skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I অন্য বরিষণ

অতিবর্ষণ বা নেতিবাচকতা বাদ দিলে, বৃষ্টি আক্ষরিক ও রূপক—উভয় অর্থেই প্রকৃতি তথা মানুষের জন্য কল্যাণকর। আর মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে শাশ্বত মানবতাবোধে তাড়িত হয়ে যদি অন্যের কল্যাণে হোক ব্যাপক কিংবা ন্যূনতম—যথাসম্ভব অবদান রাখতে পারি, তাতে মানবজীবনের সার্থকতা

‘চল্লিশটি বর্ষার সজল স্পর্শ তোমাকে আকুল/ করে আজো, আজো দেখি তুমি জানালার কাছ ঘেঁষে/ বাইরে তাকিয়ে আষাঢ়ের জলধারা দ্যাখো খুব/ মুগ্ধাবেশে; মনে হয়, আষাঢ় তোমার মন আর/ হৃদয় শ্রাবণ। তুমি এই তো সেদিন ঘন কালো/ মেঘদল দেখে, শুনে বৃষ্টির জলতরঙ্গ বললে/ নিবিড় মেদুর স্বরে, “এ বৃষ্টি আমার, এই বর্ষা/ আমাকে সস্নেহে তার দীর্ঘ আঙুলে ছুঁয়ে যায়।”/ এখন দেখছি আমি কবেকার তোমার আঠারো/ বছরকে চুমো খাচ্ছে আনন্দে নিভৃতে খোলা ছাদে/ কাঁচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি। বাদল দিনের ফুল/ কদমের বুনো ঘ্রাণে শিহরিত তুমি ক্ষণে ক্ষণে…’ বৃষ্টির বন্দনারত কবি শামসুর রাহমানের কবিতার এই ‘তুমি’ সর্বজনীন। একে কোনো নির্দিষ্ট মানব-মানবী কিংবা একান্ত প্রিয়জন রূপে কল্পনায় জায়গা দেওয়া যেমন সম্ভব, তেমনি সমগ্র মানবসভ্যতার কাঠামোতেও ভেবে নেওয়া যায়। প্রকৃতির এক অতুল উপহার হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে বৃষ্টি। আর তা মুহূর্তেই শুধু আদিগন্ত ফসলের মাঠ, লোকালয়, পথঘাট, অর্থাৎ বাহ্যিক চরাচরই নয়; মানুষের অন্তস্তলের একান্ত সত্তাকে করে দেয় সিক্ত। জোগায় খরা ও ঝরা পেরিয়ে আবারও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার প্রেরণা। বৃষ্টিমুখর দিন এভাবে আমাদের ভেতরে ঘটায় প্রাণস্পৃহার নীরব নবায়ন।
দুই
বৃষ্টি বরাবরই কাব্যিক মহিমা ছড়ায়, বিশেষত যারা রয়েছেন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত, তাদের জীবনে। আছে এর আরেক প্রভাবও। জীবনযাত্রা যাদের মসৃণ নয় মোটেই, পায়ে পায়ে যাদের অবিরাম লড়াইয়ের হাজিরা, তাদের কাছে বৃষ্টি এক সাক্ষাৎ অভিশাপ হয়ে ধরা দেয়। আকাশে মেঘ দেখলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাদের মনোজগতে। কেননা, বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যায় তাদের টিকে থাকার খড়কুটোগুলোর অনেকখানি। অথচ এর দায় মোটেই বৃষ্টির নয়। এ অনেকটাই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। বহুকাল ধরে পৃথিবীর বুকে মানুষের বিচরণ; তবু এত দিনেও মানুষে মানুষে ব্যবধান ঘোচেনি, বরং কালে কালে একেকভাবে রয়ে গেছে অব্যাহত। বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিষয়ে মানুষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও, সমাজে মানবজাতির জীবনযাত্রায় তা নিশ্চিতভাবেই রয়েছে। সম্পদের সুষম বণ্টন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবিক বোধে তাড়িত হয়ে অবদান রাখা গেলে, আজ যারা সুবিধাবঞ্চিত হয়ে বৃষ্টিকে অভিশাপ ভাবছেন, আগামীকাল হয়তো তারা আমার-আপনার, অর্থাৎ সুবিধাপ্রাপ্তদের মতোই তা করতে পারবেন উপভোগ। এ জন্য চাই চিন্তা ও চেতনায় যথাযোগ্য পরিমার্জন।

তিন
মানুষ ভীষণ সংবেদনশীল ও আবেগতাড়িত। ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে পড়ে; ক্ষণে ক্ষণে দুর্মর! যখন দুঃসময় হানা দেয়, বিরল ব্যতিক্রম বাদে, বেশির ভাগ মানুষই খড়কুটো হলেও আঁকড়ে ধরে পাড়ি দিতে চায় তা। অন্তস্তলের ভীষণ খরায় মনোজগতের সকল তল্লাট ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার দিনে চাতক পাখির মতো সে অপেক্ষায় থাকে একফোঁটা বৃষ্টির; তা রূপক অর্থেই। সেই কাঙ্ক্ষিত ও প্রয়োজনীয় বৃষ্টির ফোঁটা এনে দিতে পারে সাধারণত অন্য কোনো মানুষ। কে জানে, কে! হয়তো আমি, আপনিই। কবি কামিনী রায় যেমন লিখেছেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী ’পরে,/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’। এমন গভীর জীবনবোধী মনোভাব নিয়ে আমরা যদি চারপাশে তাকাই, হয়তো দেখতে পাব, খুব চেনা-জানা কেউ ধুঁকছে প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য ভোগান্তিতে। অনেক সময় বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না তাকে সারিয়ে তুলতে। একটুখানি পাশে থাকা, হাত ধরা, জীবনের ইতিবাচক স্পৃহা ভাগাভাগি করে নেওয়া তাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে নতুন করে। ঠিক যেভাবে রুক্ষ প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের জাগরণ এনে দেয় বরিষণ।
চার
অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়—খুব জানা কথা। বিপন্ন বা বিপদগ্রস্ত কারও পাশে দাঁড়ানোর সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখা শ্রেয়। অতিবর্ষণ যেমন বন্যা, ভূমিধসসহ বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডেকে এনে জনজীবন করে তোলে দুর্বিষহ; তেমনি কারও পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তার ব্যক্তিত্বের হানি ঘটানোও কাম্য নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে আমরা হরদম এমন ধরনের ভূরি ভূরি উদাহরণ ভেসে উঠতে দেখি অন্তর্জালে। কাউকে সাহায্য করার ছবি বা ভিডিও ফলাও করে প্রচার করা, এর বিনিময়ে মুহূর্তেই অসংখ্য লাইক-কমেন্ট বা বাহবা কুড়ানো, কিংবা এগুলোর আড়ালে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করা একই সঙ্গে বিশ্রী ও নিষ্ঠুর ব্যাপার। কেননা, একজন মানুষের বর্তমান অবস্থান যা-ই হোক না কেন, প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব ও গোপনীয়তা রক্ষার রয়েছে অধিকার। বিপন্ন ও ভঙ্গুর মানুষকে সাহায্যের নামে সস্তারূপে ফুটিয়ে তোলা যেকোনো বিবেচনাতেই অমর্যাদাকর; বরং প্রকৃত সাহায্যকারী নিজেকে ও নিজ অবদানকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন।

পাঁচ
অতিবর্ষণ বা নেতিবাচকতা বাদ দিলে, বৃষ্টি আক্ষরিক ও রূপক—উভয় অর্থেই প্রকৃতি তথা মানুষের জন্য কল্যাণকর। আর মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে শাশ্বত মানবতাবোধে তাড়িত হয়ে যদি অন্যের কল্যাণে হোক ব্যাপক কিংবা ন্যূনতম—যথাসম্ভব অবদান রাখতে পারি, তাতে মানবজীবনের সার্থকতা। এই চর্চা শুধু একা একা নয়, বরং এর রেশ আশপাশের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে পৃথিবীর বুকে আমাদের যাপিত জীবন থেকে অনেক কাদা বা ক্লেদ ধুয়েমুছে যাবে তুমুল বর্ষণে। ঘন বর্ষাকালের এই দিনগুলোতে, ধ্রুব এষের লেখা কনক আদিত্যের সেই গান গুনগুন করে এমন ইতিবাচক জীবনবোধকে ঝালিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না: ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে/ বসিয়া থাকো/ একটু বসিয়া থাকো/ আমি মেঘের দলে আছি/ ঘাসের দলে আছি/ তুমিও থাকো বন্ধু হে/ একটু বসিয়া থাকো…’।

ইতিবাচক ও পরিমিত বৃষ্টিমুখরতায় জীবন প্রাণবন্ত হোক সবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top