কুন্তলকাহন I বিলাসী নাকি সুলভ
চড়া দামে চুলের বিলাসী পণ্যে বিনিয়োগের যথার্থতা কতটুকু? নাকি বিকল্প হিসেবে হাতের নাগালে তুলনামূলক সস্তায় যেসব বিকোয়, তা-ই যথেষ্ট চুলচর্চায়। কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিতর্ক বহু বছর পুরোনো। কেরাসটাস, ওলাপ্লেক্স কিংবা শু উয়েমুরার মতো লাক্সারি হেয়ারকেয়ার ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের প্রাইস ট্যাগ দেখে যেখানে চক্ষু চড়কগাছ, সে ক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহারে কাজ হবে না, তা কি হয়! আবার অনেকের মত, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার কিংবা ট্রিটমেন্ট সেসব একই হয়। ফর্মুলার হেরফেরে হয়তো ফলটা মেলে বেশি কি কম। আসলে কাহিনিটা কী!
তারতম্যের মূলে
হাই-এন্ড কিংবা ড্রাগস্টোর—বেসিক ফাংশন সেই একই। চুল পরিষ্কার, পরিপুষ্টির জোগান আর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত। কিন্তু মূল পার্থক্য মূলত দুই জায়গায়। প্রথমত, এগুলো কীভাবে কাজ করে; আর দ্বিতীয়ত, এগুলোর সরবরাহ করা ফলাফলের দীর্ঘস্থায়িত্ব।
পণ্যগুলোর উপাদান তালিকায় উপস্থিত প্রতিটি নামের মান দিয়েও হয় পার্থক্য। লাক্সারিয়াস ব্র্যান্ডগুলোতে থাকে অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট, যা কাজ করে গভীরে গিয়ে। পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত হয় অ্যাডভান্সড রিপেয়ার টেকনোলজি, অ্যামাইনো অ্যাসিড, সেরামাইড, বোটানিক্যাল এক্সট্র্যাক্ট; যা চুলের বাহির থেকে ভেতরে মেরামতের কাজ করে, জোগায় শক্তি। অন্যদিকে ড্রাগস্টোর ব্র্যান্ডের হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টগুলোতে ব্যবহার করা হয় সস্তা ফিলার, সিলিকন আর সালফেট। যেগুলো সাময়িকভাবে চুলে নরম, কোমল ভাব আর মসৃণতা জোগায় বটে; কিন্তু চুলের সুস্থতা বৃদ্ধিতে আদতে কোনো ভূমিকা রাখে না। শর্ট টার্মে কাজ করা এসব পণ্য ব্যবহারে উল্টো বিল্ডআপ সৃষ্টি হয় স্ক্যাল্পে। নির্দিষ্ট সময় পর দেখা যায় শুষ্কতা আর ভঙ্গুর ভাব।
উপাদান উপযোগিতা
বিলাসী হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট মানে যে শুধু ঝকমকে মোড়ক, তা কিন্তু নয়; বরং এর ফরমুলেশনেই মূল জাদুকরি। সেখানেই ড্রাগস্টোরের সঙ্গে এর বিভেদ। যেমন K18 নামের লাক্সারিয়াস হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ডটি বায়োমাইমেটিক পেপটাইডের জন্য জনপ্রিয়; যা ক্ষতিগ্রস্ত চুল ভেতর থেকে সারাইয়ের জন্য ক্লিনিকালি প্রুভেন। ট্র্যাডিশনাল কন্ডিশনিং ট্রিটমেন্টের মতো নয় যে শুধু চুলকে আচ্ছাদিত করে রাখবে; বরং K18 ভেঙে যাওয়া কেরাটিন চেইনকে মেরামত আর শক্তি পুনরুদ্ধার করে। মলিকিউলার লেভেলে বাড়ায় ইলাস্টিসিটি। একইভাবে কেরাসটাস ব্যবহার করে উচ্চ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন উপাদান; যেমন সেরামাইড, হায়ালুরনিক অ্যাসিড, অ্যামিনো অ্যাসিড—গভীরে আর্দ্রতা জোগাতে। চুলকেও করে তোলে শক্তিশালী। এই ব্র্যান্ডের প্রতিটি প্রোডাক্ট এমনভাবে নকশা করা; যা নির্দিষ্ট সমস্যাকে লক্ষ্যে রেখে কাজ করে। হোক তা শুষ্কতা, নেতিয়ে পড়া, হিট অথবা কালার করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত।
অন্যদিকে ড্রাগস্টোর শ্যাম্পু তৈরি হয় শক্তিশালী সালফেট থেকে, মাথার ত্বক পরিষ্কারের জন্য। এতে চুল পরিষ্কার আর সতেজ অনুভূত হয় বটে, কিন্তু প্রাকৃতিক তেল নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করে; যা বাড়ায় শুষ্কতা আর অস্বস্তি।
প্রযুক্তি আর গবেষণাপ্রসূত
বিলাসী পণ্যের দাম বাড়তি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ—বহু বছরের গবেষণা, উদ্ভাবন আর নিরীক্ষার পেছনে ব্যয়। শু উয়েমুরার মতো ব্র্যান্ড জাপানিজ বিউটি রিচুয়াল থেকে অনুপ্রাণিত। ক্যামেলিয়া অয়েল, ফারমেন্ট আর দুর্লভ সব উদ্ভিজ্জ নির্যাস দিয়ে ইনফিউজড এই ব্র্যান্ডের প্রতিটি প্রোডাক্ট। উদ্দেশ্য—অনেক বেশি চিপচিপে বা ভারী না করে চুলকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেওয়া। এর জন্য প্রতিটি পণ্যকেই কড়া ল্যাব টেস্টিং পেরোতে হয়, শুধু তাদের কার্যকারিতার উচ্চমান নিশ্চিত করার জন্য।
লাক্সারি হেয়ার কেয়ার কোম্পানিগুলো পেটেন্ট করা ফর্মুলা তৈরির জন্য দীর্ঘদিনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালায়; যা মূলত চুলের চেহারা পাল্টে দেয়। আর ড্রাগস্টোর ব্র্যান্ডগুলো বেশি গুরুত্ব দেয় ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার ওপর এবং উৎপাদনের ব্যাপকতায়। তাই এভাবে ভাবলে ব্যাপারটা আরও সহজ হয় যে, ড্রাগস্টোর শ্যাম্পু হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য আর লাক্সারি হেয়ারকেয়ার তৈরি হয় চুলের বিশেষ চাহিদা মেটাতে।
কর্মক্ষমতা ও দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল
যদিও ড্রাগস্টোর ও লাক্সারি—দুই ধরনের প্রোডাক্টই স্বল্প মেয়াদে চুলকে সুন্দর দেখাতে পারে; এখানে আসল প্রশ্ন হলো, কয়েক মাস বা বছর নিয়মিত ব্যবহারের পর চুল কেমন দেখায় বা অনুভূত হয়। লাক্সারি হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ডগুলো তাদের প্রোডাক্ট এমনভাবে বানায়, যেন প্রতিটি থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা মেলে। যেমন K18 এর পণ্যগুলো চুলকে কেমিক্যাল এবং হিট ড্যামেজের হাত থেকে বাঁচিয়ে পুনরুদ্ধার করে প্রাণ, একদম মলিকিউলার লেভেল থেকে। কেরাসটাস কাস্টমাইজড সলিউশন দেয় আর্দ্রতা রক্ষায়, সমস্যা সারাইয়ে আর মাথার ত্বক সুস্থ রাখতে। শু উয়েমুরা তাদের চুলচর্চার পণ্যে স্কিন কেয়ার ইন্সপায়ারড টেকনোলজি ব্যবহার করে, আলট্রা লাক্সারিয়াস ফর্মুলা তৈরির জন্য; যা চুলকে রাখে মসৃণ ও সুরক্ষিত। রাখে বশেও।
অন্যদিকে ড্রাগস্টোর ব্র্যান্ডগুলো চুলের সাধারণ দেখভালের জন্য চলনসই। রংচঙে, রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত চুলের জন্য প্রয়োজনীয় গভীর মেরামত কিংবা সুরক্ষা দিতে অক্ষম। যারা খুব ঘন ঘন ব্লিচ, কালার বা হেয়ারস্টাইল করেন, তাদের উচিত হাই কোয়ালিটি ট্রিটমেন্টে বিনিয়োগ করা। দীর্ঘ সময় চুলের মজবুত, উজ্জ্বলতা আর মসৃণতা ভাব ধরে রাখতে।
মূল্যটা যখন মুখ্য
সবচেয়ে বড় উদ্বেগেরও বিষয়। ড্রাগস্টোর প্রোডাক্টের দাম যেখানে হাজার টাকার মধ্যে; এখন ৫-৬ হাজার টাকা খরচ করে এক বোতল শ্যাম্পু কেনা অনেকের কাছে বিলাসিতাই বটে। তখনই এমন ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দেয় পণ্যের ফরমুলেশন। লাক্সারি প্রোডাক্টের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি হয়, অর্থাৎ অল্প পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন হয় প্রতি ওয়াশে, তাই টেকেও বহুদিন। অন্যদিকে ড্রাগস্টোরের সাধারণ পণ্য মাস পেরোতেই ফুরুত! এ ছাড়া লাক্সারি পণ্যের ব্যবহার ভবিষ্যৎ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায় চুলকে। বেঁচে যায় রিপেয়ার ট্রিটমেন্ট, ডিপ কন্ডিশনিং আর ঘন ঘন স্যালনে দৌড়াবার খরচ। তবে সবার যে পুরো লাক্সারি রুটিনের প্রয়োজন আছে, ব্যাপারটা তেমনও নয়। মূল কিছু পণ্য একটু দাম দিয়ে কেনা যেতে পারে; যেমন হাই কোয়ালিটি ট্রিটমেন্ট, নারিশিং মাস্ক অথবা লাক্সারি অয়েল। আর প্রতিদিন চুল পরিষ্কারে হাতের নাগালে থাকা সাধারণ শ্যাম্পুর ব্যবহার হলেও ক্ষতি নেই।
শেষমেশ
তাহলে লাক্সারি নাকি ড্রাগস্টোর—কোনটা এগিয়ে? প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে চুলের ধরন, প্রয়োজন আর লক্ষ্যের ওপর। কারও চুল সুস্থ, লো-মেইনটেন্যান্স আর কালার ট্রিটেড না হলে ড্রাগস্টোর প্রোডাক্ট দিয়ে চলতে পারে চুলচর্চা। কিন্তু চুল যদি হয় ক্ষতিগ্রস্ত, শুষ্ক আর কেমিক্যালি ট্রিটেড; তাহলে হাই কোয়ালিটি, প্রফেশনাল গ্রেড প্রোডাক্ট দীর্ঘ মেয়াদে চুলের সুস্থতা বজায় রাখবে।
বিউটি ডেস্ক
মডেল: মৃদুলা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল