skip to Main Content

টেকসহি I পানি? পানি!

২২ মার্চ। ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডে। ‘পানি নিয়ে ভাবনা, আর না … আর না …’ বলে তৃপ্তির বিজ্ঞাপনীয় ঢেঁকুর তোলার সময় নেই; বাস্তব চিত্র আঁতকে ওঠার মতো

যথাযথ স্যানিটেশনের অভাব এবং দূষিত পানিসংক্রান্ত রোগের কারণে বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন শিশুর মৃত্যু হয়, বলছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার অর্গ। একই কারণে বছরে এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়; আয়ুষ্কাল কমে আসে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের, বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, একদিকে যেমন সুপেয় পানির অভাব, অন্যদিকে বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা আরও ৫৫ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যতই দিন যাচ্ছে, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় এই উপাদানের পরিমাণও কমছে। বিশুদ্ধ পানির গুরুত্ব, পানির উৎসের ব্যবস্থাপনা ও পানীয় জলের সংকট মোকাবিলা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে ১৯৯৩ সাল থেকে ইউএন-ওয়াটারের সঙ্গে একত্র হয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডে’ বা বিশ্ব পানি দিবস পালন করে আসছে জাতিসংঘ। প্রতিবছরের ২২ মার্চ পালিত এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্বাচিত হয় পরিষ্কার সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে।
ওয়াটার অর্গের সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী ৭৭১ মিলিয়ন মানুষ সুপেয় পানির অভাবে ভুগছেন; ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মানুষ যথাযথ স্যানিটেশন ব্যবস্থাটুকুও পান না। এমনকি যেসব অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি কুয়া কিংবা অন্যান্য সেকেলে মাধ্যমে উত্তোলন করতে হয়, সেসব দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি আঘাত হানছে পানীয় জলের সংকট। সুপেয় পানি এবং সুষ্ঠু স্যানিটেশনের অভাবে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৬০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। পানির সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় লেবানন, সুদান, ইরাকের পাশাপাশি রয়েছে আমাদের পার্শ্ববর্তী পাকিস্তান, আফগানিস্তানও। কিছুদিন আগে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়াতেও সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন লাখো মানুষ। প্রতিকার কী।
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে পানি সংকট মোকাবিলায় প্রতিবছরই নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর নেপথ্য কারণগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পানি দিবসের সার্থকতা অর্জন করা সম্ভব নয়। পানিসংকটের অন্যতম প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বন উজাড় ও কার্বন নিঃসরণ। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ভূপৃষ্ঠের পানির উৎসগুলোতে। উদাহরণস্বরূপ সাব-সাহারান আফ্রিকার কথা ধরা যাক। জলবায়ু প্ররোচিত খরার কারণে এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশ বাড়তে থাকাও ভবিষ্যতে একটি বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের এই ক্রমবর্ধমান উচ্চতার কারণে মূলত মিঠাপানির উৎসগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়ছে; এতে কমে আসছে পানযোগ্য পানির উৎস। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, তা জানা না গেলেও ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রায় ৭৫ শতাংশই ছিল পানিসংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে প্রধান দুটি দুর্যোগ—বন্যা ও খরা। একদিকে যেমন খরার কারণে মানুষ পানি থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে বন্যার কারণে পরিষ্কার মিঠাপানির উৎসগুলোও দূষিত হয়ে যায়। এতে ছড়ায় ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগ।
পানিসংকটের পেছনে সুষ্ঠু বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকারও হাত রয়েছে। ধরা যাক, কোনো এক এলাকায় দৃশ্যত পানির কোনো অভাব নেই। তবে সেই পানি আসলেই ব্যবহার্য কিংবা পানের উপযোগী কি না, তা যাচাই করা জরুরি। গৃহস্থালি থেকে নির্গত যে দূষিত পানি, সেটি কোথায় যায়, তা ভেবে দেখেছেন? জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালির বর্জ্যে দূষিত পানির ৪৪ শতাংশ শোধন না করেই পুনরায় ব্যবহার করা হয় এবং ৮০ শতাংশ বর্জ্য শোধন বা পুনর্ব্যবহার না করার আগেই তা ইকোসিস্টেমে ফিরে আসে। জাতিসংঘের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, প্রাণীর মলের মাধ্যমে দূষিত পানি ব্যবহার করা মানুষের সংখ্যা ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন! কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, পোলিওসহ বিশ্বের বিভিন্ন গুরুতর রোগবালাই হয়ে থাকে এই দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে। একদিকে যেমন বিশুদ্ধ পানি মেলা দায়, অন্যদিকে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে অনেকেই পানি অপচয় করে চলেছি। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য যোগ করলে দেখা যায়, বার্ষিক পানি অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৯০০ বিলিয়ন গ্যালন!
প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট প্রভাবকগুলো থেকে বেরিয়ে এসে এবার দেখা যাক, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন পানির সংকট মোকাবিলায় কী ভূমিকা রাখছে। ইউএন-ওয়াটারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে ৩০০ কোটির বেশি মানুষের ব্যবহার্য পানির বিষয়ে প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য নেই। তার মানে, তারা দূষিত পানি ব্যবহারের ঝুঁকিতে রয়েছেন বেশি। তা ছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, একটি বৃহদাকৃতির জলাশয় ঘিরে দুটি বা তিনটি দেশ অবস্থিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব জলাশয় থেকে পানি উত্তোলন করে তা চারপাশের দেশগুলোতে ব্যবহার করা হয় না। শেয়ারড ওয়াটার সোর্স অর্থাৎ পানি ভাগাভাগি করে নেওয়ার জটিলতার কারণে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও তেমন নেই। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সর্বশেষ আপডেট অনুসারে, সীমান্তবর্তী নদী, হ্রদ ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎসগুলো এ ধরনের বণ্টনব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে—এখন পর্যন্ত তা রিপোর্ট করেছে মাত্র ২৪টি দেশ। পানিসংকটের আরেকটি বড় কারণ অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনার অভাব। বিশ্বের অনেক দেশই নিজেদের পানিসম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না শুধু প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাবে।
পানিসংকটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারীদের। বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষকে দুর্গম উৎস থেকে পানি উত্তোলন করতে হয়। এসব কাজ সাধারণত নারীরাই করে থাকেন। ওয়াটার অর্গের তথ্যানুসারে, সারা বিশ্বের নারী ও শিশুরা পানি সংগ্রহের পেছনে সম্মিলিতভাবে দৈনিক ২০ কোটি ঘণ্টা সময় ব্যয় করে থাকে! এমনকি স্বাভাবিক পয়োনিষ্কাশনের সুযোগ না থাকায় এসব অঞ্চলের নারীরা ভুগে থাকেন স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা জটিলতায়। এসব অঞ্চলে পানি সংগ্রহ করাই নারীদের প্রধান কাজ হওয়ায় তারা অন্য কোনো কাজ কিংবা পড়াশোনা করার সুযোগ বলতে গেলে পানই না। স্বভাবতই জীবনে এগিয়ে যাওয়ার মতো কোনো পথ খোলা থাকে না তাদের। পানির অভাবে নিশ্চিত মৃত্যু তো আছেই, পাশাপাশি দূষিত পানি ব্যবহারের কারণেও প্রাণ যায় অনেকের। তা ছাড়া গর্ভাবস্থায় নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ পানির সহজলভ্য থাকা জরুরি। কিন্তু এই নিরাপদ পানির জন্য যদি সেই নারীকেই পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল হেঁটে পাড়ি দিতে হয়, ভারী পাত্র বহন করতে হয়, তাহলে আদতে সেটি তার জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক।
দিন যত যাচ্ছে, বাড়ছে পানিসংকটও। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো আমরা ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে দেখতে পাচ্ছি। বন্যা, খরা, দাবানল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার মতো বিধ্বংসী দুর্যোগগুলোর ফলে পানির মতো আমাদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার উপাদানও নিঃশেষ হয়ে আসছে। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অ্যাক্সেলারেটিং চেঞ্জ’ বা পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করা। পানিসংকট মোকাবিলায় দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প বাস্তবিকভাবেই আর নেই।

 সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top