ছুটিরঘণ্টা I ইথিওপিয়ায় আদিবাসী গ্রামে
কথিত সভ্যতার আলো সেখানে এখনো পৌঁছায়নি ঠিকঠাক। তবু মনুষ্যত্বের চিরন্তন সভ্যতার আলোয় তারা আলোকিত যুগ-যুগান্তর ধরে। যেখানে তাদের বসবাস, আফ্রিকা মহাদেশের এমন এক দুর্গম আদিবাসী গ্রাম ভ্রমণের গল্প শোনাচ্ছেন ফাতিমা জাহান
গ্রামের নাম তুরমি। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। দক্ষিণ ইথিওপিয়ায় এখন বর্ষাকাল। ঘন বরিষণের মাস। এ সময় আমি এসেছি প্রত্যন্ত গ্রামে। বর্ষা তো বটেই, আদিবাসীদের জীবনযাপন দেখতেও।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ বৃষ্টি থামার নাম নেই। অদ্ভুত এক অঞ্চল ওমো ভ্যালি। এখানে নাকি বছরে দুবার বর্ষাকাল আসে—একবার জুনে, আরেকবার অক্টোবরে। আমি বর্ষা দেখছি দুচোখ ভরে।
যে রিসোর্টে উঠেছি, সেটি বোধ হয় বনভূমির মাঝেই বানানো। বড় বড় গাছপালার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ একেকটি কটেজ দেখা যায়। বিশাল জায়গাজুড়ে এই রিসোর্টে এখন আমি একটি কটেজে আছি আর আরেকটা কটেজে উঠেছিল ইউরোপ থেকে আসা এক যুগল। সেই যুগল আজ চলে গেছে। বিশাল এই রিসোর্টে এখন আমিই একমাত্র অতিথি। অবশ্য রিসোর্টে কম করে হলেও কুড়িজন কর্মী আছেন। আমার কটেজের পাশে কয়েকটি রাধাচূড়া, বাগানবিলাস আর নানা পাতাবাহারের গাছ সাজানো। এদের ঘিরে আছে বড় বড় আকাশিয়া, কৃষ্ণচূড়া, অ্যাডেনিয়াম গাছ। আমাদের দেশে অ্যাডেনিয়াম গাছ আমরা টবে লাগাই। বছরে দু-একটা ফুল ফোটে, আর তাতেই আমরা বেজায় খুশি হয়ে যাই। অথচ এখানে অ্যাডেনিয়াম এক বিশাল বনভূমির নাম। জঙ্গলের মতো উঁচু উঁচু গাছে বাগান আলো করে ফুটে আছে হাজার হাজার অ্যাডেনিয়াম ফুল। ফুলে ফুলে চারদিক গোলাপি হয়ে গেছে। এমন দৃশ্য আফ্রিকায় দেখতে পাব, কখনো ভাবিনি।
ওমো ভ্যালির এ দিক বেশ শুষ্ক। কাঁটাঝোপ গাছই বেশি। মাটিতে লাল বালির আধিক্য। দেখলে মনে হবে মরুভূমি অঞ্চল। অথচ ঠিকই বৃষ্টি পড়ছে, ফুল ফুটছে। আমার কটেজের সামনে এখন প্রতিটি গাছে ফুল ফুটেছে। লাল, কমলা, গোলাপি রং ভিজে ভিজে যাচ্ছে বরষায়। এমন ঘোর ঘন বরষায় বাইরে ঘোরার মানেই হয় না! কফির পেয়ালা হাতে কটেজের বারান্দায় বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।
কটেজটিও সাজানো হয়েছে কাঠের দোচালা ঘরের আদলে, যার ছাদ ছনের মতো পাতায় ঢাকা। গত রাতে বৃষ্টির সময় পাখিরা ঘর ভেবে এই ছনের ভেতরে আশ্রয় নিতে গিয়ে কিচিরমিচির করে কী যে এক কাণ্ড করেছিল! এখন এই দুপুরে বৃষ্টির জন্য কাছের হামার আদিবাসীদের গ্রামে যেতে দেরি হচ্ছে।
আমি আফ্রিকায় এসেছি কয়েকবার। এবার লম্বা সময় ধরে মহাদেশটি ঘুরে বেড়ানোর মনস্থ করেছি। আফ্রিকা বাকি দুনিয়ার কাছে এক শ্বাপদসংকুল অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। অথচ এই মহাদেশ যে কত বৈচিত্র্যময় আর আধুনিক, তা না এলে জানতাম না। এমনকি এক ইথিওপিয়ায় যে এত ধরনের আদিবাসীর বসবাস, জানা ছিল না আমার। রাজধানী আদ্দিস আবাবাকে দেখলে আধুনিক শহর বলেই মনে হবে। তবে ওমো ভ্যালি বিখ্যাত এর বিভিন্ন আদিবাসীর জন্য। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এখনো আদিবাসীদের মধ্যে তাদের হাজার বছর আগের জীবনযাপন প্রচলিত। ওমো ভ্যালির আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে তথাকথিত সভ্যতা এসে পৌঁছায়নি। আধুনিক জীবনের যেকোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে এরা বঞ্চিত। পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। জমিতে শস্য ফলে খুব অল্প। এদের প্রধান খাদ্য সোরগাম নামের এক শস্যের পরেজ; সঙ্গে শাকপাতা সেদ্ধ। এসব গ্রামে স্কুল, হাসপাতাল নেই। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এরা টাকা চেনেন না। এখানে টাকাবিষয়ক কোনো লেনদেন হয় না বললেই চলে। এরা পশুর বিনিময়ে সোরগাম কিনে নেন।
হামার জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ—কেউই ঊর্ধ্বাঙ্গে বস্ত্র পরেন না। নিম্নাঙ্গে একখণ্ড বস্ত্র পেঁচিয়ে রাখেন। এই জনগোষ্ঠীর জন্য এমনটা খুবই স্বাভাবিক। আমার এদেরকে কথিত অসভ্য মনে হয়নি। কারণ, এই জনগোষ্ঠীর মাঝে কেউ কোনো অপরাধে জড়ান না। নারীরা কখনোই হেনস্তার শিকার হন না কিংবা পশুর মালিকানা নিয়ে কারও সঙ্গে কারও বিরোধ ঘটে না। সবার নিজের পশু আছে এবং অন্যের পশু ছিনিয়ে নিতে কিংবা লুট করতে কেউ হানাহানিতে জড়ান না। এসব কীভাবে করতে হয়, বোধ হয় এরা জানেনও না।
গতকাল একটি হামার গ্রামে গিয়েছিলাম। আজ যাব আরেকটি গ্রামে। বিবাহ এ জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। বিবাহের সময় পণ হিসেবে গরু, ছাগল পাত্রীর বাবাকে দেন পাত্র। যে যত বেশি পণ দিতে পারবেন, তিনি তত উপযুক্ত পাত্রী পাবেন। মেয়েরা বিয়ের পর আলাদা একধরনের কেশসজ্জা করেন। চুলগুলো কাঁধ সমান ছেঁটে, ছোট ছোট বিনুনি করে, তাতে মাখন আর এই অঞ্চলের লাল মাটি মিশিয়ে নেন। দূর থেকে দেখলে খুব স্টাইলিশ মনে হয়। আর যেকোনো বয়সের নারীরা রংবেরঙের পুঁতির মোটা মোটা মালা গলায় পরেন। বিয়ের পর মাটি দিয়ে তৈরি একধরনের মোটা নেকলেস পরেন তারা। তবে এদের গলার মালা আর হাতের মোটা প্যাঁচানো চুড়ির মতো ব্রেসলেট দেখলে যেকোনো জুয়েলারি ডিজাইনার তা লুফে নিয়ে, সেই ডিজাইন নকল করে সেলিব্রিটিদের কাছে বিক্রি করবেন চড়া মূল্যে!
মাতৃতান্ত্রিক পরিবার না হলেও নারীরা পশুপালন বাদে বাকি সব কাজই করেন। যেমন রান্না করা, সন্তান লালন-পালন, দূরের নদী থেকে পানি বয়ে আনা, ঘর বানানো ইত্যাদি। আমার কাছে পুরুষদেরকে ঘরের মেহমান বলেই মনে হলো।
প্রতি গ্রামে একজন গ্রামপ্রধান থাকেন। গ্রামের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তারই। তার হাতে অল্পবিস্তর টাকাপয়সা থাকে। এই যেমন কোনো ট্যুরিস্ট এলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বির বা ইথিওপিয়ান টাকা নজরানা দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করতে হয়। এই বির গ্রামপ্রধানের কাছে জমা থাকে। পরে বেশ কিছু বির জমলে এরা সেটি দিয়ে কাছের বাজার থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য বা ওষুধ কিনে আনেন। অবশ্য সবচেয়ে কাছের বাজারের দূরত্ব গ্রাম থেকে কম করে হলেও ত্রিশ কিলোমিটার।
বৃষ্টি একটু ধরে আসতে আসতে আমি দুই কাপ ইথিওপিয়ান কফি পান করে ফেলেছি! রিসোর্টের প্রায় সবার সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেছে। ইথিওপিয়ায় একমাত্র আদ্দিস আবাবা ছাড়া অন্যান্য জায়গায় গাইড ছাড়া একা বের হওয়া নিষেধ। বৃষ্টি কমতেই আমার গাইড মেলাক এসে আমাকে নিয়ে চললেন হামার গ্রামে। ওমো ভ্যালি দেখার জন্য ট্যুর অপারেটর আমাকে আলাদা একটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি আর গাইড দিয়েছে। ল্যান্ড ক্রুজার ছাড়া উপায় নেই; কারণ, সমস্ত ওমো ভ্যালির রাস্তা খুবই খারাপ। কোথাও কোথাও মাটির কাঁচা পথ। কোনো কোনো রাস্তার পিচ উঠে, খানাখন্দে ভরে গেছে। এক ঘণ্টার রাস্তা, পৌঁছাতে লাগে তিন ঘণ্টা।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। তুরমি গ্রামের একদম বিজনে আমার রিসোর্ট; তবে মূল গ্রামে ছোট একটি বাজার আছে। সামনে প্রাইমারি স্কুলও। এই গ্রাম তাহলে ‘সভ্যতা’ বিবর্জিত নয়! আফ্রিকা সম্পর্কে আমাদের অনেকের অদ্ভুত সব ধারণা আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সমস্ত আফ্রিকা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর নিরাপদ। এখানকার অধিবাসীরা কখনো উঁচু স্বরে কথা বলেন না। আফ্রিকার মাঝে ইথিওপিয়া হলো আমার দেখা সবচেয়ে গরিব দেশ; তবে এত দিন একা ভ্রমণ করেও আমার কোথাও কিছু খোয়া যায়নি কিংবা কেউ আমাকে কুদৃষ্টিতে দেখেনি।
বাইরের দৃশ্যপটের এখন ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটছে। গ্রামের পথ পেরিয়ে, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাঁটা ঝোপঝাড় নজরে আসছে। পিচঢালা রাস্তার অবস্থা তথৈবচ। প্রতি ১০ মিটার পার হলেই খানাখন্দ দেখিয়ে ছাড়ছে। তবে পথের দুপাশে সারি সারি আকন্দগাছ দেখে যারপরনাই পুলকিত হলাম। আকন্দকে আমি নিজের দেশের ফুল মনে করি। পথের ধারে ফুল ফুটেছে থোকায় থোকায়। কাঁচা আমের মতো একধরনের ফলও ঝুলছে গাছে।
পথে নজরে পড়ল, হামার আদিবাসী পুরুষেরা গরু-ছাগলের পাল নিয়ে এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে চরে বেড়াচ্ছেন। মাঝেমধ্যে নারীদেরও দেখা মিলছে। তারা শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে বাড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পুরুষেরা অবশ্য এখনই বাড়ি ফিরবেন না। সন্ধ্যা হলে গবাদিপশু নিয়ে তবেই ফিরবেন।
দূরের আকাশে এখন সুরমা রঙের মাখামাখি। একটু অভিমানী, তবে বেশ চঞ্চল। এই ঝরিয়ে দিচ্ছে, আবার এই লুকোচুরি খেলছে। পথের কিছু কিছু খানাখন্দে আগে থেকেই বৃষ্টির পানি জমে আছে। তা ভেদ করে এক বিরান জায়গায় এসে ড্রাইভার ইতু গাড়ি থামালেন। এখান থেকে স্থানীয় একজন গাইডকে তুলে নেবেন বলে।
ইথিওপিয়ায় ঘুরে বেড়ানোর আরও একটি নিয়ম হলো, যেকোনো জায়গায় একজন মূল গাইড এবং অবশ্যই একজন স্থানীয় গাইড সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। আমার স্থানীয় গাইডের নাম কিকি। এটি তার আসল কিংবা নকল নাম হতে পারে! তবে আদিবাসীদের পোশাক পরেননি তিনি। সাধারণ টি-শার্ট আর শর্টস পরে আছেন। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। ইদানীং হামার আদিবাসীদের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া খানিকটা হলেও লেগেছে। তারা ঊর্ধ্বাঙ্গে টি-শার্ট পরেন। অনেকের পায়েই দেখা মেলে হাওয়াই চপ্পল। গতকাল বাজারে এই চপ্পল বিক্রি হতে দেখেছি। এগুলো তৈরি হয় গাড়ির টায়ার কেটে।
হামার গ্রামে প্রবেশ করে মনে হলো, এইমাত্র একপশলা বৃষ্টি যেন ঝরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মুখে গ্রামপ্রধান বসে ছিলেন। বয়স সম্ভবত চল্লিশ। একাই বসে ছিলেন তিনি। গলায় চওড়া মালা, হাতে ব্রেসলেট আর পায়ে অ্যাঙ্কলেট—সবই পুঁতির। এখানে সবার ফ্যাশন আলাদা; সবাই সুসজ্জিত।
প্রবেশের অনুমতি পেতেই দেখি, নিটোল সাজানো এক গ্রাম। অনেক দূরে দূরে ছনের একেকটি গোলাকার বাড়ি, আর বাড়ি ঘিরে খড়ির বেড়া। এর মাঝে অল্প কয়েকটি আকাশিয়াগাছ হেলেদুলে দাঁড়িয়ে আছে। এত পরিচ্ছন্ন গ্রাম আমি খুব কমই দেখেছি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন চিরায়ত চেহারার মা। পেছনে দাঁড়িয়ে শিশু; একবার মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার লুকিয়ে পড়ছে। নারীটির ঊর্ধ্বাঙ্গে ছাগলের চামড়ার পোশাক। তাতে কড়ি আর পুঁতি দিয়ে নকশা করে সেলাই করা। আর তার গলায় শোভা পাচ্ছে নানা রঙের পুঁতির চওড়া মালা। হাতে তামার মোটা ব্রেসলেট। আমি তার ভাষা জানি না; তিনি জানেন না আমার। এরা খুব কম ট্যুরিস্টেরই দেখা পান। ইথিওপিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ট্যুরিস্ট আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে, বলা চলে। তা ছাড়া সুন্দর সুন্দর স্পট বাদ দিয়ে কেই-বা এই দুর্গম, আদিবাসীদের দেখতে আসবে? এরা ছবির জন্য পোজ দেওয়া কী, তা-ও জানেন না। নারীটির ভাবলেশহীন কয়েকটি ছবি তুলতেই আমার সামনে এসে পড়লেন বৃষ্টির ছটার মতো উচ্ছল, কলকল করা এক নারী। আমি হাসি ছুড়ে দিতেই তিনিও হেসে ফেললেন। এ তো দেখছি আমাদের মতোই একজন! কে বলবে এখানে আনন্দ নেই, হাসি নেই! গ্রীষ্মের খরতাপে ঝমঝম করে নেমে আসা বৃষ্টির মতো এ নারী বইয়ে দিচ্ছেন উচ্ছ্বাস।
এগোতে এগোতে একদল শিশু আরও উল্লাস বাড়িয়ে দিল। এদের নিম্নাঙ্গে একখণ্ড কাপড় আর গলা ও হাতে পুঁতির গয়না। এরা স্কুলে যায় না। কথিত সভ্যতার কিছুই জানে না; তবু এদের চেয়ে সভ্য জনগোষ্ঠী আমি খুব কমই দেখেছি।
দূরের আকাশ কালো হয়ে আসছে। বৃষ্টি আসা এদের জন্য বিরাট আনন্দের। অনেক দূরের নদীতে গিয়ে স্নানের ঝক্কিতে পড়তে হয় না। গ্রামের মাঝে নিজ আঙিনায় স্নান-উৎসবে মেতে ওঠা যায়। নারীদেরও আনন্দ কম নয়। দূর থেকে পানি সংগ্রহ করার কষ্ট থেকে রেহাই মেলে তাদের।
আমি আরও এগোতে থাকি। প্রতিটি বাড়ি খুব ছিমছামভাবে গোছানো। গোলাকার ঘর, আর চারধারে কাঠের খড়ির বেড়া। স্থানীয় গাইডকে বললাম, ‘কোনো এক ঘরের ভেতরে যাব দেখতে।’ কিকি আমাকে খড়ির বেড়া পার করিয়ে একটি ঘরের সামনে এনে বললেন, ‘তুমি ভেতরে যেতে পারো।’ ভেতরে তখন একজন নারী রাতের খাবারের জন্য সোরগাম পিষছেন। এ দিয়েই পরেজ হবে, আর পরিবারের সকলে মিলে খাবে। পাশে খড়ির চুলায় মাটির পাত্রে গরম হচ্ছে পানি। কিকির কাছে জানতে চাইলাম, ‘এই না হয় রান্নাঘর দেখালে; এদের শোবার ঘর কোথায়?’ কিকি বললেন, ‘এখানেই এক পাশে রান্না করা হয় আর অপর পাশে পাটি পেতে এরা ঘুমান।’ অবাক হলাম। অবশ্য যারা মিনিমালিস্ট, তারা তো এভাবেই বসবাস করেন। গবাদিপশুর জন্য অবশ্য আলাদা ঘর আছে। আলাদা মালিকের পশুর জন্য আলাদা ঘর। সেখানে রাতে নিরাপদে থাকে পশুরা।
যখন এদিক-ওদিক ঘুরছি, তখনো কেউ আমার পিছু নেয়নি। একদল শিশু দেখে আমিই ওদের পিছু নিলাম। আমার কাছে সব শিশুই সমান। এদের মন সমানভাবে গড়ে উঠেছে। এরা এখনো পৃথিবীর পঙ্কিলতা থেকে দূরে আছে। কয়েকটি শিশুর পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আশপাশে কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসক নেই, তাই রোগবালাই হলেও এখানে চিকিৎসা নেই। সবার গলায় রংবেরঙের পুঁতির মালা। আমি কয়েকজনের ছবি তুলে একে একে দেখাতে লাগলাম। এ গ্রামে বাইরের কেউ আসে না। বিদ্যুৎ নেই, পানির সুব্যবস্থা নেই, সেলফোন তো দূরের কথা। চার-পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু আমার মোবাইলে ওর ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল। এদের কাছে সাজসজ্জার জন্য আয়না নেই। শিশুটি নিজেও জানে না সে দেখতে কেমন। নিজের ছবি দেখে তার বিস্ময় কাটছিল না। এরপর একে একে প্রায় সব শিশুকে তাদের ছবি দেখাতে হলো। এদিকে দূরে মেঘের ডাক আরও ঘনীভূত হতে থাকল। হামার আদিবাসীদের কি নিজস্ব মেঘমল্লার আছে? আছে নিশ্চয়ই! কিকি আর মেলাক এখন আমাকে শিশুদের মাঝে ছেড়ে দিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেছেন!
এদিকে কিছুক্ষণ পর ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলে কিকি কোত্থেকে যেন উদয় হয়ে বললেন, ‘চলো, গাড়িতে গিয়ে বসবে।’ আমি ভিজতে চাইছিলাম শিশুদের সঙ্গে; কিন্তু সেটি হওয়ার নয়। এই দুর্গম লোকালয়ে অসুখে পড়লে ডাক্তার পেতে কয়েক শ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে। তাই দুজন গাইড আমাকে ধরেবেঁধে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন।
এদিকে গবাদিপশুর পাল নিয়ে গ্রামের পুরুষেরা দলে দলে গ্রামের দিকে আসতে আসতেই আকাশ দিল মেঘমল্লারে টান। গাড়ির জানালা দিয়ে আমি দেখি, দূরদূরান্ত থেকে আকাশ কালো করে ঝেঁপে বৃষ্টি নামছে। এই বর্ষা এখন উৎসব হয়ে ধরা দিয়েছে সকল আদিবাসীর কাছে। প্রথমে শিশু, পরে সবাই মিলে অবগাহন করে এক আনন্দ নিকেতনে পরিণত করেছেন এই ধরণীকে। আফ্রিকার কালো মানুষ এরা, বাকি পৃথিবীর কাছে অবহেলিত; কিন্তু এদের এই আনন্দ উদ্যাপনের সাবলীলতা অন্য যে কাউকে হার মানায়। এই আনন্দ নিখাদ।
ছবি: লেখক