টেকসহি I লেদার লায়াবিলিটি
যে বোঝা বয়ে বেড়ায় পুরো বিশ্ব। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ; হয়ে ওঠে বসবাসের অনুপযোগী। যার দায় বর্তায় চামড়া পণ্য উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর। সেটি এড়ানোর জুতসই উপায়ের খোঁজ তো করতেই হবে
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খাত, কিন্তু এটি পরিবেশদূষণের প্রধান উৎস হিসেবেও বিবেচিত। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও উৎপাদনের সময় প্রচুর বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। চামড়া বর্জ্যরে ধরন, তার পরিবেশগত প্রভাব এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রয়োজন আলোচনা।
চামড়া বর্জ্য কী
চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও উৎপাদনের সময় তৈরি হওয়া অতিরিক্ত বা অব্যবহৃত উপকরণ, যা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত—সলিড এবং তরল বর্জ্য। সলিড বর্জ্যরে মধ্যে চামড়া কাটা, ছাঁটা ও প্রক্রিয়াকরণের সময় যে শেভিং, ট্রিমিং ও গুঁড়া আকারে তৈরি হয়, তা সবচেয়ে বেশি। এসব বর্জ্য সাধারণত পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে গুঁড়া সঠিকভাবে নিষ্কাশিত না হলে। তবে আধুনিক শিল্পে এগুলোকে সম্ভাব্য সম্পদ হিসেবে দেখে ফার্নিচার কভার, ব্যাগ, বেল্ট ও গৃহসজ্জার সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে শক্তির উৎস হিসেবেও দাহ্য করা হয়, যা বর্জ্য কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, তরল চামড়া বর্জ্য বা এফ্লুয়েন্ট প্রক্রিয়াকরণের সময় তৈরি হয় এবং এতে সালফাইড, ক্রোমিয়াম, ভারী ধাতু, প্রোটিন, চর্বিসহ বিভিন্ন দূষক থাকে, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক শোধন পদ্ধতি ব্যবহার করে এই দূষণ দূর করা হয়। ফলে পরিশোধিত পানি নিরাপদে নিষ্কাশন এবং উৎপাদনে পুনর্ব্যবহার সম্ভব হয়, যা পরিবেশগত ক্ষতি অনেকটাই কমায়।
ব্যবস্থাপনার জরুরত
চামড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু পরিবেশ রক্ষার দিক থেকেই নয়; বরং সামগ্রিক অর্থনীতি, শিল্পের টেকসইতা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটি, জল ও বায়ুদূষণ রোধ করা যায়। অপরিশোধিত চামড়া বর্জ্য সরাসরি প্রকৃতিতে ছেড়ে দিলে তা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, চামড়াশিল্পের কাঁচামাল, পানি ও জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর ভূমিকা রাখে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে খরচ কমে যায় এবং উৎপাদনের দক্ষতা বাড়ে। তৃতীয়ত, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ উদ্যোগগুলো নতুন পণ্য তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। এর পাশাপাশি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে ভালো অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়। কারণ, ভোক্তারা এখন বেশি পরিবেশসচেতন এবং তারা এমন ব্র্যান্ডকে সমর্থন করেন, যারা পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ।
বিবিধ ব্যবস্থাপনা
চামড়াশিল্পে উৎপাদনের সময় যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তা সঠিকভাবে পরিচালনা না করলে পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হলো এটি কমানো; রিইউজ, রিসাইক্লিং এবং পরিবেশগত ক্ষতি হ্রাস করা। এতে টেকসই উৎপাদন, চক্রাকার অর্থনীতি ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল অন্তর্ভুক্ত।
রিইউজ
কোনো পণ্যকে তার মূল উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ভিন্ন কাজে পুনর্ব্যবহার করার পরিবেশবান্ধব একটি পদ্ধতি। চামড়ার তৈরি পোশাক, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি অনেক সময় দ্বিতীয়বার ব্যবহারের উপযোগী থাকে এবং এসব পণ্য অনলাইনে যেমন ই-বে বা পশমার্কে কিংবা লোকাল থ্রিফট স্টোর ও কনসাইনমেন্ট শপে বিক্রি বা দান করা যেতে পারে। এই সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেটের মাধ্যমে নতুন চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে; ফলে পরিবেশগত প্রভাবও হ্রাস পায়। একই সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম খরচে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সুযোগ ঘটে এবং অনেক দোকান দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় স্থানীয় কমিউনিটিও উপকৃত হয়।
আপসাইক্লিং
এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে বর্জ্য উপকরণকে ব্যবহার করে নতুন ও উন্নত মানের পণ্য তৈরি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, চামড়ার কাটা অংশ বা অতিরিক্ত স্ক্র্যাপ দিয়ে ওয়ালেট, চাবির রিং, গয়না তৈরি করা যায়, আর বড় অংশগুলো দিয়ে ইনসুলেশন প্যানেল, আসবাবের কাঠামো বা গাড়ির যন্ত্রাংশের জন্য কাঁচামাল তৈরি সম্ভব। এতে বর্জ্যরে পরিমাণ কমে, নতুন কাঁচামালের চাহিদাও হ্রাস পায়, যা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ কমায়। পাশাপাশি সৃজনশীল ও অভিনব সব পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি হয়।
রিসাইক্লিং
সাধারণত বর্জ্য উপাদানকে ভেঙে কাঁচামালে রূপান্তর করে নতুন পণ্য তৈরি করা হয়। এর প্রধান দুটি পদ্ধতি রয়েছে—যান্ত্রিক ও রাসায়নিক। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চামড়ার বর্জ্য টুকরো করে ফাইবার বা কণায় রূপান্তর করা হয়, যা আসবাবের কভার বা মেঝের উপকরণ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে কৃত্রিম রঞ্জক থাকলে তা সরানো কঠিন এবং রিসাইকেল্ড পণ্যের বাজার সীমিত। রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারে বর্জ্য চামড়াকে রাসায়নিকভাবে ভেঙে প্রোটিন ও ফ্যাট আলাদা করে বায়োফুয়েল, সাবান, বায়োডিজেল ইত্যাদি তৈরি করা হয়, যা জটিল বর্জ্যও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলে।
ল্যান্ডফিল
যেসব চামড়ার বর্জ্য পুনর্ব্যবহার বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য নয়, সেগুলো শেষ পর্যন্ত ল্যান্ডফিলে পাঠানো হয়। যেখানে নির্ধারিত জায়গায় এসব বর্জ্য মাটির নিচে ঢেকে রাখা হয়, যাতে গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমে। তবে ল্যান্ডফিলের পরিবেশগত প্রভাবও গুরুতর। এতে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। পাশাপাশি মাটি ও পানিতে দূষণ ছড়িয়ে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগবাহী জীবাণু আকৃষ্ট করে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। আধুনিক ল্যান্ডফিল ব্যবস্থায় লাইনার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, যা তরল বর্জ্যকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে এবং গ্যাস সংগ্রহ করার মাধ্যমে মিথেন গ্যাস ধরে রেখে তা নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়।
ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জসমূহ
অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও নীতিনির্ধারণগত ক্ষেত্রে বিস্তৃত এই চ্যালেঞ্জগুলো।
অর্থনৈতিক
চামড়ার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে, যা টেকসই উদ্যোগ বাস্তবায়নে অন্তরায় সৃষ্টি করে। প্রথমত, পুনর্ব্যবহার ও আপসাইক্লিং প্রযুক্তি প্রয়োগে উচ্চ ব্যয় জড়িত। এর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ, উন্নত যন্ত্রপাতি ও পরিকাঠামো, যা অনেক ছোট বা কম-আয়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বহন করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, এই খাতে আর্থিক প্রণোদনার অভাব রয়েছে; সরকার বা বেসরকারি খাত অনেক সময় এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় না। কারণ, তাৎক্ষণিক লাভের সম্ভাবনা কম। তৃতীয়ত, বাজারে চামড়ার পুনর্ব্যবহৃত পণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে উৎপাদকেরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারায়। এই অর্থনৈতিক বাধাগুলো কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রযুক্তিগত
চামড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একাধিক প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা এর কার্যকারিতা ও দক্ষতা কমিয়ে দেয়। প্রথমত, চামড়া জৈব ও অজৈব উপাদানের জটিল মিশ্রণ। যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, তেল ও রঞ্জক উপাদান, যা প্রক্রিয়াজাতকরণকে জটিল করে তোলে এবং এর জন্য বিশেষায়িত প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়ে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য যেমন কঠিন, তরল, ধুলো ও ছাঁটাই অংশকে আলাদা করা সহজ নয়; প্রতিটি প্রকারের জন্য আলাদা প্রক্রিয়া দরকার, যা না হলে খরচ বেড়ে যায় এবং কার্যকারিতা কমে। তৃতীয়ত, বর্তমান প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু নির্দিষ্ট বর্জ্য, বিশেষ করে দূষকসমৃদ্ধ তরল বা আপসাইক্লিং উপযোগী কঠিন বর্জ্য, সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয় না। এই সীমাবদ্ধতাগুলো চামড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে টেকসই করার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
নীতিনির্ধারণগত
চামড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নীতিগত ও আইনগত নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থার পথে বাধা সৃষ্টি করে। অনেক দেশে এই খাতে পরিষ্কার ও সমন্বিত নিয়ম না থাকায়, একই দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন বিধিনিষেধ দেখা যায়, যা ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের জন্য বিভ্রান্তির কারণ হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান আইন থাকলেও সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগ প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে, কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান আইন ভঙ্গ করে পার পেয়ে যায়। তাই চামড়াশিল্প একটি আন্তর্জাতিক খাত হওয়ায় সেখানে এক দেশে উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে ব্যবহৃত হয়; সেখানে আন্তর্জাতিক নীতিমালার সমন্বয়ের অভাবও বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সুসংহত আইন, KOV প্রয়োগ এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা জরুরি।
মোকাবিলায় জরুরি
সমন্বিত ও বহুমাত্রিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। এ ছাড়া চাই—
সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন: বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও সঠিক নিষ্পত্তির দিকনির্দেশনা সহকারে একক ও বাস্তবমুখী নীতিমালা তৈরি করা জরুরি।
আইন প্রয়োগ জোরদার: নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ ও লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ: নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবনে শিল্প ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ বিনিয়োগ প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সহযোগিতা: বৈশ্বিক শিল্প হিসেবে চামড়া খাতে অভিন্ন নীতিমালা ও মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা জরুরি।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে অবগত করতে প্রচারাভিযান ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো দরকার।
সঠিকভাবে চামড়ার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না হলে জল, মাটি ও বায়ুদূষণের মাধ্যমে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। কঠিন ও তরল বর্জ্য, ধুলো এবং কাটাকুটি অংশ ব্যবস্থাপনায় রয়েছে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ। পুনর্ব্যবহার, ল্যান্ডফিল—এসব মূল পদ্ধতির মধ্যে পুনর্ব্যবহারই সবচেয়ে টেকসই। আপসাইক্লিং ও কেমিক্যাল রিসাইক্লিং আধুনিক ও কার্যকর উপায়। সঠিক নীতিমালা, প্রযুক্তি ও সচেতনতা থাকলে চামড়াশিল্পকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
শিরীন অন্যা
ছবি: সংগ্রহ