skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I বিটলস ও বালিশ-যুদ্ধ

১৯ জানুয়ারি ১৯৬৪। রাত ৩টা। এক রুমে চার তরুণ। বন্ধু তারা। শিশুদের মতো খুনসুটিতে মেরে উঠলেন বালিশ নিয়ে। সেই ধুন্ধুমার পিলো ফাইটের দৃশ্য রক মিউজিক ইতিহাসে এক আইকনিক ফটোগ্রাফি হিসেবে গণ্য এখনো।
ঘটনাস্থল ফ্রান্সের প্যারিস। সেখানে কনসার্ট করতে হাজির দুনিয়াজুড়ে নতুন সংগীতের জোয়ার বইয়ে দিতে উন্মুখ ব্রিটিশ রক ব্যান্ড দ্য বিটলস। অনুরাগীদের কাছে এর চার সদস্য পরবর্তীকালে ফ্যাব-ফোর নামে খ্যাত হয়েছিলেন। বলছি কিংবদন্তি জন লেনন [১৯৪০-১৯৮০], পল ম্যাককার্টনি [১৯৪২-], জর্জ হ্যারিসন [১৯৪৩-২০০১] ও রিঙ্গো স্টারের [১৯৪০-] কথা। প্যারিসের দ্য অলিম্পিয়া কনসার্ট ভেন্যুতে পারফর্ম শেষে হোটেল জর্জ ফাইভে নিজেদের স্যুটে ফিরে যখন তারা বিশ্রামরত, তখনকারই একটি স্থিরচিত্র এটি। দ্য বিটলস সদস্যরা তখন গ্রুপ লিডার লেননের রুমে। সঙ্গে এক অতিথি। তিনি স্কটিশ ফটোগ্রাফার হ্যারি বেনসন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি এক্সপ্রেসের ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে যার কর্মভার ছিল ব্যান্ডটির ছবি তোলা। আর তা করতে করতে ফ্যাব-ফোরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার। তবে সেসব পরের কথা। সেই বন্ধুত্ব গড়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রেখেছিল এই ছবি।
শুরুতে অবশ্য ছবিটি তোলার দায়িত্ব হ্যারির ছিল না; বরং উগান্ডার ওপর বড় একটি স্টোরি করার জন্য তাকে পাঠিয়েছিল ডেইলি এক্সপ্রেস। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে তাকে ফোন করে জানানো হয়, তিনি যেন এক ফাঁকে প্যারিসে দ্য বিটলসের ওপর ফটোগ্রাফি করেন। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণায় হ্যারি বেনসন বলেছেন, ‘নিজেকে একজন সিরিয়াস জার্নালিস্ট হিসেবেই গণ্য করতাম। তাই কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটি আমার কাজ নয়। দ্য বিটলস কারাÑ আমার তা জানা ছিল ঠিকই, তবে এটি কিন্তু ১৯৬৪ সালের শুরুর দিকের কথা; তখনো তারা সত্যিকারের বড় ধরনের ব্রেকথ্রু পায়নি। আসলে তাদের ঘিরে ঘোরার কোনো আগ্রহ ছিল না আমার।’
কথা সত্যি! দ্য বিটলসের নামডাক তখন এর জন্মস্থল যুক্তরাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে মাত্র ছড়াতে শুরু করেছে। মিউজিক দুনিয়া বিটলম্যানিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তখন কেবলই সূচনালগ্ন বলা চলে।
অফিসে অ্যাসাইনমেন্টটি ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানোর পাঁচ মিনিট পর হ্যারির কাছে এলো একটি বিশেষ ফোনকল। স্বয়ং সম্পাদকের কাছ থেকে। নির্দেশ এলো, ভালো লাগুক বা না লাগুক, দ্য বিটলসের ছবি তাকে তুলতেই হবে। এমন কড়া নির্দেশ পেয়ে তিনি ছুটে গেলেন প্যারিস মহানগরের ফন্টেনব্লু অঞ্চলে, যেখানে আসন্ন কনসার্টটির আগে ওয়ার্ম-আপ করছিলেন ব্যান্ড সদস্যরা। হ্যারির ভাষ্য, ‘আমি আমার ক্যামেরার ফ্ল্যাশের একটি এক্সটেনশন আনার জন্য নিজের গাড়ির কাছে গেলাম, আর যখন ফিরে এলাম, তখন তারা “অল মাই লাভিং” গানটি পারফর্ম করছিলেন। তাতে মুহূর্তেই দারুণ এক সংবেদনজাগানিয়া আবহ ছড়িয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম, “হায় প্রভু! এটিই তো ব্রেকথ্রু!” আর এভাবেই একটি মিউজিক স্টোরি পরিণত হলো নিউজ স্টোরিতে।’
তারপর থেকেই ফ্যাব-ফোরের সঙ্গে ভাব জমাতে শুরু করেন এই আলোকচিত্রী। গড়ে তোলেন বন্ধুত্ব। সেই সূত্রে ওই রাতে তিনি যখন হোটেলটির স্যুটে ঢুকেছিলেন, ব্যান্ডের কোনো এক সদস্যের কাছ থেকে জানতে পারেন, আগের রাতে ফ্যাব-ফোরের মধ্যে দারুণ এক বালিশ-যুদ্ধ হয়ে গেছে! আর তা তাদের মধ্যে প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। এমন মুহূর্তের ছবি তোলার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করলে লেনন অবশ্য হ্যারিকে বলে দিয়েছিলেন, ‘না, আমাদের হাস্যকর দেখাবে!’ কিন্তু সেই মুহূর্তেই ম্যাককার্টনি একটি বালিশ তুলে লেননের মাথায় পেছন থেকে করে বসেন আঘাত। আর মুহূর্তেই ওই চারজনের মধ্যে লেগে যায় হুড়োহুড়ি, মজার পিলো ফাইট! সেই মুহূর্তেরই ছবি এটি।
‘লেননকে আঘাত করছিলেন ম্যাককার্টনি, লেনন আবার আঘাত করছিলেন হ্যারিসনকেÑ এই স্বতঃস্ফূর্ততাই ছবিটিকে নিখুঁত করেছে। বালিশটি তিনি মারার জন্য কীভাবে তুলে রেখেছেন, খেয়াল করুন। এটিই এই শটে ঘটিয়েছে প্রাণের সঞ্চার,’ বলেছেন হ্যারি বেনসন।
ছবি তোলার পর তিনি পড়িমরি ছুটেছিলেন হোটেলের বাথরুমে। আর, ওই বাথরুমকে নিজের ডার্করুমে করেছিলেন রূপান্তর! স্মৃতিচারণায় হ্যারি আরও বলেন, ‘টয়লেট সিটে বসেই ফিল্মের ডেভেলপ করেছিলাম আমি; অবশ্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ সঙ্গেই ছিল।’ ডেভেলপ করামাত্রই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লন্ডনে, ডেইলি এক্সপ্রেসের কার্যালয়ে। সেখান থেকে তাকে জানানো হয়েছিল, ছবি ঠিকঠাক। আর জানতে চাওয়া হয়েছিল, এরপর তিনি কোন ছবি তুলবেন। এই ছবি হ্যারিকে এতই তৃপ্তি দিয়েছিল, অফিসকে সোজা বলে দিয়েছিলেন, টানা এক মাস কোনো কাজ করবেন না; শুধুই খাওয়াদাওয়া করবেন!
‘সে রাতে যত ছবি তুলেছিলাম, ফিরে তাকালে মনে হয়, সেগুলোর যেকোনোটির পক্ষেই একজন আলোকচিত্রীকে তৃপ্ত করা সম্ভব। তবে শেষ পর্যন্ত এই ছবি আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে গেল। আর এর সূত্র ধরেই ব্যান্ডটির সঙ্গে তাদের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরে সঙ্গী হতে পেরেছিলাম আমি,’ বলেছেন হ্যারি। আরও বলেছেন, ‘জীবনে প্রচুর ছবি তুলেছি। এগুলোর মধ্যে অনেক ছবিই হয়তো আরেকবার তুলতে পারলে ভালো হতো; কেননা, তৃপ্তি পাইনি। অথচ এই ছবি কী করে এত ভালো তুললাম? কারণ জানা নেই আমার! হয়তো তখন আমার তারুণ্য ছিল বলেই।’
বলা বাহুল্য, ব্যান্ড হিসেবে দ্য বিটলস মাত্র এক দশক [১৯৬০-১৯৭০] টিকে ছিল। তারপর ধরে ভাঙন। কিন্তু এরই মধ্যে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যান্ডে পরিণত হয় এটি। এতকাল পরও রক মিউজিক সিনারিওতে ফ্যাব-ফোর নিয়ে চলে নৈমিত্তিক চর্চা। আর এই তুমুল প্রাণবন্ত চার রকস্টারের স্বপ্নযাত্রার একটি প্রবাদপ্রতিম নমুনা হয়ে আছে ‘দ্য বিটলস পিলো-ফাইটিং’খ্যাত এই আলোকচিত্র।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান; আর্ট অব ফেস অনলাইন
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top