দেহযতন I প্রভাত প্রস্তুতি
মর্নিং এক্সারসাইজ রুটিন দিয়ে দিন শুরু করা গেলে দারুণ হয়! তাতে দিনের শুরুটা যেমন তাড়াতাড়ি হয়, তেমনি সারা দিন মন-মানসিকতায় ইতিবাচকতা বজায় থাকার সম্ভাবনা বাড়ে
সারা দিনের কাজ শেষ করে জিমে যাওয়ার সময় সবার থাকে না। তবে কর্মব্যস্ত দীর্ঘদিনের আগে বিছানা থেকে উঠতে এবং সকালের ওয়ার্কআউটে নিজেকে চাপ দিতে অনুপ্রাণিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে একজন মানুষ অনেকটাই হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য! সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছাড়ার প্রেরণা পাওয়া গেলে, মর্নিং এক্সারসাইজ রুটিনে অবিশ্বাস্য সুবিধা উপভোগ করা যায়। আর তা সত্যিই সারা দিনের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি সেট করে দিতে পারে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
সার্টিফাইড ফিটনেস ট্রেইনার সাদিয়া শিলার মতে, একজন ব্যক্তিমানুষের সময়সূচি ও পছন্দের ওপর নির্ভর করে, তার সকালের ওয়ার্কআউট পরিকল্পনা কেমন হবে। অথবা নিজের সকালকে জাম্প স্টার্ট বাড়িতেই সম্পন্ন করা সম্ভবÑ এমন একটি ঝটপট ওয়ার্কআউট প্ল্যান ঠিক করে নিতে পারেন; যেন সেটি শেষ করে দিনের কাজে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন।
সকালের শরীরচর্চা প্রতিদিনের রুটিনের জন্য তৈরি করা যেতে পারে। ধরুন, ব্যাপারটি যদি এমন হয়, আপনাকে সারা দিন চেয়ারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হবে, তাহলে সেদিনের ব্যায়ামের ক্ষেত্রে পায়ের ওপর ফোকাস করাই শ্রেয়। আর যদি সারা দিন দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়? তবে ফোকাস করা চাই পেলভিস, পিঠের নিচের অংশ, নিতম্ব ও পেটে। প্রাত্যহিক রুটিনে ওজন উত্তোলন-সম্পর্কিত কাজ থাকলে সকালের ওয়ার্কআউটে কার্ডিও এক্সারসাইজ বেশি করা চাই; বিপরীতে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং কম করতে হবে।
সুবিধা শরীরে
সকালে বিছানা ছাড়তে আলসেমি? অ্যালার্ম ক্লক রিসেট করতে ভুলে যান? সাদিয়া শিলার মতে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই! কিন্তু আমরা যখন সকালের ওয়ার্কআউটের কিছু চমৎকার সুবিধা উপভোগ করি, তখন এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়।
শক্তি স্তর বর্ধন: সকালে ওয়ার্কআউট করলে দেহে এন্ডোরফিন নিঃসৃত হয়, যা সারা দিন আরও বেশি শক্তি অনুভব করতে সহায়ক। এন্ডোরফিন নিঃসরণ মুড বুস্টিং এবং ব্যথা উপশমকারী প্রভাব ফেলে। জোগায় সারা দিন সতেজ থাকার মতো প্রাকৃতিক শক্তি। অত্যধিক ক্যাফেইন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়।
মেটাবলিজম বৃদ্ধি: ওয়ার্কআউটের একটি ইতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো ইপিওসি [এক্সেস পোস্ট-এক্সারসাইজ অক্সিজেন কনজাম্পশন] বা ব্যায়াম-পরবর্তী অক্সিজেন গ্রহণ। নতুন শোনাচ্ছে? এর মানে সকালের ব্যায়াম আপনার বিপাককেও কিক-স্টার্ট করাতে পারে; সারা দিনে আরও ক্যালরি পোড়াতে সাহায্য করে। তাই আপনি দক্ষতার সঙ্গে শক্তি ব্যবহার করতে এবং দিনভর শরীরকে সক্রিয় রাখতে পারবেন।
ভালো ঘুম: অনেকে শোয়ার ঠিক আগেই কঠোর ওয়ার্কআউট করেন, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। তাই নিজের শরীরের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক দেহচর্চা বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সাদিয়া শিলার মতে, নিয়মিত মর্নিং এক্সারসাইজ আপনার সার্কেডিয়ান ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে, চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করবে। এতে ঘুমের মান উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
মনোনিবেশ ও উৎপাদনশীলতায় উন্নতি: ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে মানসিক স্বচ্ছতা ও সতর্কতা বোধের বৃদ্ধি ঘটায়, যা সারা দিন মনোযোগ ধরে রাখতে কাজে দেয়। অন্যদিকে, ওয়ার্কআউটের মাধ্যমে দিন শুরু করা গেলে ব্যক্তিমানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, যা পরে কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
জিমের জাদু: সকালে বাড়ি থেকে বের হতে পারলে বেশ হয়। এ সময়ে জিমগুলো সাধারণত ফাঁকা থাকে। তাই একেবারেই ফাঁকা কিংবা কম সদস্যপূর্ণ জিমে ওয়ার্কআউট করার সৌভাগ্য পেতে পারেন, যা আরও শান্তিপূর্ণ ও দক্ষতার সঙ্গে শরীরচর্চা করতে সহায়ক।
ভিটামিন ডি এক্সপোজার: সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ওয়ার্কআউট করার একটি বাড়তি সুবিধা রয়েছে। কারণ, এতে প্রাকৃতিক সূর্যালোকের এক্সপোজার পাওয়া যায়। এটি শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হতে সাহায্য করে, যা হাড়ের স্বাস্থ্য ও ইমিউন ফাংশনের জন্য অপরিহার্য।
দক্ষতা বৃদ্ধি: সকালের ওয়ার্কআউট মানে প্রথমে করণীয় তালিকা থেকে ব্যায়াম সেরে নেওয়া। ফলে মনে হবে সব অর্জন ও সম্ভাবনা বাকি দিনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
মনের যতনে
মর্নিং এক্সারসাইজে শারীরিক সুবিধার পাশাপাশি কিছু মনস্তাত্ত্বিক সুবিধাও রয়েছে:
মেজাজে উন্নতি: আগেই যেমনটা বলেছি, এন্ডোরফিন নিঃসরণের ফলে মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠা কমে আসে; মেজাজ উন্নত করে এবং সামগ্রিক মানসিক সুস্থতা বাড়ে। তার মানে, সকালে ব্যায়াম করার অর্থ হলো, এসব মেজাজ বুস্টার আপনি দিনভর উপভোগ করতে পারবেন।
ধারাবাহিকতা: এ সময়ে ওয়ার্কআউট একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ রুটিন স্থাপন করতে সাহায্য করে, পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবেও কাজে দেয়। আপনি যদি প্রতিদিন একই সময়ে ব্যায়াম করতে পারেন, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: প্রভাতে দেহচর্চা একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। এর মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
ঘুম তাড়িয়ে
ঘুম থেকে ওঠার আলসেমি কাটানোর এবং মর্নিং এক্সারসাইজ শুরু করার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সাদিয়া শিলা:
রাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানায় যান এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
একটি অ্যালার্ম সেট করুন এবং সেটিকে স্নুজ করবেন না, এমনকি সপ্তাহান্তেও।
সংক্ষিপ্ত ও সহজ ওয়ার্কআউট দিয়ে শুরু করুন; ধীরে ধীরে, সময়ের সঙ্গে ওয়ার্কআউটের সময়ব্যাপ্তি ও তীব্রতা বাড়ান।
ওয়ার্কআউটের আগে, চলাকালীন এবং পরে পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
ওয়ার্কআউটের আগে হালকা নাশতা গ্রহণ করুন, যেমন একটি কলা বা চিনাবাদাম মাখনের সঙ্গে গমের টোস্ট।
জিমে যেতে চাইলে, অনুপ্রাণিত থাকতে সাহায্য করার জন্য একজন ওয়ার্কআউট পার্টনার খুঁজে নিন অথবা ফিটনেস ক্লাসে যোগ দিন।
৩০ মিনিট প্যাক
মর্নিং এক্সারসাইজের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩০ মিনিটের রুটিন প্ল্যান করে নিতে পারেন। এ বিষয়ে সাদিয়া শিলার দিকনির্দেশনা:
ওয়ার্মআপ
ওয়ার্মআপ না করে ওয়ার্কআউটে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না! শরীরকে গতিশীল করতে পাঁচ মিনিট সময় নিন। শুরু করুন কাঁধের রোল এবং বাহুকে উইন্ডমিল অথবা আর্ম সার্কেল করার মধ্য দিয়ে। তারপর লেগ সুইং এবং গোড়ালি সার্কেলে যান। এরপর এক জায়গায় হাঁটুন। জাম্পিং জ্যাক ও বাট কিকারের সাহায্যে হার্ট রেট বাড়িয়ে নিন। সবশেষে, পাশে শরীর বাঁকানোর মাধ্যমে আপনার ওয়ার্মআপ শেষ করুন।
ওয়ার্কআউট
পরবর্তী ২০ মিনিটের জন্য যতবার সম্ভব নিচে বর্ণিত রুটিনটি সম্পাদন করুন। যখনই প্রয়োজন হবে, বিরতি নিন।
পুশআপ দিয়ে শুরু করুন। শরীরের ওজন ও শক্তির দিকে খেয়াল রাখুন। পুশআপগুলো বুক, বাহু ও অ্যাবসের জন্য উপকারী। শুরুর দিকে ১০ থেকে ১৫টি পুশআপের চেষ্টা করুন!
এরপর ৩০ সেকেন্ডের জন্য কয়েকবার স্টার জাম্প করুন।
এবার পা ও কাঁধ সামনের দিকে ছড়িয়ে দিন এবং ১০ বার বডিওয়েট স্কোয়াট করুন। ৩০ সেকেন্ডের জন্য বিরতি নিন এবং আরও ১০ বার পুনরাবৃত্তি করুন। আপনার পা, গ্লুটস ও কোরে এটি অনুভব করা চাই।
এখন সময় হয়েছে কিছু বার্পি করার। এটি সবার প্রিয় ব্যায়াম না-ও হতে পারে; তবে বার্পি আপনার পুরো শরীরের জন্য দুর্দান্ত উপায়। তাই ১০ বার পুনরাবৃত্তির চেষ্টা করুন।
এবার লাং ট্রাই করুন। প্রতি পায়ের ওপর ভর করে ১০ বার চেষ্টা করুন। এটি সাধারণত লাং হ্যামস্ট্রিং, কোয়াডস, গ্লুটস ও কোরকে লক্ষ্য করে করা হয়। একটু বাড়তি চ্যালেঞ্জের জন্য এক জোড়া লাইটওয়েট ডাম্বেলের সঙ্গে লাং এক্সারসাইজ করুন।
বাহু ও কাঁধের ওপর জোর দিয়ে কোরকে শক্তিশালী করতে কার্ডিও রুটিনে কিছু বিয়ার ক্রল যোগ করুন। পুশআপ অবস্থানে বিয়ার ক্রলে ১০ সেকেন্ডের জন্য সামনে এবং তারপর ১০ সেকেন্ডের জন্য পেছনে যান।
৩০ সেকেন্ডের জন্য প্লাঙ্ক করার চেষ্টা করুন। এর মাধ্যমেই শেষ টানতে পারেন ৩০ মিনিটের ওয়ার্কআউট।
সকালে ব্যায়াম করা সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে। কিন্তু ঘটনা হলো, ব্যায়াম করার জন্য সর্বোত্তম সময় ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। তাই সাদিয়া শিলার পরামর্শ হলো, যদি সকালে ব্যায়াম করা অসম্ভব মনে হয়, তাহলে জোর করার দরকার নেই। সন্ধ্যায় ওয়ার্কআউটেরও অনেক সুবিধা রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় খুঁজে বের করা, যা আপনার জন্য শ্রেয়। তারপর ওই নির্দিষ্ট সময় বজায় রেখে লেগে থাকুন। মনে রাখা চাই, ধারাবাহিকতা সকল সাফল্যের মূল!
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট