skip to Main Content
Manto
Manto
Manto

উর্দু সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বলিউডের চলচ্চিত্রী নন্দিতা দাস। ২০১৭ সালে কান ফেস্টিভ্যালে সেই ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। ছবিটি আগামী ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। একইভাবে ২০১৫ সালে পাকিস্তানের পরিচালক ও অভিনেতা সারমাদ খুসেত ‘মান্টো’ নামে ছবি বানিয়েছেন। সেই ছবিও নানা মহলে বহুল প্রশংসিত। এই দুই ‘মান্টো’ হয়ে উঠেছে দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চলচ্চিত্রজগতের সুস্থ এক প্রতিযোগিতার মাধ্যম। যা সীমান্তযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতা থেকে শতগুণে সদর্থক। এই বিষয়ে লিখেছেন অতনু সিংহ।

 

১৯৪৭-এ ভারত ভাগের নামে আসলে ভাগ করা হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে। এই ভাগাভাগির ফলে লাখ লাখ বাঙালি আর পাঞ্জাবিকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল তার ভূমি থেকে, তার যাপনক্ষেত্র থেকে, অর্থনীতি থেকে, বন্ধু-পরিজন-আত্মীয়দের বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হয়েছিল এক কেন্দ্র থেকে অন্য প্রান্তে। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এই দেশভাগের বেদনাকে নানা সময়েই তাঁদের শিল্পকর্মে ব্যক্ত করেছেন। বাস্তু ও যাপনচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণের প্রতিচ্ছবি নানা সময়েই মূর্ত হয়েছে বহু শিল্প ও সাহিত্যকর্মে। এ সবকিছুর মধ্যে বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিককুমার ঘটক আর পাঞ্জাবের উর্দুভাষী সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর চলচ্চিত্র ও কথাসাহিত্য উল্লেখযোগ্য। তাঁদের নিয়ে উপমহাদেশের মানুষের চর্চা ও আগ্রহ আজও যথেষ্ট পরিমাণেই…
উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টো, তাঁর লেখাজীবন, রাজনৈতিক ভাবনা ও যাপনচিত্র বাববার ফুটে উঠেছে নানা লেখায়, নাটকে এমনকি চলচ্চিত্রেও। এই মান্টো ভারত-পাক দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রেই সমানভাবে চর্চিত ও আলোচিত। শুধু তা-ই নয়, দুই বাংলাতেও মান্টোকে নিয়ে সাহিত্যজগতের সমান আগ্রহ। তো এই মান্টোর জীবনকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন বলিউডের পরিচালক ও অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। কিন্তু নন্দিতাই প্রথম নন, ২০১৫ সালে মান্টোর মৃত্যুর ষাট বছর পূর্তিতে তাঁর স্মরণে ফিল্ম বানিয়েছেন পাকিস্তানের করাচির বিখ্যাত অভিনেতা সারমাদ খুসেত। তার আগে পাকিস্তানি টেলিভিশনেও মান্টোর ওপর টিভি সিরিজ সম্প্রচারিত হয়।
২০১৫ সালে তৈরি হওয়া ‘মান্টো’ ছবিটি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিশ্বের বহু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেই প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। এখন, চলচ্চিত্র মহলে ও দর্শকদের একাংশের কাছে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে তৈরি হওয়া দুটি ছবির মধ্যে তুল্যমূল্য আলাপ-আলোচনা ও চর্চা শুরু হয়েছে। বলা যেতে পারে, বলিউড ও লাহোর-করাচির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে মান্টোকে কেন্দ্র করেই একে অন্যকে বুঝে নেওয়ার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তবে, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে মান্টো ভার্সেস মান্টো কম্পিটিশন, সীমান্ত যুদ্ধের হিংসাত্মক রাষ্ট্রবাদী আস্ফালনের চেয়ে শতগুণে সুন্দর এক সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। অনেকেরই এমনটা মত।
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অভিনীত নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’র চিত্রনাট্য অনেকটাই ইতিহাস এবং মান্টোর জীবনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বাস্তবতার পোস্টমর্টেম। জাতিসত্তার দিক থেকে কাশ্মীরি, জন্ম, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের একটা সময়ের যাপনের দিক থেকে পাঞ্জাবের মানুষ ও জীবনের বড় একটা সময়ে তৎকালীন বোম্বাই শহরে যাপন করা কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার সাদত হাসান মান্টোর বোম্বাইয়ের দিনযাপন, ব্রিটিশবিরোধী বাম আন্দোলনের সঙ্গে একজন সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সম্পৃক্ত হওয়া, বামপন্থী নারীবাদী উর্দু সাহিত্যিক ইসমত চুঘতাইয়ের সঙ্গে সখ্য, অভিনেতা-পরিচালক ও প্রযোজক অশোক কুমারের সঙ্গে বন্ধুতা ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এ দ্বিখণ্ডিত ভারত- এ সবকিছু আছে এই ছবিতে। জন্মসূত্রে মুসলিম কিন্তু যাপনে নন-প্র্যাকটিসিং এবং বামপন্থী সাহিত্যিক মান্টোকেও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মুখে শুনতে হয়েছিল, ‘তুমি মুসলিম তাই তোমায় খুন করতে পারি…’ এরপর বোম্বে ও লুধিয়ানা ছেড়ে লাহোর ও করাচিতে চলে যাওয়া মান্টোর জীবন, তাঁর যাপনসঙ্গিনী সোফিয়া মান্টোর সঙ্গে দিন গুজরান, লাহোর ও করাচির দিন, সেখানেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁর ক্রমাগত প্রান্ত থেকে আরও প্রান্তিক হয়ে যাওয়া, মদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, উন্মাদনা ও মানসিক হাসপাতালে দিনযাপন- সবকিছুই রয়েছে নন্দিতা দাসের ছবিতে।
অন্যদিকে, ২০১৫ সালে পাকিস্তানে তৈরি হওয়া ‘মান্টো’য় সাদত হাসানের জীবনের এসব ঘটনার পাশাপাশি মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর নানান ছোটগল্প। যেমন ‘ঠান্ডা গোস্ত’, ‘রাজাকার’, ‘টোবা তেক সিং’, ‘লাইসেন্স’, ‘উপর, নীচে অউর দরমিয়া’, ‘পেশোয়ার সে লাহোর’ ইত্যাদি গল্প ও সেগুলোর চরিত্ররা সারমাদ খুসেত পরিচালিত ‘মান্টো’ ছবিতে মান্টো ও তাঁর জীবনের সঙ্গে আলাপ চালিয়েছে। ইতিহাস ও তার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিশে গেছে মান্টোর গল্পের চরিত্রগুলো, সেই সব চরিত্র মান্টোর অন্তর্জগৎকে তুলে ধরেছিল ওই ছবিতে।
চমৎকার চিত্রনাট্য, অভিনয়, সংগীত, সিনেমাটোগ্রাফি-এডিটিং-কস্টিউম-মেকআপে সারমাদ খুসেত পরিচালিত ও অভিনীত ‘মান্টো’ চলচ্চিত্রভাষার বলিষ্ঠ প্রকাশ। এখন দেখার, নন্দিতা দাস এ সবকিছুতে বিশেষ কী কী করে উঠতে পারেন। দুই ‘মান্টো’কে ঘিরে প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। তবে ভ্রান্ত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’র রেশ বহন করে আজও যেভাবে ভারত-পাক রাষ্ট্রদ্বয় নিজেদের মধ্যে হিংসার আবহ বজায় রেখেছে, সীমানাহীন মান্টো বোধ হয় এই আবহ বদলানোর জন্য বারবার ছবিতে উঠে আসছে একেক অ্যাপ্রোচে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top