skip to Main Content

প্রাগৈতিহাসিক I সুমেরীয় স্বাদ সন্ধান

পৃথিবীর প্রথম নগরসভ্যতা হিসেবে স্বীকৃত। মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। প্রায় ৩ হাজার ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গঠিত এ সভ্যতার সমাজ কৃষি, নগর-পরিকল্পনা ও লিপি ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল। খাদ্যাভ্যাসেও ছিল চমক

সুমেরীয় সভ্যতার অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের কেন্দ্রে ছিল একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় খাদ্যাভ্যাস, যা তাদের কৃষি দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রতিফলন। তারা গম, বার্লি, মটর, মসুর, খেজুর, পেঁয়াজ, রসুন, লেটুস, লিকস, সরিষাসহ বিভিন্ন শস্য ও শাকসবজি চাষ করতেন। এ ছাড়া মাছ ধরা এবং পাখি ও গজেল (হরিণবিশেষ) শিকারে ছিলেন পটু। তাদের খাদ্যাভ্যাসে শস্যজাতীয় দ্রব্যের প্রাধান্য ছিল।
কৃষিভিত্তিক কুজিন
কৃষি ছিল সুমেরীয় সমাজের ভিত্তি। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর বার্ষিক বন্যায় প্লাবিত হতো মেসোপটেমিয়ার উর্বর ভূমি। ফলে বন্যা-পরবর্তী সময়ে তা কৃষিকাজের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করত। সুমেরীয়রা এই প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাতে উন্নত সেচ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিলেন, যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ফসল চাষ করতেন।
শস্যসমূহ
বার্লি ছিল প্রধান শস্য। এটিই ছিল অনেক সুমেরীয় খাবারের মূল উপাদান। রুটি এবং ‘কাশ’ নামক বিয়ারের মতো একটি ফারমেন্টেড পানীয় তৈরিতে ব্যবহৃত হতো এই শস্য। তা ছাড়া, সাধারণ প্রচলিত গমের পাশাপাশি এমার গমও চাষ করা হতো; তবে গম সেখানে কম প্রচলিত হওয়ার কারণ, এগুলো চাষাবাদে পানি প্রয়োজন পড়ে বেশি এবং ওই অঞ্চলের লবণাক্ত মাটিতে এগুলো কম সহনশীল।
ডাল ও সবজি
সুমেরীয়রা মসুর, ছোলা, মটরসহ বিভিন্ন ধরনের ডাল চাষ করতেন। অন্যদিকে পেঁয়াজ, লাউ, রসুন, শসা প্রভৃতি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ ও সবজি খেতেন তারা। সাধারণত খেজুরগাছের নিচে, ছায়াযুক্ত স্থানে এসবের চাষাবাদ করা হতো।
ফলমূল
খেজুর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল, যা ওই অঞ্চলের গরম ও শুষ্ক জলবায়ুতে ভালোভাবে উৎপাদিত হতো। এগুলো তাজা ও শুকানো—দুই অবস্থায় খাওয়ারই চল ছিল। ফলটি ছিল ওই সভ্যতার অধিবাসীদের জন্য চিনি ও ভিটামিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অন্য ফলমূলের মধ্যে আঞ্জির (ডুমুরজাতীয় ফলবিশেষ), ডালিম, আপেল ও আঙুর চাষের চল ছিল; তবে তুলনামূলক কম পরিমাণে।
পশুপালন ও মাংস ভোজন
সুমেরীয়রা মূলত উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত থাকলেও বিভিন্ন প্রাণিজ খাবারের স্বাদও নিতেন। ভেড়া ও ছাগল সাধারণত মাংস, দুধ ও উলের জন্য পালন করা হতো। মাটন ছিল প্রধান খাদ্যপণ্য। গরুর মাংস তুলনামূলকভাবে কম খাওয়া হতো; কারণ, গবাদিপশুর জন্য পর্যাপ্ত চারণভূমি ছিল না। হাঁস, মুরগি ও কোয়েল পাখি সুমেরীয়দের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল। গজেল ও হরিণের মতো বন্য প্রাণী শিকার করে খাওয়ার চল ছিল; তবে তা মূলত ধনিক শ্রেণির মধ্যে। নদী ও খালের কাছাকাছি যারা বসবাস করতেন, তাদের কাছে মাছ ছিল প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সুমেরীয়রা পঞ্চাশটিরও বেশি প্রজাতির মাছ শিকার করতেন। শিকারের পর বেশির ভাগ সময় শুকিয়ে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হতো।
দুগ্ধজাত পণ্য ও ফারমেন্টেড ফুড
সুমেরিয়ান খাদ্যাভ্যাসে দুগ্ধজাত পণ্য ও ফারমেন্টেড ফুডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গরু, ছাগল ও ভেড়ার দুধ টাটকা পানের পাশাপাশি বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। গরম আবহাওয়ার কারণে দুধ দ্রুত খারাপ হয়ে গেলে, দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য ও কম পচনশীল হওয়ায় ঘি তৈরির চল ছিল। পনিরও সাধারণত তৈরি করা হতো; যার মধ্যে নরম থেকে শুরু করে পুরোনো ও শক্ত পনির পর্যন্ত ছিল। কিছু পনিরে মসলা বা ভেষজ মেশানো, কিছুতে আবার মধু যোগে মিষ্টি করা হতো। এসব দুগ্ধজাত পণ্য অনেক সময় এককভাবে খাওয়া হলেও রান্নায় ব্যবহারের চল ছিল।
রুটি ভোজ
সুমেরীয় খাদ্যাভ্যাসে রুটি ছিল একটি মৌলিক খাবার। সবচেয়ে প্রচলিত রুটির ধরন ছিল খামিরবিহীন, যা বার্লি ময়দা দিয়ে তৈরি করা হতো। গম ও এমার গম ব্যবহার করে উন্নত মানের রুটি তৈরির চল ছিল, যা সাধারণত ধর্মীয় কাজে উৎসর্গের জন্য সংরক্ষিত থাকত। রুটিতে মাঝেমধ্যে তিলের তেল, চর্বি কিংবা মাছের তেল মেশানো হতো। বিশেষ করে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত খাবারে মিষ্টি স্বাদের জন্য মধু বা ফলের রস যোগ করার রেওয়াজ ছিল। পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার; যেমন উর নগরের রানি পু-আবির সমাধিতে পাওয়া সূক্ষ্ম গুঁড়া করা খামিরবিহীন রুটির টুকরো সুমেরীয় সমাজে খাবারটির গুরুত্বকে নির্দেশ করে।
সুপ, স্টু ও পোরিজ
সুমেরীয় রন্ধনশিল্পে বিভিন্ন ধরনের সুপ, স্টু ও পোরিজ জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এগুলো সাধারণত শস্য, পানি বা দুধ দিয়ে সেদ্ধ করে এবং শাকসবজি, ডাল ও মাংস যোগে তৈরি করা হতো। একটি উল্লেখযোগ্য খাবার ছিল সাসকুয়াচ, যা বার্লি ময়দা, দুধ বা পানি দিয়ে রান্না করা হতো; তাতে মিষ্টি স্বাদ এনে দিত খেজুরের সিরাপের ব্যবহার। খাবারটি সব শ্রেণির মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ও সহজলভ্য ছিল। স্টু সাধারণত মাংস, শাকসবজি ও ডাল দিয়ে ধীরে ধীরে রান্না করা হতো; ফলে এটি হয়ে উঠত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। স্বাদ বাড়ানোর জন্য এসব খাবার ধনে, জিরা, থাইমসহ বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ও মসলা দিয়ে সিজন করার চল ছিল।
খাদ্যের তাৎপর্য
সুমেরীয় সমাজে খাদ্য ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সুমেরীয়রা বিশ্বাস করতেন, দেবতাদেরও আহার প্রয়োজন। তাই দেবতাদের উদ্দেশে জাঁকজমকপূর্ণ খাবার প্রস্তুত করতেন তারা। মন্দিরগুলোতে নিবেদিত রান্নাঘর ছিল, যেখানে পুরোহিতেরা দেবতাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করতেন। এই নিবেদনগুলোতে প্রায়শই রুটি, মাংস, ফলমূল এবং বিশেষ পানীয় অন্তর্ভুক্ত থাকত। উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো ছিল সবাই মিলে ভোজনের উপলক্ষ। এসব আয়োজনে বিপুল পরিমাণ খাবার ও পানীয় প্রস্তুত করে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হতো। তাতে সামাজিক বন্ধন হতো জোরালো।
সুমেরীয় খাদ্যাভ্যাসে তাদের কৃষি উদ্ভাবন, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন ছিল। রান্নাবান্না ছিল বৈচিত্র্যময়, যা উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ পণ্যের বিস্তৃত পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। একই সঙ্গে, এটি তাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি ও চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top