skip to Main Content

সাইডস্টোরি I পুনর্ব্যবহারের ফ্যাশন

ফ্যাশন জগতে এখন চলছে নবায়নযোগ্য উপাদান ব্যবহারের তরঙ্গ। পৃথিবী নামের গ্রহটিকে রক্ষার জন্য। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

ফ্যাশন সব সময় গতিশীল। এতে নতুন নতুন উপাদানের সংযুক্তিই এর চালিকা শক্তি। তবে ট্রেন্ড এবং ইউনিক সব ফ্যাশনের চক্করে পড়ে বিশ্বজুড়ে ঘটে চলেছে দূষণ। এ থেকে রেহাই পেতে আন্তর্জাতিক অনেক জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড কর্মপরিকল্পনায় এনেছে বিশেষত্ব। ডিজাইন ও উপাদানে প্রাধান্য পাচ্ছে পরিবেশ, আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেলের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ভার্জিনি ভিয়ার্ড দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন আমাদের চারপাশের পরিবেশ ধ্বংস করছি। এর থেকে পরিত্রাণের অন্যতম মাধ্যম রিসাইক্লিং ফ্যাশন।’
পরিত্যক্ত বা পুরোনো দ্রব্য কাজে লাগিয়ে নতুন এবং ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র তৈরি করাই রিসাইক্লিং। পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো এর ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। সবচেয়ে বেশি রিসাইক্লিং হচ্ছে প্লাস্টিক। বিশেষ করে প্লাস্টিকের বোতল। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের তৈরি প্রডাক্ট উৎপাদিত হয়েছে, তা এখনো এই পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। কারণ, এগুলোর বেশির ভাগই প্রকৃতিতে রয়ে যায়। যার অর্থ প্লাস্টিক ‘অমর’। এগুলো ভেঙে ভেঙে ছোট টুকরো হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ভাগাড়ে গিয়ে মাটি দূষণ করে এবং জলাশয়, নদী ও সমুদ্রে দূষণ ঘটায়। শুধু তা-ই নয়, এই প্লাস্টিক সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হয়। প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদান পরিবেশ ও মানুষের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রেও। এখন অনেক সামুদ্রিক মাছের শরীরে প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এটি অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে মহাসাগরগুলোতে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের সংখ্যা বেশি হবে।
সামুদ্রিক দূষণ রোধে ২০১৭ সালে জাতিসংঘ ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ এবং ‘ইউনাইটেড নেশন এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম ‘ক্লিন সি’ ক্যাম্পেইন শুরু করে। উদ্দেশ্য, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে তা রিসাইকেল করে পোশাকে পরিণত করা। অনেক পরিবেশবাদী সংস্থা এই উদ্যোগে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থা হচ্ছে কোটস, পার্লি, ওশেন, ওয়েস্ট টু ওয়্যার। এই সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে সামুদ্রিক দূষিত প্লাস্টিক সংগ্রহ করে তা বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুতা বানিয়ে তা থেকে নানা ধরনের পোশাক, ব্যাগ, জুতা এমনকি আসবাব পর্যন্ত তৈরি করছে।
কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ফ্যাশন উইকের মঞ্চে বিখ্যাত ডিজাইনাররা প্লাস্টিকের সুতায় তৈরি পোশাক নিয়ে হাজির হচ্ছেন। আর সেই ধারা বজায় রেখে অনেক ছোট-বড় ব্র্যান্ড লঞ্চ করেছে রিসাইকেল প্লাস্টিক প্রডাক্ট। এগুলোর মধ্যে ১১টি ব্র্যান্ড বেশ জনপ্রিয় হয়েছে এই উদ্যোগের জন্য।
ভেখা
এই ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ব্র্যান্ড ফুটওয়্যার আর অ্যাকসেসরিজকে একটি অন্য স্তরে নিয়ে গেছে ‘বি মেশ’ ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার করে, যা আদতে প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করে তৈরি। ভেখা এথিক্যাল স্নিকারের জন্য বিখ্যাত। প্রতিটি স্নিকার তৈরি হয় তিনটি প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে। স্নিকারগুলো ওয়াটারপ্রুফ এবং আরামদায়ক। স্নিকারের বাকি অংশগুলো তৈরি করা হয় উচ্চমানের পরিবেশবান্ধব উপাদান যেমন অর্গানিক সুতা, রাবার ইত্যাদি দিয়ে। এ সবকিছু সরাসরি তুলা ও রাবারচাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
গার্লফ্রেন্ড কালেক্টিভ
অ্যাকটিভওয়্যার বা ব্যায়ামের পোশাকের এই ব্র্যান্ড ১০০% রিসাইকেল প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করছে নারীর জন্য আকর্ষণীয় স্পোর্টস ব্রা এবং লেগিংস। তাদের রিসাইকেল পলিয়েস্টার তাইওয়ান থেকে সংগ্রহ করা প্লাস্টিকের বোতল থেকে তৈরি। আর নাইলন তৈরি করা হয়েছে মাছের জাল রিসাইকেল করে। এই দুটি উপাদান দিয়ে দারুণ সব অ্যাকটিভওয়্যার তৈরি করছে, যেগুলো ত্বকের জন্যও ভালো। এ ছাড়া নারীর জন্য সুন্দর সুন্দর পোশাক বানাচ্ছে এই ব্র্যান্ড, যাতে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব রঙ।
অ্যাডিডাস বাই স্টেলা ম্যাককার্টনি
অ্যাডিডাস জোড় বেঁধেছে সাসটেইনেবল লাক্সারি ফ্যাশন ব্র্যান্ড স্টেলা ম্যাককার্টনির সঙ্গে এবং বাজারে নিয়ে এসেছে অসাধারণ সব স্নিকার। এগুলোর ৫৭% অংশ তৈরি হচ্ছে রিসাইকেল পার্লি ওশেন প্লাস্টিক থেকে।
ড্রেসডেন অপটিকস
শুধু জুতা এবং পোশাকই নয়, রিসাইক্লিংয়ে তৈরি হচ্ছে চশমাও। ড্রেসডেন এমনই একটি ব্র্যান্ড, যারা ১০০% ইকো-ফ্রেন্ডলি চশমা বানিয়ে থাকে। এগুলো বানাতে কোম্পানিটি ব্যবহার করে প্লাস্টিকের বোতল, এমনকি দুধের বোতলের ছিপি, মাছের জাল আর পুরোনো ব্যাংক নোট! এই চশমা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি সাশ্রয়ী। লেন্সগুলো সহজেই পরিবর্তন করা যায় এবং ফ্রেমে রয়েছে রঙের বৈচিত্র্য।
বাটোকো
ব্রিটিশ সুইমওয়্যার ব্র্যান্ড, কোম্পানিটি সমর্থন করে পরিবেশবাদী সংস্থা মেরিন কনজারভেশন সোসাইটিকে। বাটোকো সাধারণত মহিলা এবং শিশুদের জন্য সুইমওয়্যার বানিয়ে থাকে, যেগুলো শুধু রিসাইকেলই নয়, ১০০% ভেগান প্রডাক্টও বটে।
পাটাগোনিয়া
প্রতিষ্ঠানটি অনেক আগে থেকে পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৩ সালে প্লাস্টিকের বোতল রিসাইকেল করে কোম্পানিটি একধরনের ফ্যাব্রিক তৈরি করে, যা ‘ফ্লিস’ নামে পরিচিত। সেই থেকে এই উপাদানে বিভিন্ন ধরনের শীতের পোশাক বানিয়ে আসছে। এ ছাড়া ব্যবহার করে রিসাইকেল ডাউন, উল, পলিয়েস্টার। পাটাগোনিয়ার রিপেয়ার এবং রিইউজ প্রোগ্রামে পুরোনো প্রডাক্ট ঠিক করে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
মারা হফম্যান
এটি শুধু নারীর পোশাকের ব্র্যান্ড, যেখানে ডিজাইনার ক্লথিংও পাওয়া যায়। এখানকার পোশাক অত্যন্ত উচ্চমানের ও দীর্ঘস্থায়ী। যেসব উপাদান ব্র্যান্ডটি ব্যবহার করে, সেগুলো হলো গটস (গ্লোবাল অর্গানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড) অনুমোদিত তুলা থেকে তৈরি সুতা, রিসাইকেল পলিয়েস্টার, রিসাইকেল নাইলন। রানওয়ে থেকে বিচ সব জায়গায় পরার উপযোগী পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির জন্য বেশ জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে মারা হফম্যান।
কাঠমান্ডু
নেপালের রাজধানীর নামে এই ব্র্যান্ড নিউজিল্যান্ডের। সাসটেইনেবল ফ্যাশন চর্চার জন্য বিখ্যাত। এই ব্র্যান্ডে মূলত পুরুষ ও নারীর ভ্রমণের পোশাক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়া যায়। সব প্রডাক্টই পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি। কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ব্র্যান্ডটির যাত্রা শুরু হয়।
এলে ইভান্স
মেলবোর্নভিত্তিক ব্র্যান্ড এলে ইভান্স, সাসটেইনেবল সুইমওয়্যারের পথিকৃৎ। ব্র্যান্ডটি নারী ও শিশুদের জন্য অসাধারণ সব সাঁতার পোশাক তৈরি করে থাকে শুধু ময়লা-আবর্জনা থেকে পাওয়া ফ্যাব্রিক দিয়ে। এ ছাড়া একটি টেক ব্যাক সার্ভিসও আছে, যেখানে পুরোনো জামাকাপড় দান করা যায়। পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির জন্য।
রথি’স
ইউএসভিত্তিক ফুটওয়্যার কোম্পানি। এই ব্র্যান্ড আকর্ষণীয় সব স্নিকার, লোফার, ফ্ল্যাট ইত্যাদি জুতা বানিয়ে থাকে প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যবহার করে; যেগুলো ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করা হয়। কোম্পানির জুতাগুলো টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
প্রাদা
সম্প্রতি লাক্সারি ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাদা ২০২০ সালের কালেকশন থেকে ফার নিষিদ্ধ করেছে। শুধু তা-ই নয়, ‘রি-নাইলন’ নামের একটি প্রডাক্ট লাইন আনছে, যেখানে পরিবেশবান্ধব ব্যাকপ্যাক বানানো হয়েছে সমুদ্রে পাওয়া প্লাস্টিকের আবর্জনা, মাছের জাল, টেক্সটাইল ফাইবার ওয়েস্টে তৈরি সিনথেটিক নাইলনের ফ্যাব্রিক থেকে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনে নাজেহাল পৃথিবী নামের গ্রহটি। তার ওপর পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে কেবল মানুষের উদাসীনতা ও অসচেতনতার কারণে। তাই ভবিষ্যতে পৃথিবী রক্ষায় সাসটেইনেবল ফ্যাশন বিশেষ করে রিসাইক্লিং ফ্যাশনের চর্চা অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদেরা।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top