skip to Main Content

ফিচার I ভেগান ফুটবল ক্লাব!

পুরোপুরি প্রকৃতিনিষ্ঠ ফুটবল ক্লাব। সে দলের সদস্যরা ভেগান, এমনকি তাদের স্টেডিয়ামটিও সম্পূর্ণ নৈসর্গিক

জীবনচর্চায় যে-কেউ ভেগান হতে পারে, তাই বলে পুরো একটি ফুটবল ক্লাব! হ্যাঁ, এমন একটি ক্লাব রয়েছে ইংল্যান্ডের গ্লুস্টারশায়ারে। ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স।
ফরেস্ট গ্রিন নামটার মধ্যেই আছে অন্য এক ইশারা। কাজে তা স্পষ্টই। প্রকৃতিনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টায় ক্লাবটি ভেগান চর্চাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
২০১১ সাল থেকে ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স ভেগান হবার পথে পা বাড়ায়। প্রথমে তারা খেলোয়াড় ও কর্মীদের খাদ্যতালিকা থেকে রেড মিট বাদ দেয়। পরে বাদ পড়ে মাছ। কয়েক মাসের মাথায় তারা স্টেডিয়াম চত্বরে দর্শকদের কাছে বার্গার, স্যান্ডউইচ বিক্রিও বন্ধ করে। নিষিদ্ধ হয় ওয়াইন ও বিয়ার। চা পাওয়ার সুযোগ রইল, তবে সেটা ওটের দুধ কিংবা সয়া দুধে তৈরি। এভাবে ২০১৫ সালে এসে ম্যাচের দিনের খাদ্যতালিকা থেকে গরুর দুধও বাদ দেয়। ফলে ডায়েটের দিক থেকে প্রথম ভেগান ফুটবল ক্লাব হিসেবে নিজেদের নাম লেখায় ইতিহাসের পাতায়। ফলও হয়েছে চমৎকার। ক্লাবের ১২৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের পেশাদার লিগের প্রথম ধাপ লিগ টু তথা তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়।
এই প্রয়াস ক্লাবের চেয়ারম্যান গ্রিন এনার্জি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট ডেল ভিন্সের ভাবনা থেকেই এসেছে। যিনি নিজেও একজন ভেগান।
‘ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স’ ক্লাবটিকে মহল্লার ফুটবল দল বললেও অত্যুক্তি হবে না। লন্ডন থেকে ১০৭ মাইল দূরে ১০ হাজারের কম অধিবাসী নিয়ে গড়ে ওঠা গ্লুস্টারশায়ারের বিভাগের নেইলসওয়ার্থ এলাকার স্থানীয় ক্লাব এটি। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৯ সালে। ইংল্যান্ডের প্রাচীন এই ক্লাব ১৯৯৭-৯৮ সালের ফুটবল মৌসুম পর্যন্ত স্থানীয় ও আঞ্চলিক লিগগুলোতে অংশ নিয়ে আসছিল। ওই বছর তারা প্রথমবারের মতো গ্লুস্টারশায়ারের কনফারেন্স ফুটবল লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ভালো-মন্দের মিশ্র ফল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছিল তাদের। ২০০৯-১০ সালে আর্থিক সংকটের কারণে কিছু অনিয়মের দায়ে লিগ থেকে বহিষ্কৃত হয় ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স। এই বহিষ্কারাদেশ যেন শাপে বর হয়েই আসে ক্লাবটির জন্য। ২০১০ সালে ফরেস্ট গ্রিন রোভার্সের প্রায় পুরো মালিকানাই কিনে নেয় পরিবেশবাদী ব্যবসায়ী ইকোট্রিসিটির মালিক ডেল ভিন্স। পরে চেয়ারম্যান হয়ে তিনি ক্লাবটির খোলনলচে বদলে দেন।
ডেল ভিন্সের উত্থানও অনেকটা গল্পের মতো। জন্ম ১৯৬১ সালে। হিপিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বখে যাওয়াদের দলে নাম লেখানোর দায়ে মাত্র পনেরো বছর বয়সে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন ভিন্স। কখনো আর স্কুলমুখী হননি তিনি, বরং হিপি মতবাদকে মেনে নিয়ে নিউ এজ ট্রাভেলার্সদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে থাকেন যাযাবরের মতো- দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। সেনাবাহিনীর পুরোনো একটি বড় ভ্যানে ছিল তার বসবাস। সেখানে নিজের ব্যবহারের জন্য তৈরি করে নেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ বিক্রির কথা ভাবেন। তখন মাত্র একটি উইন্ড টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবসা শুরু করে ডেল ভিন্স এখন ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের মালিক। স্বপ্নবাজ ও উদ্যোগী এই মানুষটির কল্যাণে ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স ক্লাবটিকে নিয়ে আজ এত আলোচনা।
ডেল ভিন্স ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়ার পর শুধু যে খাবারের ডায়েট পরিবর্তন করে ভেগান বানিয়েছেন ক্লাবকে, তা কিন্তু নয়। ক্লাবের স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয়েছে ‘দ্য নিউ লন’। সেখানে ৫ হাজার ১৪০ জন দর্শক একসঙ্গে খেলা দেখতে পারেন। আদতে ছোট, কিন্তু পুরো স্টেডিয়ামকে বানানো হয়েছে অকৃত্রিম আর প্রাকৃতিক। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য স্টেডিয়ামের ছাদে বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল। মাঠ পরিচর্যায় চালু করা হয়েছে বিদ্যুৎভিত্তিক জিপিএস চালিত স্বয়ংক্রিয় ঘাস কাটার যন্ত্র মোবট। পৃথিবীর প্রথম ক্লাব হিসেবে ফুটবল দলটি স্থাপন করে অরগানিক পিচ। মাঠের ঘাসে দেওয়া হয় না কোনো ওষুধ কিংবা পোকার বিষ। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের পানির চাহিদা প্রাকৃতিক উৎস থেকেই মিটিয়ে নেওয়া হয়। স্টেডিয়ামের বাইরে ইলেকট্রনিক গাড়ি চার্জিংয়ের জন্য আছে নিজস্ব ও আলাদা স্টেশন। এত উদ্যোগের পরেই না ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ফরেস্ট গ্রিন ক্লাব পৃথিবীর প্রথম ভেগান ক্লাব হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ইতিমধ্যে একে ওয়ার্ল্ড গ্রিনেস্ট ফুটবল ক্লাব হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছে।
২০১৮-১৯ ফুটবল মৌসুমে ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স যাবে নিজেদের নতুন স্টেডিয়ামে। এটাও চমৎকার। পুরো স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে কাঠ দিয়ে। ডেল ভিন্সের দাবি, ‘আমাদের এই স্টেডিয়ামই বিশ্বের প্রথম কাঠের তৈরি স্টেডিয়াম। এমনটি বিশ্বের আর কোথাও নেই।’ এক শ একর জায়গাজুড়ে ইকোপার্কের ঠিক মাঝখানে নির্মিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব স্টেডিয়ামটি। খরচ হয়েছে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। শুধু বাইরের আবরণই নয়, স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরীণ সবকিছুই কাঠের তৈরি। ডেল ভিন্স বলেন, শুধু ফুটবল খেলার জন্যই স্টেডিয়ামটি তৈরি হয়নি, স্থানীয় লোকদের ব্যবহারের জন্য ধীরে ধীরে এটি উন্মুক্ত করা হবে। ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি স্টেডিয়াম থেকে অনেক কার্বন নিঃসৃত হয়, কিন্তু কাঠের এই স্টেডিয়াম থেকে তা হবে না। ডেল ভিন্সের উদ্যোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, ফরেস্ট গ্রিন রোভার্স আর ডেল ভিন্সের সাফল্য সে-প্রমাণই দেয়।

 শুভ্র মিসির
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top