ফিচার I মুড়ি মুড়মুড়ে
এই অঞ্চলের খাদ্যসংস্কৃতিতে মুড়ি বেশ চিরচেনা খাবার। সারা বছর এর চল রয়েছে। তবে বর্ষা মৌসুম যেন এর মুড়মুড়ে স্বাদ উপভোগের মোক্ষম সময়
মুড়ি। একদিকে হালকা ও সহজে খাবারযোগ্য, অন্যদিকে নানা সাজসজ্জায় রূপান্তর করে সে খাবারে নানা স্বাদ ও অনুভূতি এনে দেওয়ার উপযোগী। মুড়ি শুধু একটি খাবার নয়; মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস ও সংস্কৃতির মিলন উপলক্ষও বটে!
মুড়ির প্রস্তুতপ্রণালি বেশ প্রাচীন। এর উৎপত্তি সম্ভবত বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল কিংবা কোরিয়ায়। ধারণা করা হয়, যখন মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করে, তখন থেকেই মুড়ি তৈরির ইতিহাস শুরু। প্রাচীনকালে মুড়ি তৈরি হতো বিভিন্ন পদ্ধতিতে। যেমন গরম বালুতে চাল ভেজে অথবা বিশেষ ধরনের পাত্রে চাল গরম করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুড়ি তৈরির কৌশল উন্নত হয়েছে; তবে এর মূল ধারণা একই রয়ে গেছে।
বিভিন্নভাবে মুড়ি খাওয়ার চল রয়েছে। কেউ সরাসরি স্ন্যাকস হিসেবে; কেউ আবার বিভিন্ন পদ; যেমন চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, তেঁতুলের টকপানি ইত্যাদিতে মিশিয়ে খেয়ে থাকেন। এমনকি কেউ কেউ মুড়ির সঙ্গে গুড়, চিনি অথবা মধু মিশিয়ে মিষ্টি খাবার হিসেবেও গ্রহণ করেন। সহজলভ্য এবং দ্রুত ভক্ষণযোগ্য হিসেবে ক্ষুধা নিবারণের জন্য এর আবেদন কখনোই কমেনি। অনেকে হয়তো জানেন না, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান; যেমন বিয়ে, জন্মদিন ইত্যাদি উৎসবে স্ন্যাকস হিসেবে মুড়ি পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া অনেক সময় শিশুকে হালকা খাবার হিসেবে এটি খেতে দেওয়া হয়।
বর্তমানে ওবেসিটি বা স্থূলতা একটি প্রচলিত সাধারণ সমস্যা। মুড়ি একটি লো ক্যালরি খাবার হওয়ায় অনেক পুষ্টিবিদ ওজন কমানোর জন্য ডায়েটে একে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। আমাদের দেশে চায়ের সঙ্গে মুড়ি খাওয়াও একটি চিরাচরিত রেওয়াজ। গ্রামাঞ্চলে সকালের আলোতে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে অনেকে খাদ্য হিসেবে এক বাটি মুড়ির ওপর ভরসা রাখেন। ধনীরা বাড়িতে চা-কফির সঙ্গে ছোলা বা বাঁশাই মুড়ি পরিবেশন করেন। সকালে বা দুপুরে ভাতের পরিবর্তে, সর্ষে-তেলে মিশিয়ে মুড়ি খাওয়া হয়। এটি আমাদের দেশে ‘ভাতেমুড়ি’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া মুড়ি আর চিড়া মিশিয়ে খাওয়াও একটি রীতি।
মুড়ি সাধারণত চাল থেকে তৈরি। এটি তৈরির প্রধান প্রক্রিয়া হলো, প্রথমে চাল গরম করা এবং এরপর উচ্চ চাপে মুড়ি ফোলানো। এই পদ্ধতিতে চালের ভেতরের স্টার্চ প্রসারিত হয়ে মুড়ি তৈরি হয়। বিভিন্ন স্থানে মুড়ি তৈরির জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। কোথাও কোথাও গরম বালু ব্যবহারের রেওয়াজ রয়েছে; আবার কিছু স্থানে নেওয়া হয় মেশিনের সাহায্য। বাংলাদেশের ঝালকাঠি, নলছিটি ও লক্ষ্মীপুরের গ্রামাঞ্চলে হাতে বানানো মুড়ি উচ্চমানের; এর দানা বড় এবং খাস্তা দীর্ঘস্থায়ী। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শহরে যান্ত্রিক চুল্লিতে বানানো মুড়ি বেশি দেখা যায়। সেগুলোর দাম কম, কিন্তু দানার আকার ছোট; স্বাদ ও মচমচে কিছুটা কম।
মুড়ির আছে নানা সংমিশ্রণ ও ধরন। ঝালমুড়ি সর্বাধিক পরিচিত ও জনপ্রিয়। এটি মুড়ির সঙ্গে চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, টমেটো, মসলা, সর্ষে তেল, লেবুর রস, ধনেপাতা ইত্যাদির সংমিশ্রণ। এ ছাড়া ভারতে ইন্ডিয়ান স্টাইলের মসলাদার মুড়ি চুনে বা হলুদে ভাজা হয়। বাদাম, সর্ষে তেল, পুদিনাপাতা, লবণ যোগ করে কড়াইতে সামান্য ভেজে খাওয়া হয় ‘মাসালা মুড়মুড়া’। উৎসব বা পূজার দিন মুড়ির মোয়া বা বড় মোয়া জনপ্রিয়। জিরা, এলাচি, চিনি বা গুড় দিয়ে মুড়ি বেঁধে গড়ানো এ খাবার।
মুড়িতে ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি, যা ভোক্তার শরীরে শক্তি সরবরাহ করে। এই খাবারে থাকা ফাইবার হজমপ্রক্রিয়া উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক। এ ছাড়া ভিটামিন বি-এর অভাবে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে; যা মুড়ি খেলে পূরণ হওয়া সম্ভব। মুড়িতে ক্যালসিয়াম ও আয়রন থাকায় এটি হাড়কে শক্তিশালী করতে এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে কাজে দেয়।
মুড়ি কম ক্যালরিযুক্ত হওয়ায় ওজন কমাতে সহায়ক হতে পারে। সহজে হজম হয় এবং পেটের সমস্যা দূর করতে সক্ষম। সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকায় এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর উপস্থিতির কারণে মুড়ি হাড়ের গঠন ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
মুড়ি সাধারণত নিরাপদ খাবার; তবে কিছু ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তাদের মুড়ি খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা চাই। কেননা মুড়িতে অতিরিক্ত চিনি-তেল বা বাদাম মেশালে তা শরীরে চর্বি বাড়িয়ে দিতে পারে।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মুড়ি এখন করপোরেট পণ্য। সারা বছর এই পণ্যের চাহিদা থাকলেও রোজার মাসে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ২০২৪ সালে সম্প্রচারিত বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল ‘এখন’-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা দেশে প্রায় ২ হাজার কারখানায় কাজ করেন সাত লাখের বেশি মুড়ি কারিগর। এ খাতে বার্ষিক ব্যবসা প্রায় ৬০০ কোটি টাকার। পাশাপাশি রপ্তানি হয় ইউরোপ-আমেরিকাতেও।
মুড়ির জনপ্রিয় সংস্করণ ঝালমুড়ি শুধু খাবার নয়; সংস্কৃতির ভাষাও বটে। শহরের রাস্তায় মুড়ি বিক্রেতা যেমন থাকেন; তেমনি গ্রামের প্রান্তেও মুড়ি তৈরি এবং ভক্ষণে পরিবার ও সমাজ মিলেমিশে যায়। জেনে অনেকে অবাক হবেন, রেডডিটে ‘বেস্ট স্ট্রিট ফুড’ তালিকায় ঝালমুড়ির উল্লেখ থাকে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট