skip to Main Content
পোড়া ব্যঞ্জন

ওই রাস্তাটি জুড়েই ভাজা মাংসের সুগন্ধ। দূর থেকেই মানুষের ভিড়ভাট্টা দেখা যায়। সামনে গেলে সবচেয়ে সাহসী লোকটিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতে পারেন। রিকশায় যান কিংবা হেঁটে, ও পথে পা রাখামাত্রই তিন-চারজন আপনার দিকে ধেয়ে আসবে। ঘাবড়াবেন না যেন। এসে বলবে, ‘কী খাবেন স্যার? গরুর চাপ আছে, খাসির চাপ আছে, বটি কাবাব, ক্ষিরি কাবাব, শামী কাবাব আছে…।’ ওরা বেয়ারা। নিজ কাবাব ঘরে খদ্দের টানার উদ্দেশ্যেই ছুটে আসে। নিজ পছন্দমতো একটাতে ঢুকে পড়ুন। জায়গাটি মোহাম্মদপুরস্থ শাহজাহান রোডের জেনেভা ক্যাম্প। মুরসালিন, মোস্তাকিম, মুসলিম, রহিম নাম নিয়ে এক সারিতে বেশ কটি কাবাব ঘর রয়েছে সেখানে। যত কাছে যাবেন, চাপ ও কাবাবের সুগন্ধে নাক তাতিয়ে জিভ লকলকিয়ে উঠবে। বড় কড়াইতে ডুবো তেলে ছাড়া হচ্ছে মাংসের বিভিন্ন পদ। উঠিয়ে পাশে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে কিংবা সরাসরি চলে যাচ্ছে খদ্দেরের টেবিলে। দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। বসে পড়লাম রহিম কাবাব ঘরে। খানিক বাদে একজন মেনু কার্ড নিয়ে এলো। এত এত পদ দেখে মাথা গুলিয়ে যাবার উপক্রম। ধুর! আবার উঠে চলে গেলাম চুলার কাছে। চোখে যেটা ভালো লাগবে সেটাই অর্ডার করবো। হায় রে পোড়া চোখ! কোনোটিকেই অগ্রাহ্য করার জো নেই। গরুর মগজ ফ্রাই, চাপ, চিকেন ফ্রাই, কিছু টিকিয়া ও লুচির অর্ডার করে ফিরে এলাম আগের টেবিলেই। শুরু হলো সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়, যার নাম অপেক্ষা। কিছুক্ষণ পরে একটা ডিশ এলো। সসের মধ্যে শসা ডোবানো স্যালাড। পরপরই এলো চিকেন ফ্রাই, গরুর মগজ ফ্রাই, গরুর চাপ, কিছু টিকিয়া ও লুচি। তর সইতে না পেরে যেই এক টুকরা গরুর চাপ হাতে তুলে নিয়েছি অমনি খেলাম ছ্যাঁকা। এতটা গরম বুঝতে পারিনি। ফুঁ-ফাঁ দিয়ে ছোট এক টুকরা মগজ ফ্রাই মুখে দিতেই মনে হলো, এ শুধু একটি খাদ্যই নয়, যেন মন্ত্র মিশ্রিত রসনা। বুঝলাম এই মন্ত্রেই বশীভূত হতেই ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভোজনবিলাসীরা। সসে বিট লবণ ছিটিয়ে আরেকটু স্বাদ বাড়িয়ে, তা দিয়ে ধীরে ধীরে খেতে শুরু করলাম বাদবাকি পদগুলো। ঘণ্টাখানেক লাগিয়ে আয়েশ করে ভোজনের পর আলাপ জমালাম কাবাব ঘরের মালিকের সঙ্গে। নাম মো. হাবিব। চাচার নাম রহিম। চাচার নামেই দোকানের নামকরণ। কাবাব ঘরের বয়স ৫ বছর। অনেক কথাই বললেন, কিন্তু কাবাবের স্বাদের পেছনে লুকিয়ে থাকা গোপন মসলার প্রশ্নে মুখ খুলতে নারাজ তিনি। বুঝলাম এটা ‘বিজনেস সিক্রেট’। এখানকার প্রতিটি কাবাব ঘরের মালিক নিজ নিজ সিক্রেট রক্ষা করে চলেন।

মিরপুরেও আছে এ রীতি। মিরপুর সেকশন ১১, বেনারসি পল্লি, ঢালের পাড় মসজিদ-সংলগ্ন মিল্লাত ক্যাম্পেও রয়েছে এ ঘরানার বেশ কটি কাবাবের দোকান। তবে এখানের আর মোহাম্মদপুরের কাবাবের প্রধান পার্থক্য হলো, এখানকার পদগুলো সরাসরি কয়লার তাপে ঝলসানো এবং মোহাম্মদপুরেরগুলো তেলে ভাজা। এ পোড়া ব্যঞ্জনের লোভেও শহরবাসী যথারীতি ছুটে আসেন মিরপুরে। কয়লার চুলার পাশে বসে আইয়ুব আলী খান নামের এক লোক ২২ বছর ধরে কাবাব পোড়াচ্ছেন। সামনে যেতেই চুলার গরম ভাপ এসে লাগল। তাঁর কাবাব ঘরের নাম গরীবুল্লাহ শাহ। প্রচণ্ড ভিড়, কথা বলা দায়। কাবাব বলতে এখানে সবই শিক কাবাব। ক্ষিরি, বট, তিল্লি ও মাংসে মসলা মাখিয়ে শিকে গেঁথে সরাসরি কয়লার তাপে। বাড়তি পদ বলতে আছে মসলা মাখানো সেদ্ধ আলু। খাবার আরও মুখরোচক হয় তেঁতুলের টকের সংযোগে। পায়ের ওপর পা তুলে মনোযোগ সহকারে এক ভদ্রলোককে গরীবুল্লাহর কাবাব খেতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘খেতে কেমন?’ উত্তর এলো- ‘খেয়েই দেখেন।’ নিলাম এক প্লেট। শিক থেকে খুলে সব পদের কাবাব, আলু ও তেঁতুলের টক একসঙ্গে পরিবেশন করা হলো। সঙ্গে কাঁটাচামচ। প্রথমে তিল্লিতে কামড় বসিয়েই বুঝতে পারলাম, এই কাবাব সম্পর্কে যে নামডাক শুনেছি, তা এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। শুধু গরীবুল্লাহই নয়, মিল্লাত ক্যাম্পে গড়ে ওঠা প্রতিটি কাবাব ঘরই নিজ নিজ স্বকীয়তা ও স্বাদে একে অপরের প্রতিযোগী। কাল্লু মামার চাপ কিংবা জুম্মনের চাপ- যারা এই নামগুলো শুনেছেন এবং সেখানে খেয়েছেন, তাদের কাছে এদের চাপ ও কাবাবের স্বাদ বর্ণনা করাটাই বাহুল্য। এককথায় বলা যায়, মিরপুরের কাবাব জিন্দাবাদ। একটি দোকান সম্পর্কে না বললেই নয়। দোকানের নাম ‘ভাইগ্না ডিম চপ ঘর।’ গরিবুল্লাহর পাশেই এটি। ডিম দিয়ে সব পদ তৈরি করা হলেও এখানকার একটি বিশেষ পদ হচ্ছে ‘ডিম কাবাব’। গরুর কাবাবের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে ডিম মিশিয়ে তাতে প্রায় ২৪ প্রকার মসলা মাখিয়ে পরিবেশন করা হয়। ইচ্ছা হলে কোনো একদিন ঢুঁ মেরে আসতে পারেন ঢাকার এসব খাবারের আস্তানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top