প্রাগৈতিহাসিক I আদি চীনের আহার
চীনা খাবারের ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছরের পুরোনো। এই দীর্ঘ সময়ে চীনারা তাদের নিজস্ব খাদ্য প্রস্তুত পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছে। উপাদান চিহ্নিত করার কৌশল, নিখুঁত সংমিশ্রণ তৈরি, বহু পর্যায়ে রান্নার উপায় এবং বিভিন্ন স্বাদের সমন্বয়ের দক্ষতা অর্জন করেছে
প্রাচীন চীনের নাগরিকেরা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতেন। ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, সেখানে প্রায় ৫০০০ বছর আগে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল। চীনা রান্না বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের জন্য চিহ্নিত। প্রাচীনকাল থেকে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়েছে খাদ্য। আজকের দিনের অনেক খাবারের গন্ধ ও স্বাদের বৈচিত্র্য প্রাচীন চীনা খাদ্য ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রস্তুত প্রণালি ও পরিবেশন—উভয়কেই গুরুত্ব দিয়ে চীনারা সব সময় খাবারকে একটি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে।
চাল
এই খাদ্যশস্য ছিল প্রাচীন চীনাদের কাছে সমৃদ্ধ কার্বোহাইড্রেটের উৎস। চীনে চালের ইতিহাস পাথরের যুগের শেষ (প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে, সম্ভবত চীনা কৃষকেরাই ধানের জমিন আবিষ্কার করেছিলেন। প্রাচীনকাল থেকে এখনো চাল চীনে প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে ব্যবহৃত। অবশ্য ওই ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল ধরে ধান চাষ করা হলেও উত্তর চীনে প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে তা সম্ভব ছিল না। তাই বাজরা ও সরগাম চাষের চল ছিল।
বাজরা
এটি চীনের আদি খাদ্যশস্য ছিল না; বরং প্রধান খাদ্য হিসেবে একে প্রতিষ্ঠিত হতে বেশ সময় লেগেছিল। তবে প্রায় ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে উত্তর চীনের ঠান্ডা ও শুষ্ক পরিবেশে বাজরা চাষ করা হতো। এই খাদ্যশস্য চীনজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত এবং চীনে চাষের আগে থেকেই এটি অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হান রাজবংশের সময়কালে (২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ) বিশেষ পানীয় তৈরিতেও বাজরা ব্যবহৃত হতো।
গম
আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনে গম চাষ শুরু হয়। এর আগে এই খাদ্যশস্য পশ্চিম এশিয়া থেকে আমদানি করা হতো। গম দ্রুতই প্রাচীন চীনা নাগরিকদের প্রধান কার্বোহাইড্রেটের উৎস হয়ে ওঠে। তারা গমে তৈরি পোরিজ খেতেন; তবে রুটি বানাতেন না। এর মূল কারণ, রুটি সেঁকার জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কয়লা ছিল ব্যয়বহুল।
নুডলস
চীনের প্রাচীন খাদ্য। নুডলসের ইতিহাস জানতে ফিরে যেতে হবে পূর্ব হান রাজবংশের সময়ে (২৫ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ)। তখন এটি চীনা রন্ধনপ্রণালির একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদানে পরিণত হয়। প্রাচীনকালে গমের ময়দা দিয়ে তৈরি করা হতো নুডলস। সং রাজবংশ চলাকালে (৯৬০—১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) এ খাবার এতই জনপ্রিয় ছিল, নুডলসের দোকানগুলো সারা রাত খোলা থাকত। ২০০২ সালে চীনের লাজিয়া নামক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো নুডলস-সংবলিত একটি মাটির পাত্র আবিষ্কৃত হয়।
টফু বা বিন কার্ড
চীনা উৎপত্তির একটি খাদ্য, যা সয়া মিল্ক, পানি ও কোয়াগুলেন্ট দিয়ে তৈরি। পুষ্টিসমৃদ্ধ, চর্বিহীন এবং প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনে ভরপুর হওয়ায় এটি প্রাচীনকাল থেকে চীন ও এশীয় রান্নায় একটি প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক সময় চীনা চিকিৎসকেরা পর্যবেক্ষণ করেন, মাংস প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস হলেও তা খাওয়ার সামর্থ্য শুধু ধনীদের ছিল। এই সমস্যা সমাধানে, চীনে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতি সপ্তাহে বিনা মূল্যে এক কাপ টফু দেওয়ার একটি আইন প্রণীত হয়েছিল। সয়া ও চালের মতো অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হতো সেই টফু, যেন এর গ্রহণকারীরা মাংসের সমান প্রোটিন পেতে পারেন। সে সময় চীনে আকারে বড় খাবার রান্না করা কঠিন ছিল; তাই নাগরিকেরা তাদের খাবার ছোট টুকরো করে রান্না করতেন। কালের পরিক্রমায় টফু পশ্চিমা নিরামিষ খাবারে জনপ্রিয় উপাদান হয়ে উঠেছে।
চা
চীনে চায়ের ইতিহাস প্রায় ৪০০০ বছরের পুরোনো। দেশটির নাগরিকেরা চা পান করাকে চমৎকার শিল্পরূপ হিসেবে বিবেচনা করেন, যার সঙ্গে অনেক রীতি ও আচার-অনুষ্ঠান জড়িত। চা বর্তমানে চীনের জাতীয় পানীয় এবং কফি ও কোকোর সঙ্গে বিশ্বের তিনটি সবচেয়ে জনপ্রিয় উষ্ণ পানীয়ের একটি। চীন গর্বিতভাবে নিজেকে চায়ের জন্মস্থান হিসেবে গণ্য করে; কারণ, সে দেশই প্রথম চা চাষাবাদ, প্রক্রিয়াকরণ ও পান করার পদ্ধতির সঙ্গে বিশ্বকে পরিচিত করেছিল।
মাংস
চীনে শূকরের মাংস খাওয়ার চল বেশি। তবে গরু, ভেড়া, মুরগি, হাঁস, কবুতর প্রভৃতি পশু ও পাখির মাংসও খাওয়া হয়। দেশটিতে ৪০০০ বা ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শূকরের মাংস খাওয়ার চল শুরু হলেও ভেড়া ও গরু স্থানীয় পশু ছিল না; এগুলো পশ্চিম এশিয়া থেকে সেখানে পৌঁছেছিল। মাংস বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মাংস খেতেন না বলে প্রাচীন চীনে অনেকে প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাদ্যতালিকায় টফু কিংবা মোটর দই ব্যবহার করতেন।
সরগাম
মাইলো নামেও পরিচিত। একে ‘ফসলের উট’ (দ্য ক্যামেল অব কর্পস) বলা হয়। কেননা, এটি চাষাবাদে খুব বেশি পানির প্রয়োজন পড়ে না; এমনকি সাধারণ মাটিতেও জন্মাতে পারে। সরগামের বীজ ও সারের খরচ অন্যান্য শস্যের তুলনায় কম। প্রাচীন, বিশেষত নব্যপ্রস্তর যুগে চীনে এই খাদ্যশস্য উৎপাদন শুরু হয়। শিজিয়াজুয়াংয়ে ওয়ারিং স্টেট পিরিয়ড (খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৫-২২১) থেকে প্রচুর দেখা মেলে এর। জেনেটিক রিসোর্স সেন্টারের মতে, চীন হচ্ছে সরগাম উৎপত্তির সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহত্তম কেন্দ্র।
শাকসবজি
প্রাচীন চীনে প্রকারভেদ কম থাকলেও সবজি ছিল মানুষের খাদ্যতালিকার অপরিহার্য অংশ। নাগরিকেরা প্রধান খাদ্য ভাতের সঙ্গে সবজি খেতেন। সে সময়ের প্রধান সবজি ছিল সয়াবিন ও শসা। সয়াবিন ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন চীনে প্রধান শস্য হয়ে ওঠে।
প্রাচীনকাল থেকেই চীন খাদ্যসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এ ছাড়া দেশটির দক্ষিণ ও উত্তর অঞ্চলের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য রয়েছে, যা আঞ্চলিক রান্নার পার্থক্য সৃষ্টি করে।
ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট