skip to Main Content

ফিচার I আঠারোর অবেক্ষণ

বেসিকের পোক্ত বনিয়াদ বলবৎ রেখে সৌন্দর্যরীতির অদলবদল সুস্পষ্ট ২০১৮তেও। বিউটি বুকে যোগ হয়েছে নিত্যনতুন বিস্ময়। বিয়োজনের তালিকাটাও বেশ বড়। টেকনিক আর টুলের সঙ্গে পাল্টেছে প্রয়োগের সূত্র। পরিবর্তন এসেছে সৌন্দর্যসমীকরণে

সৌন্দর্যবিশ্বে স্বকীয়তাই ছিল গেল বছরের সেরা ট্রেন্ড। বলছি বেসপোক বিউটির কথা। প্রায় চার দশকের পুরোনো ধারণাটি ২০১৮তে পাল্টে দিয়েছিল সৌন্দর্যচর্চার প্রচলিত পদ্ধতি। এ ট্রেন্ডে ব্যক্তিই ব্র্যান্ড। অর্থাৎ ব্যক্তির প্রয়োজন আর চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে সব সৌন্দর্যপণ্য। ফলে বদলে গেছে মেকআপ, স্কিন আর হেয়ার কেয়ার প্রডাক্ট তৈরির ধারা। ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’-এর মতো প্রচলিত ব্ল্যাঙ্কেট বিউটি নীতির বদলে সবাই ঝুঁকেছে ‘মেইড টু মেজার’ অপশনে। অর্থাৎ ক্রেতার স্কিন টোন আর টাইপ বুঝে তৈরি হয়েছে কাস্টমাইজড ব্লেন্ডের ফাউন্ডেশন। ইনস্টোর কনসাল্টেশন ও অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বেছে দেওয়া হয়েছে শেড। কালার ম্যাচিং লিপস্টিক আর আইশ্যাডোও তৈরি হয়েছে স্টোরে বসেই। ক্রেতার সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে। এমনকি আইল্যাশ, শেপ আর পছন্দের স্টাইলের ওপর ভিত্তি করে কাস্টমাইজড ফর্মুলা এবং ব্রাশের কম্বিনেশনে তৈরি হয়েছে মাসকারা। শুধু কি মেকআপ! ত্বক আর চুলচর্চায় বেসপোক ছিল শীর্ষে। ফেস ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ত্বকের একেকটি ইঞ্চি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ স্কিন থেরাপিস্টরা বের করে আনেন প্রয়োজনীয় সব তথ্য। এগুলো মাথায় রেখেই এক্সপার্ট মিক্সোলজিস্টরা তৈরি করেন সিরামসহ ত্বকচর্চার নানা পণ্য।
২০১৮ থেকে ১৭৬ মিলিয়নের ওপর প্রডাক্টের কম্বিনেশনে সিস্টেম প্রফেশনাল ক্রেতাদের জন্য তৈরি করা শুরু করেছে চুলের বেসপোক সলিউশন। ফলে গেল বছর থেকেই সৌন্দর্যবিশ্বে প্রেসক্রাইবড প্রডাক্টের জায়গা দখল করে নিয়েছে পার্সোনালাইজড প্রডাক্ট। তাই বিউটি ব্র্যান্ডগুলোরও কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাপ্তি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ‘কালচার অব কাস্টমাইজেশন’-এর ফলে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে বেড়েছে বেসপোকের বাজার। বড় বড় বিউটি ব্র্যান্ডও ঝুঁকছে এ ট্রেন্ডে। রেগুলার কালেকশনের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে বিশেষায়িত বেসপোক বিউটি প্রডাক্ট, স্কিন আর হেয়ার কেয়ার রেঞ্জ। সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টের রমরমা তো ছিলই, আঠারোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নন-সার্জিক্যাল বিউটি ট্রিটমেন্টগুলো। কোনো রকম কাটাছেঁড়া বাদে সুন্দর হয়ে ওঠার উপায়গুলো অনায়াসেই এনে দিতে পারে অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষিত চেহারা। কার্বন ডাই-অক্সাইড লেজার রিসারফেসিং থেকে ডারমাল ফিলার, কাইবেলা, ইনটেন্স পালস লাইট আর লেজার লিফটের মতো প্রক্রিয়াগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং পরিবর্তনটা সহজেই সুস্পষ্ট হয় বলে নন-সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টে ঝুঁকেছেন অনেকেই।
অ্যান্টি-পলিউটেন্ট অর্থাৎ দূষণরোধী ত্বকচর্চার বাজারও বেড়েছে গেল বছর। বাতাস আর পানিদূষণের পাশাপাশি সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব কাটাতে সৌন্দর্যসচেতনেরা তাদের বিউটি বক্সে পুরে নিয়েছেন দূষণরোধী নানা ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ ক্লিনজার, ময়শ্চারাইজার, সেরাম, সানস্ক্রিনসহ হরেক রকম সৌন্দর্যপণ্য। সেই সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠেছে বিউটি ব্র্যান্ডগুলোও। প্রডাক্ট লাইনে যুক্ত করতে শুরু করেছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সৌন্দর্যপণ্য। রাসায়নিক ও পশুর উপজাত বাদ দিয়ে শুরু হয়েছে উদ্ভিজ্জ উপকরণে তৈরি প্রসাধনীর নতুন অধ্যায়। ত্বকের সুস্বাস্থ্য তো বটেই, প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষার জন্যও দারুণ উপকারী ভেগান স্কিন কেয়ার। সাধারণত শতভাগ প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি হয় বলে এগুলো যেকোনো ধরনের ত্বকের জন্য সহনীয়। সূর্য থেকে সুরক্ষা, বয়স রুখতে, বিবর্ণতা সারাতে সমানভাবে উপযোগী ভেগান স্কিন কেয়ার।
গেল কয় বছরে মোটামুটি কোরিয়ানদের দখলে ছিল সৌন্দর্যবিশ্ব। একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করা কোরিয়ান বিউটি স্কিন আর হেয়ার কেয়ার ট্রেন্ডের পাশাপাশি মেকআপও ছিল তুঙ্গে। সৌন্দর্যপণ্য থেকে রূপচর্চার রেজিম- সবই লুফে নিয়েছেন সৌন্দর্যসচেতনেরা। তবে আঠারোতে তাদের টক্কর দেওয়ার মতো প্রতিযোগীরা জোর প্রস্তুতি নিয়ে নেমে পড়েছেন বাজারে। যেমন জে বিউটি। প্রাকৃতিক উপাদান, বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া আর নতুনতর উদ্ভাবনী গুণে গড়ে উঠেছে জাপানি সৌন্দর্যপণ্যের বিশাল বাজার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গেল বছরই গোটা সৌন্দর্যবিশ্বে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। সেখানকার দাবি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সৌন্দর্যবিশ্বের ৪৪৫ মিলিয়নের বাজারে দাপুটে স্থান দখল করে নেবে এই অঞ্চলে তৈরি সৌন্দর্যপণ্য। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠবে মেকআপের নেক্সট হটস্পট।
সৌন্দর্যবিশ্বে সাম্প্রতিক সংযোজন প্রযুুক্তি। এটা যে একসময় ডিজিটাইজড এবং টেকফ্রেন্ডলি হয়ে উঠবে, তার আভাস ছিল অনেক আগেই। গেল বছরে সেই ধারণা আরও পোক্ত হয়। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কনজিউমার ইলেকট্রনিক ট্রেড শো সিইএসের ইভেন্টে শুধু রোবো কার আর ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটিই নয়, প্রদর্শিত হয় কসমেটিকস এবং স্কিনকেয়ার ইন্ডাস্ট্রির অনন্য সব আবিষ্কার। যেসবের মধ্যে ছিল ডিসপোজেবল ওয়্যারেবল ইউভি এক্সপোজার প্যাচ থেকে কাস্টমাইজড স্কিন সেরাম তৈরির যন্ত্র। ছিল অ্যাপবেসড ত্বকযত্নের যন্ত্র। কোনোটা হাইএন্ড ত্বকচর্চার জন্য উপযোগী, তো কোনোটা চুলচর্চায় চমৎকার। ধীরে ধীরে যা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাধারণ সৌন্দর্যসচেতনদের মধ্যেও। ঢুকে পড়ে বিউটি কেবিনেটে। যার ব্যবহারে বাসায় বসেই মিলছে স্পার মতো স্পেশালাইজড ট্রিটমেন্ট আর বিশেষায়িত সব সেবার অনুভূতি। আঙুলের এক চাপেই ত্বকের খুঁটিনাটি সব খবর ফুটে উঠছে স্মার্টফোনের পর্দায়। রূপচর্চার কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ হয়ে উঠছে সহজ আর দ্রুততর। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন গোটা সৌন্দর্যবিশ্ব কখনো আমাদের কোলে তো কখনো বুড়ো আঙুলের নিচে। বিশ্বের নামিদামি সব বিউটি এক্সপার্ট, মেকআপ আর্টিস্টরা চলে এসেছেন হাতের মুঠোয়। বেড়েছে কাজের ক্ষেত্র। ফলে মেকওভার স্যালনের চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে ইউটিউবে ভর করে বিউটি ব্লগাররা ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত। গেল বছর তাদের বদৌলতে প্রতিমুহূর্তে বাজি বদল হচ্ছে সৌন্দর্যবিশ্বের। তৈরি হয়েছে বিকল্প বাণিজ্যনকশা। ব্যক্তি পরিণত হচ্ছে ব্র্যান্ডে আর ব্র্যান্ডগুলো হয়ে উঠছে ব্যক্তিনির্ভর।
মেকআপে উল্টে গেছে প্রচলিত নিয়ম। আন্ডারলাইনার, আপসাইড ডাউন, স্মোকি আই, রিভার্স উইংগড লাইনার, রিভার্স ওমব্রে লিপ এমনকি আইল্যাশের রিভার্সও ছিল ট্রেন্ডে। শুরুটা আরও আগে হয়েছিল। কিন্তু গেল বছরই পরীক্ষামূলক থেকে এটা পরিণত হয়েছে পাকাপোক্ত ট্রেন্ডে। চোখের সাজে ইনার কর্নার প্রাধান্য পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। সে সঙ্গে ছিল অদ্ভুত সব আকারে রঙবেরঙের আইলাইনার। ঠোঁটের রঙ কখনো চোখ ধাঁধিয়েছে, তো কখনো হারিয়েছে রঙ। ম্যাটি লিপসকে হটিয়ে গ্লসি ঠোঁটের রমরমা ছিল গেল বছরজুড়ে। চোখের সাজের সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে সাজাতেও শিমারের ব্যবহার ছিল শীর্ষে। বেজ মেকআপে কনট্যুরিংয়ের কঠিন জ্যামিতি ভুলে সৌন্দর্যসচেতনেরা হাইলাইটিং দিয়েই চোখ ধাঁধিয়েছেন।
চুলচর্চায় চলতি ছিল একদম আনকোরা সব ট্রেন্ড। তবে এগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণ করছে, গেল বছর তো বটেই, সামনের সময়েও বেশ রমরমা থাকবে এগুলো। হেয়ার কেয়ারে জনপ্রিয়তা দেখা গেছে প্রি পুয়িং আর কো-ওয়াশিংয়ের মতো কনসেপ্টগুলোর। চুলের যত্নে ব্যবহৃত হয়েছে অয়েল বেসড ক্লিনজার, এমনকি শিট মাস্কও। ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ছিল স্ক্যাল্প ডিটক্স ট্রিটমেন্ট, ব্লোটক্সের মতো হাইএন্ড সব কৌশল। সুপার ফুড শুধু খেয়েই খুশি ছিলেন না সৌন্দর্যসচেতনেরা। এসব দিয়ে তৈরি হয়েছে সুপার ফুড বেসড হেয়ার প্রডাক্টও। চুলের পরিপূর্ণ যত্নে। ব্রেইডের বদলে বছরটা ছিল বানের। বানানা, স্কার্ফ আর স্পেস বান দিয়ে তৈরি কেয়ারফুলি কেয়ারলেস লুক ছিল ট্রেন্ডের শীর্ষে। পুরো বছরজুড়ে ব্যবহৃত হয়েছিল নানান রকম হেয়ার অ্যাকসেসরিজ। হেয়ার কালারও ছিল ভীষণভাবে ইন। মিডনাইট ব্লু থেকে রেড যেমন ছিল, ছিল রোজ আর প্লাটিনাম ব্লন্ড। বেবিলাইটস জনপ্রিয় হয়েছে আঠারোতেই। তবে তাতেও দেখা গেছে বেসপোকের ব্যাপকতা।

 জাহেরা শিরীন
মডেল: অন্তরা, নিকি, সিম্মি ও চাঁদনী
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top