যেমন শারীরিক পরিশ্রমের বদলে ব্রেইনওয়ার্ক বাড়ছে। আর পরিশ্রম বলতে কেউ কেউ শুধু কয়েক দিন অনিয়মিত জিম করেই চাইছেন ফিট থাকতে। অথচ অনেক ক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হয়ে উঠছে। শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করছে বিভিন্ন অসুখ।
কিডনি সমস্যার হেতু
নানা কারণেই কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—
i দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে; ফলে কিডনির জটিলতা দেখা দেয়।
i অনেকেরই বারবার ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার সমস্যা থাকে; এ ধরনের সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে পরবর্তীকালে কিডনি সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
i নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান না করলেও আক্রান্ত হতে পারে কিডনি।
এককথায় বলা যায়, কিডনি হলো আমাদের দেহের ফিল্টার বা ছাঁকনি। দৈনন্দিন আমরা যা খাই, তা থেকে যে বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়, কিডনির মাধ্যমে ফিল্টার হয়ে আমাদের শরীর থেকে সেই টক্সিনগুলো বেরিয়ে যায়। তাই খাদ্যাভ্যাস সব সময় এমন হওয়া উচিত, যেন কিডনি স্বাভাবিক ফিল্ট্রেশন করতে পারে। চলুন, জানি কিডনি ভালো রাখার কিছু টিপস—
i শরীরের চাহিদা অনুযায়ী দৈনন্দিন পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন।
i অনেকেরই একবারে কয়েক গ্লাস পানি পান করার অভ্যাস রয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই কেউ কেউ এক লিটার পানি পান করেন। অথচ তা ঠিক নয়। মনে রাখা চাই, সবকিছুরই কাজ করার নির্দিষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করা হলে তাতে সমস্যা হতে পারে। তাই একবারে বেশি পানি পান না করে, বরং বারবার তা করার অভ্যাসই শ্রেয়।
i প্রস্রাব আটকে রাখা, কাজ শেষ করে প্রস্রাব করতে যাওয়া, অন্যদের সামনে টয়লেটে যেতে অস্বস্তি বোধ করা—এসব বদ-অভ্যাস ইউরিন ইনফেকশন তৈরির অন্যতম কারণ। ফলে পরবর্তীকালে কিডনি রোগ বাসা বাঁধার ঝুঁকি থাকে।
কিডনি রোগগুলোকে বলা যায় একদম সাইলেন্ট কিলার। অনেক সময় রোগী বুঝতেই পারেন না, তার শারীরিক কোনো সমস্যা কিংবা কিডনির জটিলতা তৈরি হচ্ছে। তাই সবারই উচিত বছরে অন্তত এক বা দুবার রক্ত পরীক্ষা করে নিজের কিডনির হাল-হকিকত জেনে নেওয়া। তা ছাড়া কিছু উপসর্গ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া চাই; যেমন—
i হঠাৎ করেই শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন হাত, পা বা মুখে ইডিমা অর্থাৎ পানি আসা;
i অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়া;
i প্রস্রাবে সাদা ফেনা জমা কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন যাওয়া;
i ক্ষুধা কমে যাওয়া কিংবা খাবার গ্রহণে অনীহা;
i বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ মাথাব্যথা হওয়া;
i স্কিন ডিজিজ বা শরীরের বিভিন্ন অংশে র‌্যাশ বা চুলকানি হওয়া প্রভৃতি।
পাতে সমাধান
কিডনি ভালো রাখতে যেসব খাবার খেতে পারেন, সেগুলোতে নজর বোলানো যাক—
i হলুদ: প্রাচীনকাল থেকেই হলুদের উপকারিতা অনেক। কোথাও কেটে গেলে বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো অসুস্থতায়ও সেই রাজা-বাদশাহর আমল থেকে হলুদ দারুণ একটি পথ্য। বর্তমানেও নানা ধরনের অসুস্থতায়, এমনকি দেহ থেকে টক্সিন বা বর্জ্য পদার্থ বের করতে হলুদ ব্যবহার করার সুফল পাওয়া গেছে। দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে কিডনি ভালো রাখতে সাহায্য করে এটি।
i রসুন: যেকোনো খাবার রান্নায় রসুনের ব্যবহার সাধারণত থাকেই। অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি গুণ থাকায় মেডিসিনাল ডায়েট হিসেবে রসুন সব সময়ই সেরা। এতে রয়েছে সেলেনিয়াম নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন দূর করতে সাহায্য করে। অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াল গ্রোথ বা অণুজীব থেকেও কিডনির সমস্যা দেখা দেয়, যার পথ্য হিসেবে রসুন খাওয়া যেতে পারে।
i ক্র্যানবেরি: ক্র্যানবেরি হলো এক জাতের ফল। আমাদের দেশে এই ফল এখনো উৎপাদিত হয় না; তবে প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবাদে অনেক খাদ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ক্র্যানবেরি জুস তৈরি করে, যা বাংলাদেশসহ নানা দেশে পাওয়া যায়। চেরি ফলের মতো দেখালেও ক্র্যানবেরির স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই ফলের জুস বেশ উপকারী। কারও ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন (ইউটিআই) বারবার হলে ভবিষ্যতে কিডনি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যাদের নিয়মিত প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা ইউরিন প্রদাহের সমস্যা রয়েছে, তারা প্রতিদিন ক্র্যানবেরি জুস পান করলে বেশ উপকার পাবেন। এটি মূত্রাশয় ব্যাকটেরিয়ার গ্রোথ কমায় এবং মূত্রাশয়ের প্রাচীরে থাকা ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে কোষগুলোর দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সতর্কতা সমাচার
কিডনি সুস্থ রাখতে হলে সব সময় খাদ্যাভ্যাস ভালো রাখার চেষ্টা চালানো জরুরি। তবে যাদের ক্ষেত্রে কিডনির সমস্যা হয়েই যায়, কিছু খাবারে তারা নিষেধাজ্ঞা না মানলে ভয়ানক বিপদে পড়তে পারেন। পরিণামে কিডনি ফেইলিওর, এমনকি ডায়ালাইসিস করানোর প্রয়োজনও হতে পারে। তাই রক্তের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বাড়তি হলেই নেওয়া চাই বাড়তি সতর্কতা। সে ক্ষেত্রে মেডিকেশনের পাশাপাশি লাইফস্টাইল ও ডায়েট মডিফিকেশন অত্যন্ত জরুরি।
কী খাবেন আর কী খাবেন না—এই নিয়ে কিডনি রোগীরা প্রায়ই দুশ্চিন্তায় ভোগেন। আসলে কিডনির কতগুলো স্টেজ রয়েছে, যার মাত্রা বা ক্রিয়েটিনিন লেভেলের ওপর নির্ভর করে রোগীর খাবার গ্রহণের নিষেধাজ্ঞা ঠিক করে থাকেন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদ। কোনো কোনো রোগী না বুঝেই নিজে থেকে সব ধরনের প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দেন, যা ঠিক নয়। কেননা, এর ফলে ধীরে ধীরে তার শরীরে রক্তস্বল্পতা, ইলেকট্রোলাইটস ইমব্যালেন্স, এমনকি ওজন কমে শারীরিক দুর্বলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তবে কিডনি সমস্যা নিয়ন্ত্রণে কিছু খাবার অবশ্যই বর্জন করা প্রয়োজন; যেমন—
i অতিরিক্ত লবণ: যেকোনো কিছুই মাত্রার অধিক গ্রহণ করা হলে তা শারীরিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর সেটি যদি লবণ হয়, তাহলে তা অবশ্যই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যদি কিডনির সমস্যা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।
i ডাল: ডাল ও ডালের তৈরি খাবারগুলো কিডনি রোগীদের সমস্যা বাড়াতে পারে। এজাতীয় খাবার বন্ধ রাখলে রক্তের রিপোর্ট কিছুটা ভালো পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
i ফল: সব ধরনের ফলই যে কিডনি রোগীর জন্য নিষেধ, তা নয়। তবে যাদের প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ফল খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে, তাদের রক্তে ইলেকট্রোলাইটস বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই কোন ধরনের ফল আপনি গ্রহণ করতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ অনুসরণ করা চাই।
কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট খাবার বন্ধ করা বা রিকমেন্ডেশন দেওয়া বেশ কঠিন। যেহেতু রক্তের রিপোর্টগুলো বারবার পরিবর্তন হয়, তাই অন্তত তিন মাস পরপর একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হওয়া শ্রেয়।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top