skip to Main Content

ফিচার I কলকাতার কেক-পার্বণ

মধ্য কলকাতার তালতলা এলাকায় সারি সারি বেকারি। মজুরির বিনিময়ে কেক বানিয়ে দেওয়া হয় এসব কারখানা থেকে। বড়দিনের আগে বাইরে থেকে উপকরণ নিয়ে ওই বেকারিগুলোয় গিয়ে কেক বানিয়ে আনার ধুম পড়ে যায়। কলকাতা থেকে লিখেছেন অতনু সিংহ

বড়দিন উপলক্ষে কেকের চাহিদা সর্বত্র। কিন্তু খ্রিস্টধর্মাবলম্বী এলাকাগুলোতে বড়দিনের আগে থেকে এই চাহিদা থাকে তুঙ্গে। কেক তৈরির আয়োজন রীতিমতো উৎসবের চেহারা নেয়। আমাদের আশপাশে বাঙালি খ্রিস্টানদের মধ্যেও ব্যাপারটা দেখতে পাই। কলকাতার তালতলা নামে যে অঞ্চলটি রয়েছে, সেখানে বড়দিনের প্রস্তুতি হিসেবে কেক তৈরির বিশেষ আয়োজন চোখে পড়ার মতো।
মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট, মৌলালি, তালতলা, এন্টালি- এসব এলাকা নিয়ে একটা বড় অঞ্চলে বাস করেন অসংখ্য বাঙালি খ্রিস্টান ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মানুষের এখানে সহাবস্থান রয়েছে। আর এই এলাকায় রয়েছে পুরোনো অনেক বেকারি ফার্ম। বড়দিন এলেই বেকারিগুলোয় স্থানীয় লোকজন কেক তৈরির সামগ্রী নিয়ে হাজির হয়ে যায়। সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে মজুরির বিনিময়ে কেক তৈরির শ্রমিকদের দিয়ে কেক বানিয়ে নেন। প্রতি কেজি ময়দায় ৩৫০-৪০০ টাকা মজুরি নেওয়া হয় কেক তৈরির জন্য। প্লেইন কেক, ফ্রুট কেক, কোকো কেক, চকলেট কেক, ওয়াইন কেকের মতো নানা ধরনের কেক তৈরি হয় এসব কারখানায়। যদিও বছরের অন্যান্য সময় তালতলা অঞ্চলের এসব বেকারিতে পাউরুটি তৈরি হয়, কিন্তু বড়দিন এলে স্থানীয় মানুষেরা ময়দা, মাখন, ঘি, কাজুবাদাম, কিশমিশ, চেরি, ডিমসহ কেক তৈরির বহুবিধ উপকরণ নিয়ে হাজির হয়ে যান এসব কারখানায়। কেক বানিয়ে নিতে যারা আসেন, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হলেও এসব বেকারি ফার্ম যারা চালাচ্ছেন, তারা বেশির ভাগ বাঙালি মুসলিম।
এসব বেকারি ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন তালতলার স্থানীয় বাসিন্দা ও লেখক কুন্তল রায়। তিনি জানাচ্ছেন, মধ্য তালতলা এলাকায় এ মুহূর্তে সব মিলিয়ে দশটির মতো এ রকম বেকারি রয়েছে, যেখানে বাইরে থেকে কেক তৈরির সামগ্রী নিয়ে গেলে মজুরির বিনিময়ে কেক বানিয়ে দেওয়া হয়। এ রকম কয়েকটি বেকারি কারখানার নাম হলো এস এস বেকারি, লিডার বেকারি, ডালিয়া বেকারি ইত্যাদি। যদিও স্বাস্থ্যসম্মত কেক তৈরির জন্য কলকাতা পৌরসভা যেসব নিয়মকানুন তৈরি করেছে, সেই গাইডলাইন সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে পারছে না এসব প্রতিষ্ঠান। কারণ, মধ্য কলকাতার এই বেকারিশিল্পের বর্তমান অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাই তালতলা, এস এন ব্যানার্জি রোডের বিভিন্ন পাড়ার ভেতরে মজুরির বিনিময়ে বাইরে থেকে নিয়ে আসা উপকরণসামগ্রী দিয়ে কেক তৈরি করে দেওয়ার এই মৌসুমি আয়োজন চলছে একটু রাখঢাক করেই। গণমাধ্যমের প্রবেশও নিয়ন্ত্রিত। কারণ, তারা চান না তাদের এই ব্যবসার খবর কলকাতা পৌরসভার কানে যাক। তাই পেশাদারি ক্যামেরায় ছবি তোলার ক্ষেত্রেও কেক তৈরির শিল্পী ও বেকারি মালিকেরা বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। কিন্তু মধ্য কলকাতার একটা বড় অংশের মানুষ প্রতিবছর বড়দিন এলেই এসব বেকারির সামনে ভিড় জমান। তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা এসব কারখানার আশপাশে রীতিমতো উৎসবের আকার নেয়।
একেকটা বেকারিতে কাজ করেন ১০-১৫ জন শ্রমিক। সারা বছর পাউরুটি, বিস্কুট ও টিফিন কেক তৈরি করা তাদের কাজ। কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বড়দিনের কেক বানানোর কাজে। শুধুই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ নয়; বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলিমসহ সব ধরনের মানুষ এখানে কেক তৈরি করানোর জন্য হাজির হন।
কুন্তলবাবু জানাচ্ছিলেন, তালতলা কসমোপলিটন এলাকা হলেও এখানকার একটা বড় অংশ বাঙালি খ্রিস্টান ও বাঙালি মুসলিম। এ ছাড়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও রয়েছে। এ ছাড়া বাঙালি হিন্দু, বিহারি হিন্দু ও মুসলিমরাও এই এলাকায় থাকে। খ্রিস্টানের সংখ্যা একটু বেশি ছিল বলে বরাবর বড়দিনের প্রস্তুতি হিসেবে কেক তৈরি করানোর হুজুগ রয়ে গেছে। অনেকে আবার নিজের বাড়িতেও কেক তৈরি করেন। কিন্তু নানা সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে বাঙালি খ্রিস্টান ও অ্যাংলোরা ওই এলাকা ছেড়ে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। তাই পার্কস্ট্রিট থেকে পার্ক সার্কাস, তালতলা, এন্টালিজুড়ে বড়দিন উদ্‌যাপনের ব্যাপারে যে বিরাট আয়োজন আর প্রস্তুতি ছিল, কালক্রমে তার জৌলুশ অনেকটাই ক্ষীণ হয়েছে। তারপরেও অবশ্য বর্তমান বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের খামতি নেই। ওই এলাকাগুলোয় গিয়ে দেখা গেল, কেক তৈরির জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করে আছে মানুষ।
জানা গেছে, একেকটা কারখানায় বড়দিনের আগে একদিনে ২৫০-৩০০ কেজি ময়দার কেক তৈরি হয়। এক কেজি ময়দা থেকে সর্বোচ্চ ১৪টি কেক পাওয়া যেতে পারে। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ময়দা থেকে নির্দিষ্ট করে কটা পাওয়া যাবে, সেটা নির্ভর করছে কী ধরনের কেক বানানো হচ্ছে তার ওপর।
কী কী উপকরণ বাইরে থেকে নিয়ে যেতে হয়: ময়দা, বাটার, মোরব্বা ও চিনি ১ কেজি করে, চেরি, কিশমিশ ও কাজুবাদাম ৫০০ গ্রাম করে, মুরগি অথবা হাঁসের ডিম ৩০টা, ক্রান ফ্রুট ১০০ গ্রাম, মিক্স ফ্রুট ২০০ গ্রাম, ঘি ১০০ গ্রাম, ভ্যানিলা ১ পিস, এলাচি গুঁড়া ১০ গ্রাম, ১টি জায়ফলের গুঁড়া এবং জয়ত্রী ১০ গ্রাম (গুঁড়া)।
কারখানায় বসে চোখের সামনে নিজেদের কেক বানিয়ে নিয়ে আসে সাধারণ মানুষ। তারা রেডিমেড কেক কেনার চেষ্টা করেন না। কারণ, এসব কেকের স্বাদ অতুলনীয়।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top